|
|
|
|
|
ম্যায় হুঁ না, ধবনের ধামাকায় বাক্যিহারা কপিলও গৌতম ভট্টাচার্য • মোহালি |
|
নভজ্যোৎ সিংহ সিধু ক্রমাগত বলে যাচ্ছেন, “গত পাঁচ বছর যা করিনি, এ বার সেটাই করতে যাচ্ছি! সেঞ্চুরিটা হলেই টিভি বক্স থেকে বাইরে এসে হাততালি দেব।” কমেন্ট্রি বক্সের বাকিরা সর্দারের সঙ্গে দ্রুত একমত হয়ে যাচ্ছেন: সত্যি, এই ইনিংসের জন্য করাই যায়। তা বলে কপিল দেব এত অভিভূত হয়ে পড়েছেন কেউ বোঝেনি। শিখর ধবন চলতি সিরিজের সবচেয়ে রোমাঞ্চকর সেঞ্চুরিটা ৮৫ বলে করে ফেলা মাত্র কমেন্ট্রি করতে করতেই লাফিয়ে উঠে পড়লেন কপিল। গত একাশি বছরের ইতিহাসে অভ্যুদয়ে কোনও ভারতীয় ওপেনার আজ পর্যন্ত টেস্ট সেঞ্চুরি পায়নি বলে মোহালি চমকপ্রদ রেকর্ড প্রত্যক্ষ করল। একই সঙ্গে গড়াগড়ি খেল একটা বিশ্বরেকর্ড। টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে আবির্ভাবে এত দ্রুত সেঞ্চুরি কেউ করেনি।
কিন্তু এটাও তো বোধহয় বিশ্বে প্রথম বারের জন্য ঘটল, এক ধরনের বিশ্বরেকর্ডই, যে মাইক্রোফোন ছেড়ে দিয়ে ভাষ্যকার উঠে পড়েছেন। দু’মিনিটেরও বেশি দাঁড়িয়ে হাত
তালি দিচ্ছেন কপিল। সহভাষ্যকার তখন বুঝে উঠতে পারছেন না তিনি
কী করবেন। প্রযোজক উদ্বিগ্ন
ভাবে তাকিয়ে। পরে বোঝা গেল এমনই মাহাত্ম্য শিখরে ওঠা এই ইনিংসের যে টিভি ধারাবিবরণীর জগতেও এক অমর মুহূর্তের স্বতঃস্ফূর্ত জন্ম দিয়ে গেল!
রাত্তির সাড়ে আটটা নাগাদ ম্যাচ রিপোর্ট লিখতে বসার খানিক আগেও নির্বাচক, প্রাক্তন ক্রিকেটার, এজেন্ট, টিম ইন্ডিয়া প্লেয়ারনানা শ্রেণির সঙ্গে কথা বলে দেখছি, যেন হোলিতে সিদ্ধি খেয়ে ওঠার পরবর্তী অধ্যায়! সবাই কেমন ঘোরের মধ্যে। কারও যেন বিশ্লেষণী ক্ষমতা কাজ করছে না। টেস্ট ক্রিকেটে প্রথম নেমে কেউ এই ভঙ্গিতে ১৬৮ বলে অপরাজিত ১৮৫ করতে পারে নাকি! আবার যার ১৪৪ রান কেবল চার-ছয়ে! এ তো হোলির আগেই ব্যাটে হোলি! |
শিখরে
|
অভিষেক ম্যাচেই শত রান করার পরে উচ্ছ্বসিত শিখর ধবন। শনিবার মোহালিতে। |
