|
|
|
|
নজির গড়ল তরুণ দল |
গৌতম ভট্টাচার্য • মোহালি |
মেলবোর্নের ৬০ জলিমন্ট স্ট্রিট বাড়িটা ক্রিকেটপ্রেমিকদের কাছে ততটাই পরিচিত, যতটা রহস্যানুরাগীদের কাছে বেকার স্ট্রিটের খয়েরি রঙের একটা তিনতলা বাড়ি! ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার এ হেন সদর দফতর থেকে বিকেলে একটা টুইট ভেসে এল: জেতার জন্য অস্ট্রেলিয়াকে ফেলতে হবে আর সাত উইকেট। ভারতকে করতে হবে শেষ ৮ ওভারের মধ্যে ২৮ রান।
হিসেবটাই বলে দিচ্ছে ভারত তখন কতটা জমকালো অবস্থায়। অস্ট্রেলিয়ার জয়ের সম্ভাবনাটা সফরকারী অজি প্রেসের মধ্যেও কৌতুকেরই উদ্রেক করছিল। কে জানত, দ্রুত এমন পরিস্থিতি তৈরি হবে যে, টুইটটা সত্যি না হলেও হোক, তৃতীয় একটা পরিস্থিতি অভাবনীয় ভাবে সত্যি হয়ে যাচ্ছিল ড্র! |
|
হারের গ্লানি। সোমবার মোহালিতে টিম অস্ট্রেলিয়া। উৎপল সরকারের তোলা ছবি। |
ভারত তার একাশি বছরের ক্রিকেট ইতিহাসে এই প্রথম ব্র্যাডম্যানের দেশের বিরুদ্ধে ৩-০ এগিয়ে যাওয়া এবং স্বয়ং অধিনায়ক স্থানীয় সংস্থাকে দু’টো শ্যাম্পেনের বোতল আনাতে বলার পরেও দেড় ঘণ্টা অতিক্রান্ত। প্রেসবক্স সোজাসুজি পিচের যে দিকটায় অসম্ভব রানটা নিতে গিয়ে তেন্ডুলকর আউট হলেন, সেই প্রান্ত থেকে বোলিং অনুশীলন করছেন হরভজন সিংহ। উৎসবের গাড়ি-বারান্দায় তাঁর কায়া পার্ক করা নেই, দেখাই যাচ্ছে। কিন্তু উল্টো দিকে চণ্ডীগড় প্রান্তের উইকেটে, যেখান থেকে ম্যাচের শেষ ওভারে ধোনি দমাদ্দম তিনটে বাউন্ডারি মেরে দিলেন, সে দিকে কার ছায়া পড়েছে? দীর্ঘকায় কে দাঁড়িয়ে ভাজ্জিকে প্র্যাক্টিস করাচ্ছেন? চোখের দেখায় বিশ্বাস হল না বলে আবার সফররত সাংবাদিকদের সঙ্গে মিলিয়ে নিলাম। ইয়েস, ম্যাথু হেডেন! অ্যান্ড্রু সাইমন্ডসের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু। মাঙ্কিগেট মামলায় সর্দারের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেওয়া, গত বছর প্রকাশিত আত্মজীবনীতেও তাঁকে একহাত নেওয়া হেডেন! আধ ঘণ্টারও বেশি হয়ে গেল, শ্যাম্পেনের ফেনার বাইরে থাকা ভাজ্জিকে সযত্নে প্র্যাক্টিস করাচ্ছেন কি না জাতশত্রু হেডেন। দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল, গোটা দিনের থিমের সঙ্গে শেষ দৃশ্যটাও তা হলে মিলে গেল। আজব ক্রিকেট দিন এটাই ছিল সোমবারের থিম! |
|
সচিনের রানআউটে তৈরি টেনশন শেষ পর্যন্ত ঢাকা পড়ে গেল শ্যাম্পেনের ফোয়ারায়। ছবি: উৎপল সরকার |
• ভুবনেশ কুমার সকালে হওয়া প্রথম ৬০ ওভারে এক বারের জন্যও বল পেলেন না। অথচ কালকের তিনটে উইকেট তাঁরই নেওয়া। ধোনির আজব সিদ্ধান্ত।
• বিপক্ষের ৯ উইকেট ফেলার পর ড্রিঙ্কস শেষে নতুন করে গভীর ভাবে হাডল করল টিম। এ জিনিসও সচরাচর হয় না। এ দিন স্টার্ক-ডোহার্টির এক ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে ১০৯ বলের প্রায় ড্র করে দিতে বসা পার্টনারশিপ সেটাই সম্ভব করে দিল।
