বেলপাহাড়ির পর মহেশতলা। প্রশ্ন তুললে অসহিষ্ণুতার ‘ঐতিহ্য’ এখনও অটুট।
গত বছর বেলপাহাড়িতে মুখ্যমন্ত্রীর সভায় সারের দামবৃদ্ধি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন বিনপুরের শিলাদিত্য চৌধুরী। ‘মাওবাদী’ তকমা দিয়ে কৃষিজীবী ওই যুবককে গ্রেফতার করতে মঞ্চ থেকেই পুলিশকে নির্দেশ দিয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এ বার মহেশতলায় ‘দিদি’র খোঁজ নিতে গিয়ে রাজ্যের পুর ও নগরোন্নয়ন মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিমের (ববি) ‘রোষ’-এর মুখে পড়লেন জিঞ্জিরাবাজারের প্রতাপ নস্কর। মন্ত্রীর নির্দেশে তাঁকে ধরে ফেলেন কর্তব্যরত পুলিশকর্মীরা।
তবে রবিবার কার্যত ‘সেম-সাইড’ গোল দেন ববি হাকিম।
কারণ, পুলিশের হাত থেকে ছাড়া পেয়ে প্রতাপবাবুর দাবি, তিনি তৃণমূলেরই সমর্থক। নেতাকে নাগালে পেয়ে কৌতূহলেই দলীয় নেত্রীর খোঁজ নিতে গিয়েছিলেন। ভুল করে তাঁকে ‘বিরোধী শিবিরের’ লোক ভেবে নেন পুরমন্ত্রী। পরে সত্যিটা টের পাওয়ার পরই ছেড়ে দেওয়া হয় ওই যুবককে।
প্রতাপের কথা টিভি দেখে জানতে পারেন বিনপুরের বাসিন্দা শিলাদিত্য চৌধুরী। জঙ্গলমহলের এই যুবকের জিজ্ঞাসা, “প্রশ্ন করলে কেন আটক করা হবে? প্রতাপবাবু তো কোনও দোষ করেননি।”
কী ঘটেছিল এ দিন? |
গ্রেফতার হওয়ার পরে প্রতাপ নস্কর। (ডান দিকে) নিজের বাড়িতে শিলাদিত্য চৌধুরী। —নিজস্ব চিত্র |
দুপুরে আগুনে পুড়ে যাওয়া ষোলো বিঘা বস্তিতে গিয়েছিলেন রাজ্যের পুর ও নগরোন্নয়ন মন্ত্রী। এলাকার বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলছিলেন তিনি। আশ্বাস দিচ্ছিলেন সরকারি সাহায্যের। এই সময়ে ববির সামনে গিয়ে হলুদ শার্ট পরা প্রতাপবাবু জিজ্ঞাসা করেন, “মুখ্যমন্ত্রী কেন এলেন না?” আচমকা এই প্রশ্নে হকচকিয়ে যান পুরমন্ত্রীর আশপাশে থাকা সকলেই। ববি পাল্টা তাঁকে বলেন, “কে আপনি?” মন্ত্রীর পাশে দাঁড়ানো পুর-প্রতিনিধি রঞ্জিত শীল বলে ওঠেন, “এতো বাইরের লোক! মোল্লার
গেটে থাকে।” পুরমন্ত্রী ফের ওই যুবককে বলেন, “এখানে কেন এসেছ?” এর পরই কাছাকাছি থাকা পুলিশ-কর্তাদের তিনি বলেন, “একে এখান থেকে নিয়ে যান। কোথা থেকে, কেন এসেছে তা জিজ্ঞাসা করুন।” পুরমন্ত্রী বলেন, “অনেকেই বাইরে থেকে উস্কানি দিচ্ছে। এখানেও কেউ কেউ উস্কানি দিচ্ছিল। পুলিশকে ব্যাপারটা দেখতে বলেছি। ওই যুবকটি এখানে থাকেও না।”
