আঁতেল কারে কয়
পনি কি আঁতেল? মানে, কেউ আপনাকে আঁতেল বললে গর্ব বোধ হয়? নাকি কিন্তু কিন্তু করেন?
আজকাল অফিস, কাছারি, স্কুল, কলেজ যেখানেই যান না কেন কথায় কথায় আঁতেল শব্দটির প্রয়োগ যত্রতত্র। এই তো সেদিন কফি শপে কয়েক জন কলেজপড়ুয়া ছেলেমেয়ে আড্ডায় মশগুল। এক সময় তাঁদেরই গ্রুপের একজন সম্পর্কে তারস্বরে অন্যেরা বলে উঠলেন, “খুব আঁতেল হয়েছ না?” তিনি বেচারি পড়ে গেলেন বেশ অস্বস্তিতে। কোথায় ‘আঁতেল হয়েছি, বেশ হয়েছি’ টাইপের হাবভাব করবেন! তা নয়, এ তো লজ্জায় মরি মরি অবস্থা। হালকা শ্লেষের ছোঁয়ায় কাউকে বিদ্ধ করতে আঁতেল কথাটির জুড়ি মেলা ভার। অনেকটা মিঠি ছুরির মতো। খোঁচা খেলেও কেউ উঃ করবেন না।

আঁতেল বলতে কী বুঝি?
“বুদ্ধিজীবী বা ‘ইন্টেলেকচুয়াল’ শব্দটির অপভ্রংশ এই আঁতেল শব্দটি,” বললেন ভাষাতত্ত্ববিদ পবিত্র সরকার। তাঁর মতে চল্লিশ-পঞ্চাশের দশকে এই বুদ্ধিজীবী বাঙালির আত্মপ্রকাশ ঘটে, যাঁরা নিয়মিত কফি হাউসে বসতেন, পরনে পাঞ্জাবি, নিজেদের মনে করতেন ‘আমরাই সেরা’। এই সব বুদ্ধিজীবীকে দেখে অন্যান্যদের বিদ্রুপ এবং প্রতিক্রিয়াতেই ‘আঁতেল’ শব্দটির প্রয়োগ শুরু। আপনার প্রতিক্রিয়া কী ছিল? উত্তরে তিনি বললেন, “আমি তো গ্রামের ছেলে। কলেজে পড়াকালীন এই আঁতেলদের ভয়ই পেতাম।” আর এখন? “এখনও ভয় পাই।” আর কেউ যদি আপনাকে আঁতেল বলে? “আমাকে আঁতেল বললে কষ্ট পাব। কারণ আমার বিশ্বাস, আমি কখনও কিছু জাহির করতে চাই না। এখন যেমন পড়ুয়াদের অনেক সময় দেখি কথায় কথায় ‘কালচারাল থিয়োরি’, তৃতীয় বিশ্বের সাহিত্য নিয়ে আলোচনা করছে। ঠিক বুঝতে পারি না কতটা বুঝে বা না বুঝে বলছে।”
অর্থনীতির ছাত্র শৌভিককে সবাই আঁতেল বলে। উনি আঁকতে ভালবাসেন। একদিন কথায় কথায় ভিনসেন্ট ভ্যান গ্যগ, পিকাসোর কথা বলেছিলেন বন্ধুদের। ব্যস, সঙ্গে সঙ্গে ট্যাগ হয়ে গেল আঁতেল বিশেষণটা। প্রথম প্রথম আপত্তি করতেন। আর এখন ধীরে ধীরে এই স্টেটাসটা বেশ উপভোগ করতে শুরু করেছেন। শুধু তাই নয়। মুচকি হেসে শৌভিক বললেন, “আঁতেল ট্যাগের সংরক্ষণ করতে আজকাল তাই মাঝে মাঝে সচেতন ভাবেই বন্ধুদের ভাষায় ‘আঁতেল মার্কা’ কথাও বলি।” স্টেটাস আপডেটের মতো ট্যাগ আপডেটেড রাখা।

মহাভারতেও আঁতেল
আপনি কি ভাবছেন আপনি একাই আঁতেল? সেই মহাভারতের সময়ও আঁতেলরা ছিলেন। “বুদ্ধিজীবী শব্দটির উল্লেখ পাই মহাভারতে,” বললেন নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ি। দ্রৌপদীর স্বয়ম্বর সভা। অর্জুন এসেছেন, রয়েছেন পরাক্রমী রাজা-মহারাজারা। তখনই সভাস্থলে উপস্থিত হয় ‘নিপুণা বুদ্ধিজীবিন’ কথাটি। এই সংশয়সূচক মন্তব্যটি করা হয়েছিল লক্ষ্যভেদ হবে কি হবে না এই প্রসঙ্গে। মহাভারতের কোন চরিত্রকে তিনি আঁতেল বলবেন? খানিক ভেবে নৃসিংহবাবু বললেন, কর্ণের কথা। “কর্ণের ‘আমি সব পারি’ মানসিকতার পরিচয় পাই আমরা। তাঁর আচরণে অহংবোধ প্রকাশ পায়। যুদ্ধক্ষেত্রে দুঃশাসনের মৃত্যু হয়েছে, কর্ণ কিন্তু কিছুই করতে পারেন না। অথচ দুর্যোধনকে অভয় দেন চিন্তা না করতে।” নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ির মতে, আজকের দিনে দাঁড়িয়েও বোঝা যায়, জ্ঞান পরিপূর্ণ নয় যেখানে, সেখানেই থাকে ওপরচালাকির প্রবণতা। তাই ধীরে ধীরে আঁতেল শব্দটির অর্থও আমাদের কাছে বদলে গিয়েছে।