• ওভারপিছু মাত্র চার রানের সামান্য বেশি তাড়া করে ভারত যা ব্যাটিং স্ট্র্যাটেজি নিয়েছিল, সেটাও কী আজব! পূজারা বিশ্বক্রিকেটে গড়ে এখন তিন নম্বরে। ব্র্যাডম্যান ৯৯.৯৪। সিড বার্নস ৬৩.০৬। তিনি, পূজারা ৬১.৫২। এই তিন নম্বরটা যত গৌরবের, আজকের তিন নম্বরটা ততই অগৌরবের। এ দিন স্ট্রাইকরেটেও কি না তিন নম্বরে! কিছু ভারতীয় ক্রিকেট অনুরাগীর যদি সোমবার বিকেলে সরবিট্রেটের প্রয়োজন হয়ে থাকে, ত্রয়ী তার জন্য দায়ী। যার একটা মুখ পূজারা! ওপেন করে ৫১ বলে মাত্র ২৮। রানরেটটা পুরো ঝুলিয়ে দিয়েছিলেন।
• বিরাট কোহলি এত চালিয়ে খেলেন। আজ টেস্ট ম্যাচ যখন টি-টোয়েন্টিতে পর্যবসিত, তখন এটা তো তাঁরই মঞ্চ। সেই কোহলি করলেন ৬১ বলে ৩৪। ধোনি যাঁকে অনেকের মনে হচ্ছিল সচিনের আগে নিজেকে তুলে আনা উচিত, তিনি একটা সময় বল ব্যাটে ছোঁয়াতে পারছিলেন না। আবার যে মানুষটা ২৪ বলে মাত্র ৬ রান করে ম্যাচটাকে ড্রয়ের দিকে অদ্ভুত ভাবে ঠেলে দিচ্ছেন, যাঁর প্রতি গ্যালারি থেকে হায়-হায় আর টিটকিরির হাততালি শুরু হয়ে গিয়েছে, তিনি পক্ষাঘাতগ্রস্ত অবস্থা থেকে ‘হঠাৎ জেগে উঠে’ ১৫ বল বাকি থাকতে টিমকে জিতিয়ে দিলেন। আজব ছাড়া কী লিখব। যে লোকটার নিশ্চেষ্টতা তেন্ডুলকরকে (২৩ বলে প্রশংসনীয় ২১) আত্মঘাতী হওয়ার দিকে ঠেলে দিল, তিনিই কি না একই বোলারকে এমন অবলীলায় তিনটে রাক্ষুসে বাউন্ডারি মারলেন, যে শেষে মনে হচ্ছিল ধোনির উইনিং স্ট্রোক মানে তো ছক্কা। হঠাৎ চার হল কেন আজ?
• রবীন্দ্র জাডেজার ওই মোক্ষম সময়ে সিডলকে বাউন্ডারি মারতে পারাটাও আজব। গোটা সিরিজে এবং তারও আগে জাডেজার ব্যাটিং ব্যর্থতা নিয়ে সমবেত সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছেন বিশেষজ্ঞরা। সৌরাষ্ট্রে ওরা ব্যাটসম্যানের জন্য সিমেন্টের পিচ তৈরি করে। তাই জাডেজা রঞ্জিতে তিনশো-টিনশো করতে পারে। আজ ধোনি-কোহলি-পূজারারা শেষ দিনের পিচে বল খুঁজছেন, এই অবস্থায় দু’টো বাউন্ডারি কিন্তু পার্শ্বচরিত্রের অনবদ্য কাজ। খেলার মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া কাজ। যার ফলে ৩-০-র বুদবুদে পরিবেশ ফের মায়াময় হয়ে ওঠে। কিন্তু একটা সময় এত টেনশন তৈরি হয়ে গিয়েছিল যে, দু’বছর আগে ডমিনিকার মাঠে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ম্যাচ মনে পড়ে যাচ্ছিল। সে দিন দ্রাবিড়-লক্ষ্মণরা তাঁর টিমে থাকা সত্ত্বেও ৪৭ ওভারে ১৮০ রান তোলার সহজ টার্গেট তাড়া করতে চাননি ধোনি। ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাঠে আরও এক বার জেতার শখ আশ্চর্য ভাবে দেখাননি বলে খেলার শেষে ভারত ছিল তিন উইকেটে ৯৪। ডমিনিকা যে মোহালিতে প্রত্যাবর্তন ঘটায়নি, সেটাও মনে হচ্ছে সোমবারের আজব সিরিজে পড়বে!