মন্ত্রীর নির্দেশ পেয়েই প্রতাপবাবুকে প্রিজন-ভ্যানে তুলে দেয় পুলিশ। তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় মহেশতলা থানার জিঞ্জিরাবাজার তদন্ত কেন্দ্রে। মিনিট দশেকের জেরায় ওই যুবক পুলিশকে জানান, তিনি তৃণমূলেরই সমর্থক। বাড়ি মোল্লারগেটের সাপারায়পুরে। ববি হাকিম ওই বস্তিতে যাবেন শুনে তিনি সেখানে গিয়েছিলেন। নিছক কৌতূহলেই পুরমন্ত্রীর কাছে মুখ্যমন্ত্রীর বিষয়টি জানতে চান। এর পরই নাম-ঠিকানা লিখে নিয়ে প্রতাপবাবুকে ছেড়ে দেন তদন্তকারীরা।
ওই যুবক নিজেকে তৃণমূলকর্মী হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন শুনে ববি বলেন, “তৃণমূল কংগ্রেসের কর্মী কি না, তা আমি জানি না। তৃণমূল কর্মী হতেই পারেন। কিন্তু ওখানে বাইরের লোক আসবেই বা কেন! তৃণমূল কংগ্রেসের কর্মী হলে তাঁর আরও সচেতন হওয়া উচিত ছিল।’’
এ বিষয়ে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্য বলেন, “ওখানে আগুনের পিছনে প্রোমোটারদের হাত রয়েছে। তৃণমূলের নেতারাই প্রোমোটারদের মদত দিচ্ছেন। তা সত্ত্বেও মুখ্যমন্ত্রী কেন সেখানে যাননি, এটা জানতে চাওয়ায় এক যুবককে পুলিশ ধরল!”
পুলিশ ছেড়ে দেওয়ার পরে কী বলেছেন প্রতাপবাবু?
বিকেলে সাপারায়পুরের নিজের বাড়ির কাছের দোকানে বসে প্রতাপ বলেন, “আমার ভুল হয়ে গেছে। ববিদাও ঠিক বুঝতে পারেননি।”
কেন তিনি গিয়েছিলেন ওই বস্তিতে?
প্রতাপবাবুর জবাব, “আমাদের পার্টির মিটিং দেখতে গিয়েছিলাম। ওখানেই আমি বলি, এই ঘটনার পরে মুখ্যমন্ত্রী এখানে আসেননি কেন?
কিন্তু ববিদা ভুল করেছিলেন। তিনি আমাকে চিনতে পারেননি।” পরে প্রতাপবাবু বলেন, “ববিদার কথায় পুলিশ আমাকে ধরেছিল। দশ মিনিট থানায় আটকে রেখেছিল। ববিদাই আমাকে ছাড়িয়ে আনেন। এটা আমাদের নিজেদের মধ্যের ব্যাপার।” এ ঘটনায় হতভম্ভ প্রতাপবাবু ঠিক করেছেন, এমন ‘ভুল’ আর করবেন না। দলের প্রথম সারির নেতাকে প্রশ্ন তো একেবারেই নয়। তাঁর মন্তব্য, “আমিও তৃণমূল করি। আর এ রকম প্রশ্ন করব না।” গত বছর ৮ অগস্ট বেলপাহাড়িতে মুখ্যমন্ত্রীর সভায় সারের দাম নিয়ে প্রশ্ন করে জেলে গিয়েছিলেন শিলাদিত্য। ১০ অগস্ট পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করে। মুখ্যমন্ত্রীর সভা চলাকালীন ‘হাই সিকিউরিটি জোন’-এ অনধিকার প্রবেশের অভিযোগে পনেরো দিন জেল খাটতে হয়। মাওবাদী তকমা দেওয়া হয়েছিল তাঁকে। সেই স্মৃতি এখনও দগদগে। কাল, মঙ্গলবার বিনপুরে প্রশাসনিক জনসভা করবেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বাড়ি থেকে মাত্র দেড় কিলোমিটার দূরে সভাস্থল। তবে সেখানে যাবেন না বলেই আপাতত ঠিক করেছেন এই যুবক। শিলাদিত্যর কথায়, “পড়শিরা বলছেন, মঙ্গলবার সভায় যেতে। তবে মহেশতলায় প্রতাপ নস্করের ঘটনাটি জানার পর আর বিনপুরে সভায় যাওয়ার ভরসা পাচ্ছি না।”
|