একে রোমিও, তায় ভোটার!
জনতা-পুলিশ ঘোল খেয়ে গেল তাকে ধরতে!
শনিবার সকাল সাড়ে আটটা। সন্দেশখালির ধুচনেখালি বাজার। বাবাকে ডাক্তার দেখিয়ে বাড়ি ফিরছিল স্থানীয় স্কুলের সপ্তম শ্রেণির এক ছাত্রী। আচমকা ওই কিশোরীকে পিছন থেকে জাপটে ধরে বছর পঁচিশের এক যুবক। পরনে কালচে গেঞ্জি ও সাদা লুঙ্গি। মাথায় টুপি। হতবাক কিশোরী এবং তার বাবা প্রাথমিক ধাক্কা সামলে চিৎকার করতেই যুবকটি লুঙ্গির খুঁট থেকে বের করে ফেলে খয়াটে চাকু। হুমকি দিয়ে বলে, “এগাইলে কিন্তু চাকু চালিয়ে দেব!” কিন্তু তত ক্ষণে জড়ো হতে শুরু করেছে আশপাশের লোক। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে শ্রীমান সাঁৎ করে পাশের ধান খেতে নেমে দে দৌড়!
সামনে উঁচু-নিচু মাঠ-ঝোপ, এঁদো ডোবা। পিছনে ‘ধর ব্যাটাকে’ বলে দৌড়ে আসা শ-দেড়েক জনতা। সামনে একটা খেজুর গাছ পেয়ে তাতেই উঠে পড়ে রোমিও। বঁটির মতো ধারালো খেজুর কাঁটা সামলে ক্রমশ উপরে উঠে যেতে থাকে। জনতা বেকুব বনে গাছটা ঘিরে নীচেই দাঁড়িয়ে থাকে। প্রত্যক্ষদর্শী নিরঞ্জন দাস ও বিশ্বজিৎ দলুইয়েরা পরে বলছিলেন, বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে খেজুর গাছের তলায় ভিড় বাড়ছিল। |
কিন্তু কী করা যায়? রোমিও তখন গাছের উপর থেকেই ফের হুমকি দিচ্ছে, “এগাইলে কিন্তু চাকু চালিয়ে দেব!” জনতার মধ্যে থেকে কেউ কেউ তাকে লক্ষ করে ঢিল ছুড়তে থাকে। কিন্তু ওই ঢ্যাঙা খেজুর গাছে চড়া অবস্থাতেই, কাঁটার খোঁচা খেতেও খেতেও রোমিও-র রিফ্লেক্সের কমতি নেই! তার দিকে ধেয়ে আসা ঢিলগুলোই কপ করে লুফে নিয়ে পাল্টা ছুড়ে মারতে থাকে সে! রোদ চড়ে, মেজাজ-ও। ক্ষিপ্ত জনতা ঠিক করে ফেলে, অনেক হয়েছে! গাছটাই কেটে ফেলা যাক!
সব্বোনাশ! প্রমাদ গোনেন জনৈক গোপাল সিংহ! ভদ্রলোক গাছটির মালিক! ছিঁচকে রোমিও-র কল্যাণে তাঁর সাধের গাছটি যায় বুঝি! এত ক্ষণ তিনি নিজেও ওই ভিড়ের মধ্যেই ছিলেন! গাছ কাটার কথা শুনতে পেয়েই হাঁইহাঁই করে উঠলেন!
যুক্তি-তক্কো চলতে চলতে এ বার নিঁখুত টিপে গোপালবাবুর মাথাতেই এসে পড়ল একটি ঢিল। ব্রহ্মতালু ঝনঝন করে উঠল! তারই মধ্যে ভাগ্যিস কেউ এক জন ছুটে গিয়ে থানায় খবর দিয়েছিল। হাঁফাতে হাঁফাতে এ বার দুই খাকি উর্দির গাছতলায় আগমন! আর এসেই চক্ষু চড়ক (থুড়ি, খেজুর) গাছ! ‘‘আরে! এ তো ভোটার সিংহ!’’
ভোটার মানে, পুলিশের খাতায় পুরনো পাপী! একাধিক বার মহিলাদের উত্যক্ত করার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। গ্রামে সালিশি সভাও বসেছিল। বাবা পটল সিংহের কাকুতি-মিনতিতে ছাড়া পেলেও বছরখানেক আগে জেল খেটে ফিরেছে ভোটার। একে একে ঘটনাস্থলে চলে আসেন সন্দেশখালি থানার ওসি পলাশ চট্টোপাধ্যায়, স্থানীয় পঞ্চায়েত সমিতির প্রধান থেকে সব দলের নেতারাই। এসে পড়েন ভোটারের বাবা পটলবাবুও। জনে জনে ক্ষমা চেয়ে নেন ছেলের হয়ে। গাছের উপর থেকে ভোটার তখনও তড়পে যাচ্ছে, “বাবা ওদের হটতে বলো। এগাইলে কিন্তু চাকু চালিয়ে দেব...।”
তবে হ্যাঁ, গলার তেজ কমে এসেছে। ভোটার ক্রমশ ক্লান্ত হচ্ছে। উপস্থিত পুলিশ কর্তারা বারবার বলছেন, “আপনি নেমে আসুন। আপনাকে কেউ মারধর করবে না।” বড়বাবু সবাইকে সরানোর চেষ্টা করেন। ভিড়টা ইতস্তত হালকা হতে থাকে। এক পা-এক পা করে নামতে শুরু করে ভোটার। কিন্তু সিনেমার ভিলেনের মতোই শেষ চমক তখনও বাকি! গাছ থেকে নামতে নামতেই ঝপাং করে পাশের ডোবায় লাফ মারে ভোটার। তার সারা গায়ে তখন সজারুর মতো খেজুর-কাঁটা! কাঁটার ভয়েই তার দিকে এগোনো ভার! অনেক অনুরোধ-উপরোধের পর নিজেকে কণ্টকমুক্ত করে ভোটার সিংহ জল থেকে উঠলেন। পুলিশি আশ্বাস সত্ত্বেও জনতার চড়-থাপ্পড়ও দু-একটা পড়ল না, তা নয়। বেলা তখন প্রায় সাড়ে বারোটা। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার আগেই ‘ভিআইপি’ ভোটারকে গাড়িতে তুলে থানার পথ ধরল পুলিশ। |