জেনিভায় রাষ্ট্রপুঞ্জের মানবাধিকার পরিষদে শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে আনীত মার্কিন নিন্দা-প্রস্তাবের উপর ভোটাভুটির লগ্ন যত আসন্ন হইতেছে, ততই এই প্রশ্নে ভারত-শ্রীলঙ্কার দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে উত্তেজনা বৃদ্ধি পাইতেছে। উত্তেজনার কেন্দ্রে রহিয়াছে তামিলনাড়ুতে শ্রীলঙ্কাবিরোধী তীব্র বিক্ষোভ। এলটিটিই-র সর্বাধিনায়ক প্রভাকরণের নাবালক পুত্রকে ঠান্ডা মাথায় এবং নিরস্ত্র অবস্থায় খুন করার ‘সচিত্র তথ্যপ্রমাণ’ তামিল ভাবাবেগকে আরও উস্কাইয়া তুলিয়াছে। এলটিটিই-বিরোধী সমরাভিযানের সময় ও তাহা শেষ হইবার পরও যে হাজার-হাজার অসামরিক, নিরস্ত্র তামিলকে শ্রীলঙ্কা সেনাবাহিনীর হাতে গণহত্যা ও গণধর্ষণের শিকার হইতে হয়, তাহার তদন্ত, বিচার এবং দোষীদের শাস্তির দাবিও ভারতীয় তামিল জনমানসকে উত্তেজিত করিতেছে। তামিল রাজনীতির দুই প্রধান নেতা করুণানিধি ও জয়ললিতা মানবাধিকার কমিশনের ভোটাভুটিতে ভারতের কঠোর ভূমিকা দাবি করিয়াছেন। করুণানিধি তো এই প্রশ্নে ইউপিএ সরকার হইতে সমর্থন প্রত্যাহারেরও হুমকি দিয়াছেন। আগামী বছরেই লোকসভার নির্বাচন, কেন্দ্রের জোট-সরকারের উপর চাপ সৃষ্টির ইহাই বড় মওকা।
প্রশ্ন হইল, ভারত কী করিবে? শ্রীলঙ্কায় তামিলদের মানবাধিকার লঙ্ঘিত হইয়া থাকিলে মানবিকতার খাতিরেই তাহার প্রতিবাদ করা উচিত, শ্রীলঙ্কা সরকারকেও উৎখাত তামিল পরিবারগুলির সম্মানজনক পুনর্বাসন, ত্রাণ, কর্মসংস্থানের বন্দোবস্ত এবং স্বায়ত্তশাসন মঞ্জুরে বাধ্য করিতে চাপ দেওয়া উচিত। এগুলি মানবতারই শর্ত, তামিল-তোষণের নয়। অর্থাৎ দেশের একটি অঙ্গরাজ্যের মানুষের ভাবাবেগের মর্যাদা দিবার জন্য জেনিভায় ভারতকে কড়া মনোভাব লইতে হইবে, এমন নয়। দ্বিপাক্ষিক, বহুপাক্ষিক বা আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভারতের জাতীয় স্বার্থ যাহা, বিদেশ মন্ত্রকের তাহাই সিদ্ধ করিতে সচেষ্ট হওয়া উচিত। তাহার ফলে ডিএমকে-র সমর্থন হারাইতে হইবে কি না, তাহা গৌণ প্রশ্ন। পাশাপাশি, শ্রীলঙ্কার শাসকদের বিরাগ উৎপাদনের আশঙ্কাও তুচ্ছ বা অপ্রাসঙ্গিক বলিয়া উড়াইয়া দেওয়া চলে না। ভারতের খিড়কি দরজার কাছে অবস্থিত হইলেও শ্রীলঙ্কা যে ক্রমশই ভারত হইতে দূরে সরিয়া যাইতেছে, এবং এই দূরত্ব যে চিনের সহিত তাহার নৈকট্য ও ঘনিষ্ঠতা নিবিড়তর করিতেছে, তাহাও অস্বীকার্য নয়। দক্ষিণ এশিয়ায় তাহার প্রধান প্রতিপক্ষ চিনের কোলে প্রতিবেশী শ্রীলঙ্কাকে ঠেলিয়া দেওয়া ভারতের পক্ষে কূটনৈতিক ভাবে কতটা বিচক্ষণ, সে প্রশ্নও আছে।
পরিস্থিতি জটিলতর হইয়াছে মানবাধিকার পরিষদের বৈঠকে ভারত ছিন্নমূল তামিলদের পুনর্বাসনের পরিকাঠামো নির্মাণে শ্রীলঙ্কার তৎপরতার প্রশংসা করায়। সেই সঙ্গে ভারত মানবাধিকার লঙ্ঘনের নির্দিষ্ট অভিযোগগুলির নিরপেক্ষ, বিশ্বাসযোগ্য ও দ্রুত তদন্ত সম্পন্ন করার উপরেও জোর দিয়াছে। ভারতীয় তামিল রাজনীতিকরা (বিশেষত যাঁহাদের তামিল খণ্ডজাতীয় ভাবাবেগকে পুঁজি করিয়া একের পর এক নির্বাচন লড়িতে হয়) স্বভাবতই ইহাতে সন্তুষ্ট নহেন। তাঁহারা মার্কিন নিন্দা-প্রস্তাবেরও অতিরিক্ত কিছু দাবি করিতেছেন। শ্রীলঙ্কা যে একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র, তাহার অভ্যম্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ যে সম্ভব নয়, এ কথা ভাইকো’র মতো অনেক নেতাই বুঝিতে অপারগ। তাঁহাদের বুঝাইতে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ তাঁহার মন্ত্রিসভার তিন বরিষ্ঠ সহকর্মীকে করুণানিধি সকাশে প্রেরণ করিতেছেন। ভারত সরকারের বাধ্যবাধকতার বিষয়টিও তাঁহাদের বুঝাইবার চেষ্টা হইবে। কূটনীতি কোনও জবরদস্তির ব্যাপার নয়, শান্তভাবে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট সকলের গ্রহণযোগ্য সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার শিল্প। করুণানিধিকে ইহা বুঝিতে হইবে। ভারতের পক্ষে সুবিধাজনক বাস্তব হইল, কমিশনের পরিষদে ভোটাভুটিতে এ বার চিন, রাশিয়া প্রভৃতি কলম্বো-সমর্থকরা যোগ দিতে পারিবে না, যেহেতু তাহারা এখন পরিষদের সদস্য নহে। কিন্তু কঠোর ও প্রকাশ্য নিন্দাবাদের পরিবর্তে যদি আলাপ-আলোচনার পথে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের শাসকদের তামিল স্বশাসনের প্রতি আগ্রহী করিয়া তোলা যায়, তবে সেই পন্থা অবলম্বন করাই শ্রেয়। |