অদ্ভুত একটা হাঁটাচলার ভঙ্গি শিখরের। পাড়ার দাদা টাইপ। কী বললি, ব্যানার্জিদের ফ্ল্যাটে চাঁদা দিচ্ছে না, চল তো দেখে আসি! শরীরটাও অসম্ভব পেটানো। বহু দিন সিক্স প্যাক আছে। ফিটনেস এত ভাল যে সারা দিন রোদ্দুরে মাঠে দাঁড়িয়ে আর নট আউট অবস্থাতেও অবলীলায় লম্বা সাংবাদিক সম্মেলন করতে পারেন। তাঁর পুরো ব্যাপারটারই যেন কোনও পূর্বেকার ভারতীয় ক্রিকেটে প্রোটোটাইপ নেই। পঞ্জাবি যুবা, এক কালে পার্টি অ্যানিম্যাল ছিলেন। গত অগস্টে অস্ট্রেলিয়াবাসী বাঙালি কন্যেকে বিয়ের পর শোনা যায় জীবনে স্থিরতা এসেছে। শিখর-পত্নী আয়েষা মুখোপাধ্যায় থাকেন মেলবোর্নে। সেখানে বসে ইন্টারনেটে এ দিন স্বামীর ইনিংস দেখেছেন। দু’জনের আলাপ নাকি ফেসবুকে। ছবি দেখে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছিলেন শিখর। সেখান থেকে দ্রুত আলাপ। দ্রুত বিয়ের সিদ্ধান্ত।
এ সব শুনেটুনে যদি মনে হয় সফিস্টিকেটেড জেনারেশন ওয়াই ক্রিকেটার। একেবারেই ঠিক ভাবা হবে না। বরং তাঁকে দুই-তৃতীয়াংশ প্রশ্ন হল হিন্দিতে। জিজ্ঞেস করা হল, কী বলা হবে ইনিংসের গঠনকে? রাউডি রাঠোর? না ম্যায় হুঁ না? হাসতে হাসতে বললেন, “ম্যায় হুঁ না।” মনে করতে পারছি না আজ অবধি কোনও ভারতীয় ক্রিকেটারকে হাতেগরম নিজের ব্যাটিং কীর্তির সঙ্গে বলিউডি ছবির তুলনা করতে বলা হয়েছে বলে।
বাংলা কথা, চেতেশ্বর পূজারা যদি থিয়েটার রোডের অরবিন্দ আশ্রম হন। তা হলে শিখর ধবন হলেন অফিস টাইমে ডেকার্স লেনের চিৎকার সমন্বিত ঘুঘনির দোকান। জোরালো, নির্বিকার, বুক চিতিয়ে আগুয়ান, লাউড হতে চেয়ে লাউড। আর হ্যাঁ, অফসাইড ড্রাইভিং অনবদ্য। অরুণলাল বলছিলেন, “ম্যাজিক শো দেখলাম মনে হচ্ছে। মাথাটা আর একটু ছাড়লে ভাবার চেষ্টা করব, আইপিএল খেলে খেলেই এখনকার ভারতীয় তরুণরা এমন ভয়ডরহীন মনোভাব আয়ত্ত করে ফেলেছে কি না?”
মনে হচ্ছে না তাতেও শনিবার বারবেলা থেকে উদ্ভুত একগাদা রেকর্ডখচিত ব্যাটিং হোলিকে ব্যাখ্যা করা সম্ভব। অস্ট্রেলিয়ার দ্রুততম উইকেটে ভারত গিয়ে পড়লে যেমন মনে হয়, দু’টো টিম যেখানে পরস্পরের সঙ্গে এক সরণিতেই পড়ে না। তাদের মুখোমুখি দাঁড়াবার দরকার কী। এখানে অস্ট্রেলিয়া সিরিজে তাদের সর্বোচ্চ রান তোলার পরেও একই অনুভূতি তৈরি হচ্ছে!