লালন ছিলেন প্রকৃত আঁতেল
লালন ছিলেন নিরক্ষর অথচ জ্ঞানী। তাঁর জীবনতত্ত্ব আমাদের মুগ্ধ করে। পরিচালক গৌতম ঘোষের মতে এঁরাই প্রকৃত আঁতেল। “যদিও এই শব্দটির ব্যবহার আজকাল কাউকে সমালোচনায় বিদ্ধ করতে করা হয়ে থাকে। কিন্তু আমার বিশ্বাস সুশিক্ষা একদিন এই ছোট গণ্ডি থেকে আমাদের বের করে আনবে।” গৌতম পরিচালিত ফিল্মের কোন চরিত্রকে তিনি আঁতেল মনে করেন? “‘দেখা’র সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের চরিত্রটার কথা বলতে পারি। চরিত্রের মধ্যে দ্বিচারিতা আছে। ভাল-মন্দ মেশানো, বুদ্ধি সংবলিত একটি চরিত্র। বলতে পারি অপুর কথাও। অপুকেও আঁতেল মনে হয় আমার। তাঁর অনুসন্ধিৎসু মন সারাক্ষণ তাড়া করে তাঁকে।” আর যাঁরা আপনাকে আঁতেল পরিচালক বলে, তাঁদের কী উত্তর দেন? ‘‘‘পদ্মা নদীর মাঝি’ করার পর অনেকে বলেছিলেন। আমার উত্তর ছিল হোসেন মিঞার দর্শন, যদি কেউ না বোঝেন তা হলে তিনি নিজের জ্ঞানকেই অস্বীকার করছেন।” তবে গৌতম নতুন প্রজন্মের মধ্যেও যখন মাঝে মাঝে গভীর চিন্তা নিয়ে কাজ করার প্রবণতা দেখেন, তখন তাঁর খুব ভাল লাগে।
কথা হচ্ছিল চিকিৎসা বিজ্ঞানের ছাত্র ধীমানের সঙ্গে। ওঁর মতে, “আমাদের সকলেরই তো ‘ইনটেলেক্ট’ আছে। তাই সবাই আঁতেল। নিজেকে আঁতেল ভাবলেই আঁতেল। না ভাবলে নয়। আমরা সবাই সাহিত্য চর্চা করি। সব ধরনের সিনেমা দেখি। নাটক দেখি। তা নিয়ে আলোচনাও করি। আমাকে কেউ আঁতেল বললে, বলতে পারে। না বললেও কিছু যায় আসে না,” বলছেন ধীমান।

প্রেমিক/প্রেমিকা যদি আঁতেল হয়
প্রেমের ব্যাপারে আঁতেল হওয়াটা আবার হালফিলের ফ্যাশন হয়ে গিয়েছে। ছেলেদের বক্তব্য, গার্লফ্রেন্ড আঁতেল হলে নিজেকে বেশ ঘ্যামা মনে হয়। অন্যদের কাছে কলার উঁচু থাকে। হেব্বি লাগে। সেটা কী রকম? আসলে আঁতেল গার্লফ্রেন্ড হলে প্রেমের ধরনটা একটু অন্য রকম হয়। মানে, তুমি আমায় ভালবাসো টাইপের ঘ্যানঘেনে কথাবার্তাও কম। ঝগড়াও কম। কোনও বার্ডেন নেই। সম্পর্ক নিয়ে বাড়তি টেনশন নেই। যত দিন ভালবাসা, তত দিন প্রেমিক-প্রেমিকা। ভালবাসা না থাকলে জাস্ট বন্ধু। এ আর নতুন কী! আঁতেল, নন-আঁতেল এখন তো সবাই এই ভাবেই সম্পর্কে থাকে। ইতিহাসের ছাত্র অরিজিৎ বলছেন, “সবাই মুখে বললেও কাজে তা করে না। তাই সম্পর্ক ভাঙলে পরিবেশ কেমন ভারী হয়ে যায়। যেন যত দোষের নন্দ ঘোষ আমি। তাই গার্লফ্রেন্ড একটু খোলা মনের বা আঁতেল হলে ভাল।”
বয়ফ্রেন্ড আঁতেল হলে? “মোটেও ভাল লাগে না,” সটান বলে দিলেন তিন্নি। প্রেম করবে, না কবি-কবি হাবভাব করবে? ও সব পোষায় না। কিন্তু প্রেমে তো কবিতা ভাল লাগার কথা? “ধুর, একটা দু’টো কবিতা ঠিক আছে। প্রতিদিন হলে ঘ্যানঘেনে লাগে।” তার মানে আঁতেল, নন-আঁতেল প্রেমের ক্ষেত্রে বিশেষ কোনও সুবিধে নেই।