• আর হ্যাঁ, টেস্ট ক্রিকেটে এই প্রথম, তৃতীয় দিন লাঞ্চ নাগাদ তাদের প্রথম ইনিংস শুরু করা দল খেলা জিততে পারল!
দিল্লিতে ৪-০ করে ব্রাউনওয়াশ সম্পন্ন হচ্ছে কি না, তা নিয়ে বিশেষ উচ্চবাচ্য শুরু হয়নি। ঘরের মাঠে ওটাই তেন্ডুলকরের শেষ টেস্ট আবির্ভাব কি না, তা নিয়ে জিজ্ঞাসার স্পন্দন যদিও বেড়েই চলেছে। সত্যি এটাই শেষ? নাকি বোর্ড তাঁর জন্য মাঝে একটা সিরিজ পাতাবে?
এমনকী, শিখর ধবনের জায়গায় কোটলায় গম্ভীরকেই ফেরানো হবে কি না, তা নিয়েও নাড়াচাড়া নেই। ছয় উইকেটে জিতে সিরিজে ৩-০ এগিয়ে থাকার চেয়েও যেটা পারফিউমের মতো ভেসে বেড়াচ্ছে, তা হল ভরসা! যে আসবে সে-ই খেলে দেবে! যুবশক্তি এতটাই তৈরি রয়েছে যে, সর্বত্র তাদের নেটওয়ার্ক পাওয়া যাচ্ছে।
ভারতীয় ক্রিকেট ইতিহাসে সোমবার ১৯ মার্চ আজব দিন এই জন্য যে, এই প্রথম বোধহয় চিরকালীন তারকাদের প্রভাব থেকে দেশ স্বাধীন হল। ধোনিকে যাঁরা সিরিজে এগিয়ে দিচ্ছেন, সেই ঝাঁকটা তো সবাই তরুণ তুর্কি। ভুবনেশ, পূজারা, ধবন, অশ্বিন, মুরলী, জাডেজা, ওঝা। কোহলি এদের মধ্যে সবচেয়ে সিনিয়র আর তিনিই বা ক’দিন টেস্ট দলে ঢুকেছেন! টেস্ট টিমকে এত নতুন ছেলে নিয়মিত জেতাচ্ছে, এমন আগে ঘটেনি।
এখানে না থাকা দুই প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বীর মধ্যে আরও একটা ঐতিহাসিক তর্কেরও যেন ফল ভারতের পক্ষে ৩-০ হয়ে রইল মোহালির পরে।
প্রতিদ্বন্দ্বীদের নাম সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় ও গ্রেগ চ্যাপেল!
প্রথম জন বরাবর বিশ্বাস করেছেন, প্লেয়ার তৈরি হয় তার নিজের নিয়মে। দ্বিতীয় জন বরাবর বিশ্বাস করেছেন, প্লেয়ার তোলে সিস্টেম। যেমন সিস্টেম ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার আছে।
ক্লার্কের টিমকেই স্রেফ ভারত তুড়ি মেরে হারিয়ে দিচ্ছে, আগের টিমগুলোকে পারেনি এটা সত্যি হলে সৌরভ আজ এগোতে পারতেন না। কিন্তু তা তো নয়। অস্ট্রেলিয়া এই নিয়ে ভারতে টানা আধ ডজন টেস্ট হারল। আর একটু পিছোলে পরিসংখ্যান দাঁড়ায়: গত দশ টেস্টে ২ ড্র, ভারতের ৮ জয়।
৬০ জলিমন্ট স্ট্রিট যতই ‘বিশ্বক্রিকেটের পেন্টাগন’ হিসেবে খ্যাত হোক, অচিরেই হয়তো কোনও না কোনও টুইটে মেনে নিতে হবে, বিদেশি ব্যক্তিগত প্রতিভায় পেন্টাগন আক্রান্ত!