গোটা অস্ট্রেলিয়া টিম প্যাভিলিয়নে ফেরার সময় দাঁড়িয়ে হাততালি দিচ্ছে। ম্যাথু হেডেন বলছেন, “বাপ রে বাপ এ তো আমাদের সময় ফিরে এসেছে মনে হচ্ছে।” অস্ট্রেলীয় সাংবাদিক অ্যালান বর্ডারকে বলছেন, “দেখুন না এই সব রিপোর্টাররা দাবি করছে কৃতিত্ব নাকি নববিবাহিত বাঙালি মেয়ের। আমি বলছি সব কৃতিত্ব অস্ট্রেলিয়ান কন্যার। শিখরও অস্ট্রেলিয়ান।” বর্ডার হাসলেন, “ঠিক তাই।”
টুকরো-টাকরা এ সব চিত্রকল্পগুলোকে জুড়লেই উইকএন্ডের স্তম্ভিত করে দেওয়া শিখর ধবন ভেসে উঠবেন। প্রথম টেস্টে আবির্ভাব কী, মনেই হচ্ছিল না টেস্ট ম্যাচ চলছে বলে। সাদা ড্রেসে যেন ডেকানের হয়ে আইপিএল ইনিংস খেলছেন শিখর। তাঁর যখন সেঞ্চুরি হয়ে গেল, সঙ্গী মুরলী বিজয় কিনা ৩৮। গত বছরের ১৬ মার্চ বিশ্ব ক্রিকেটের ক্যালেন্ডারে উঠে রয়েছে ব্যক্তিগত শততম সেঞ্চুরির অনন্য কৃতিত্বের জন্য। সেটা হয়তো চাঁদে মানুষ পা রাখার সমতুল্য ক্রিকেটীয় কীর্তি। কিন্তু তেন্ডুলকরের প্রথম বার্ষিকীর উদ্যাপনই বা মন্দ কী কাটল এক মায়াবি বিভ্রমের মধ্যে!
সন্দেহাতীত ভাবে শিখরের ইনিংস ব্যাটসম্যানশিপের সর্বোচ্চ পরীক্ষা নেয়নি। ক্লার্কের অস্ট্রেলিয়া এমনিতেই মুম্বই ক্রিকেটের শব্দচয়ন অনুযায়ী ‘পোপটওয়াড়ি’ বোলিং আক্রমণ নিয়ে এসেছে। ভাবানুবাদ হবে কাঙ্গা লিগ অ্যাটাক।
|
সাইক্লোনের নাম শিখর |
|
|
স্ট্রোকের ফুলঝুরিতে খড়কুটোর মতো উড়ে গেল অস্ট্রেলিয়া। |
|
|
প্যাটিনসন সাসপেন্ড হয়ে থাকায় সেটা হয়তো আরও কাঙ্গা লিগ বি ডিভিশন। তার ওপর সিমেন্টের মতো সারফেস। চণ্ডীগড় থেকে মোহালি আসার রাস্তায় একটা চার মাথার মোড় পরে। যেখানে একটা দিক রোজ দেখি সকালে মানুষে ভর্তি। মোড়টার নাম লেবার চক। এখানে প্রান্তিক সব এলাকা থেকে শ’য়ে-শ’য়ে মানুষজন সাতসকালে ভিড় করেন। সবাই শ্রমিক। কনস্ট্রাকশন সাইটে কাজ করার জন্য প্রতি দিন এসে নাম লেখান। কনট্রাক্টররা এসে তাদের এখান থেকে নিয়ে যান। তা থার্ড ডে-তে দু’টো টিম ব্যাট করার সময়ই মোহালি পিচের যেমন হালচাল দেখা গেল, তাতে কিছু শ্রমিক নিয়ে এলে হত! মোহালি উইকেট আর আশেপাশে দিব্যি একটা ছোট বাড়ি তুলে দেওয়া যেতএটা ভবিষ্যতে শিখরের ইনিংসকে চূড়ো থেকে খানিকটা নামাবে।