আঁতেলদের নতুন ঠেক কফি শপ
একটা সময় অ্যাকাডেমি, নন্দন চত্বর, কফি হাউস ছিল আঁতেলদের আড্ডার জায়গা। এখন হরেক রকমের কফিশপ তার জায়গা নিয়েছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডা। পরের পর কফি। তুমুল তর্ক-বিতর্ক। দেশ, সমাজ, শিক্ষা, রাজনীতি, বাজেট, অস্কার, সোমালিয়া, ওয়াল স্ট্রিট, আফগানিস্তান, কিছুই বাদ থাকে না। সব বয়সিরাই আড্ডায় আসতে পারে। সময়ের কোনও সীমা নেই। কত ক্ষণ আড্ডা চলবে কে জানে! কলেজের পর কী যে করে ছেলে-মেয়ে, তা বুঝেও পান না বাবা-মা। এমন গম্ভীর হাবভাব যে জোর গলায় বেশি কিছু বলতেও পারেন না অভিভাবকরা। পাছে গুণধর ছেলে বা মেয়ে বলে ওঠে, ‘প্লিজ, স্পেস দাও আমাকে’। “আমাদের ছোটবেলার মতো কড়া শাসন কী জিনিস তা তো জানে না এরা,” বিরক্ত গলায় বলেন সুস্মিতা বসাক। “স্পেস দেওয়া বলতে যে কী বোঝায় আজ পর্যন্ত বুঝলাম না।”

সিনেমা দেখে আঁতেলগিরি
আঁতেল হতে গেলে নাকি সিনেমা দেখার ক্ষেত্রেও কিছু বাছবিচার করতে হবে। ‘রাউডি রাঠোর’ দেখতে মন চাইলেও, আঁতেল ট্যাগ বজায় রাখতে এই শখ তো বলি দিতেই হবে। একটা সময় ফিল্মের ক্ষেত্রে একটা বিভাজন ছিল, বাণিজ্যিক আর প্যারালাল। কিন্তু এখনও কি এই বিভাজন আছে? মানে ‘পাগলু’, ‘মুক্তধারা’, ‘শূন্য অঙ্ক’ সবই তো সমান আগ্রহে দর্শকের দেখার কথা। ফিল্মের ক্ষেত্রে শহর আর মফস্সল, আঁতেল, নন-আঁতেল দূরত্বটা কি সত্যিই ঘুচেছে? পরিচালক রাজ চক্রবর্তী বলছেন, “অবশ্যই ঘুচেছে। দর্শক শুধু ভাল গল্প চায়। তাই সবাই সব রকম সিনেমা দেখছেন। আর যেটুকু দূরত্ব আছে, তাও খুব তাড়াতাড়ি মিটে যাবে।” যদিও ভিন্ন মত পোষণ করছেন পরিচালক শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। “রাজু হিরানির ‘থ্রি ইডিয়টস’, ‘মুন্নাভাই এমবিবিএস’-এ যা করতে পেরেছে, তা এখনও আমরা পারিনি। এই সিনেমাগুলো সব ধরনের মানুষ দেখেছেন। আমাদের দর্শকরা যাঁরা ‘আওয়ারা’ দেখেছেন, অনেকেই ‘মুক্তধারা’ দেখেননি। আবার উলটোটাও হয়েছে। তবে নিঃসন্দেহে এখন সব ধরনের সিনেমা দেখার প্রবণতা অনেক বেড়েছে। দূরত্ব অনেকটা কেটেছে, কিন্তু পুরোটা হয়নি।” তার মানে সিনেমা দিয়ে আঁতেল প্রমাণিত হওয়ার বিষয়টি ঠিক জোরদার হল না।

আঁতেল বদনাম ঘোচাতে
আপনার আঁতেল ট্যাগ থাকল কী থাকল না, তা নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে বরং সবাইকে চমকে দিয়ে নিজেই নিজের ট্যাগ হয়ে উঠতে পারেন। আপনার কথা বলা, তাকানো, ঝগড়া, প্রেম, পছন্দ, অপছন্দ নিয়ে আপনি চমৎকার। নিজের আমিতে বুঁদ থাকুন। সেটাই আপনার স্টেটমেন্ট। একেবারে শেষে ছোট্ট একটা কথা বলি, আপনার দিকে যেমনই বিশেষণ ধেয়ে আসুক না কেন, পরিবর্তে মুখে হাসি নিয়ে আপনি তাকে প্রশংসায় ভরিয়ে দিন। দেখবেন সবাই কেমন অবাক হয়ে যাবে! ওই যে বলে না, ওস্তাদের মার ...

অলঙ্করণ: সুমন চৌধুরী



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.