|
নাটকীয় শেষ বেলা |
মোহালি অক্টোবর ২০১০
লক্ষ্য ১৬১, হাতে ছ’উইকেট। ইশান্ত এবং প্রজ্ঞান ওঝাকে নিয়ে শেষ ৯২ রান তোলেন লক্ষ্মণ (৭৩ ন.আ.)। জয় ১ উইকেটে।
কলকাতা মার্চ ২০০১
স্টিভ ওয়-রা ৭৫ ওভার টিকে থাকলে ম্যাচ ড্র হত। সাড়ে ছ’ওভার বাকি থাকতে অস্ট্রেলিয়াকে শেষ করেন হরভজন (৬-৭৩)।
চেন্নাই মার্চ ২০০১
১৫৫ তাড়া করে এক সময় স্কোর ১৩৫-৭। সেখান থেকে নায়ক উইকেটকিপার সমীর দিঘে (২২ ন.আ.)। দু’উইকেটে ম্যাচ জয়। সিরিজও।
চেন্নাই সেপ্টেম্বর ১৯৮৬
৮৭ ওভারে চাই ৩৪৮। আট বল বাকি থাকতে ভারত ৩৪৪-৯। শেষ ওভারে শাস্ত্রী ৩ রান নিয়ে স্কোর সমান করেন। তার পরেই মনিন্দর এলবিডব্লিউ। টেস্ট ইতিহাসে দ্বিতীয় টাই।
মেলবোর্ন ফেব্রুয়ারি ১৯৮১
অস্ট্রেলিয়ার লক্ষ্য ছিল ১৪৩। শেষ দিনে ১১৯, হাতে সাত উইকেট। কর্টিজেন ইঞ্জেকশন নিয়ে ২৮ রানে ৫ উইকেট তুলে জয় এনে দেন কপিল। |
|
|
ভারত প্রথম ইনিংস: ৪৯৯ |
অস্ট্রেলিয়া প্রথম ইনিংস: ৪০৮ |
অস্ট্রেলিয়া দ্বিতীয় ইনিংস (আগের দিন ৭৫-৩) |
হিউজ এলবিডব্লিউ অশ্বিন ৬৯
লিয়ঁ ক ধোনি বো প্রজ্ঞান ১৮
ক্লার্ক ক পূজারা বো জাডেজা ১৮
হাডিন এলবিডব্লিউ অশ্বিন ৩০
এনরিকে ক ও বো জাডেজা ২
সিডল বো প্রজ্ঞান ১৩
স্টার্ক ক অশ্বিন বো জাডেজা ৩৫
ডোহার্টি নঃআঃ ১৮
অতিরিক্ত ৫
মোট ২২৩
পতন: ২, ৩৫, ৫৫, ৮৯, ১১৯, ১২৩, ১২৬, ১৪৩, ১৭৯
বোলিং: ভুবনেশ্বর ১০-১-৩১-৩, ইশান্ত ৯-১-৩৪-০, অশ্বিন ৩১-৯-৭২-২
জাডেজা ১৬.২-৬-৩৫-৩, প্রজ্ঞান ২১-৬-৪৬-২, সচিন ২-০-২-০।
|
ভারত দ্বিতীয় ইনিংস |
বিজয় স্টাঃ হাডিন বো ডোহার্টি ২৬
পূজারা এলবিডব্লিউ লিয়ঁ ২৮
কোহলি ক হিউজ বো সিডল ৩৪
সচিন রান আউট ২১
ধোনি নঃআঃ ১৮
জাডেজা নঃআঃ ৮
অতিরিক্ত ১
মোট ১৩৬-৪
পতন: ৪২, ৭০, ১০৩, ১১৬
বোলিং: স্টার্ক ১০.৩-১-৫১-০, সিডল ১১-২-৩৪-১
লিয়ঁ ৫-০-২৭-১, ডোহার্টি ৭-২-২৪-১।
|
|
|
|
|
|
|
|