অনেকের টেস্ট ম্যাচ শেষ হতে না হতে এটাও মনে পড়ে যাবে যে তাঁর শতকরা আশি ভাগ শটই খেলা ফ্রন্টফুটে। বলের লাইনে ধাম করে ডান পা বসিয়ে পাশবিক ড্রাইভ। বা বাউন্সারে পুল। ইনিংসের মুগ্ধতা কাটার পরেই দিল্লিওয়ালাদের কাছে লোকে জানতে চাইবে ভাই, ছেলেটার ব্যাকফুট কেমন? দক্ষিণ আফ্রিকার মাঠে ফ্রন্টফুট ততটাই কাজ করবে যতটা কাজ করে ভারতীয় সরকারি ব্যাঙ্কের এটিএম কার্ড দিয়ে সাউথ আফ্রিকান এটিএম থেকে র্যান্ড বার করার চেষ্টা! ওখানে ব্যাকফুটই ব্যাটসম্যানের ক্রেডিট কার্ড ব্যালেন্স।
রোববার অনিবার্য দেখাতে থাকা ডাবল সেঞ্চুরি এলেও স্থানীয় এটিএম? না ইন্টারন্যাশনাল ক্রেডিট কার্ড? কোনটা শিখর ধবনের এখনও ব্যাট স্পনসর না পাওয়া চার পাউন্ডের ভারি ব্যাটটায় আছে সেই প্রশ্নের জবাব পাওয়া যাবে না।
তা বলে ভারতীয় ক্রিকেট ইতিহাসে ইনিংসটা অমর হয়েই থেকে গেল। এত দ্রুত এবং এমন অনায়াসে ওপেনিং পার্টনারশিপকে চূড়োর দিকে নিয়ে যাচ্ছেন শিখর যে ১২৫ রানে এগিয়ে থেকেও যথেষ্ট আতঙ্কিত ক্লার্কের অস্ট্রেলিয়া। এই গতিতে রোববার রান ওঠা চললে তো চার দিনে কমে আসা ম্যাচেও হারের ছায়া নেমে আসতে পারে। অজিরা যদি ড্র-ও করতে পারে সিরিজ তো এখানেই খুইয়ে গেল! জেতার স্বপ্নটা ধুয়ে গেছে ব্যাটিং হোলিতে রাঙিয়ে গিয়ে।
অবশ্য অস্ট্রেলিয়া বেশি চাপে পড়ল? না সহবাগ-গম্ভীররা বেশি চাপের লক্ষ্যবস্তু হয়ে গেলেন তা নিয়ে দেখছি মতদ্বৈধ রয়েছে। সহবাগ-গম্ভীরদের জন্য দিল্লি টিমে জায়গা পেতেন না শিখর। তার পর প্রচুর পরিশ্রমে যখন সেটা সম্ভব করলেন। তার পর টেস্ট টিমে তাঁর সামনে কোলাপসিবল গেটের মতো দাঁড়িয়ে যান ফের দুই দিল্লিবাসী। সাত বছর প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট খেলার পর তবে টেস্টের দরজা খেলাতে পেরেছেন। তা-ও কিনা অজিদের বিরুদ্ধে। ওয়ান ডে আবির্ভাবে যাদের বিরুদ্ধে তাঁর ইন্ডিয়া ক্যাপ এনে দিয়েছিল শূন্য রান। তা-ও আজ চারশো তাড়া করে ক্ষুধার্ত অজি বোলারদের সামনে পড়া। তাদের স্ট্যান্ডার্ড যতই খারাপ হোক, প্রবল ভাবে এখানে শেষ সুযোগটা নিতে চাইছে তো। আফটার অল ব্যাগি গ্রিন পরে এরা নামে।
তাদের এমন অচঞ্চল পাওয়ার হিটিংয়ে আছড়ে ফেলা! ক্রিকেটীয় ব্যাখ্যাতেই আসছে না। এ তো একশো বত্রিশ বছর আগে ঠিক আজকের দিনে যিনি জন্মেছিলেন সেই পরশুরাম ছদ্মনামধারী লেখকের বিখ্যাত চরিত্র হয়ে গেল। কেরানি থেকে যার জীবন ক্রমশ বদলে যেতে লাগল সেই পরেশ দত্ত। কারণ সে পরশপাথর কুড়িয়ে পেয়ে ছিল।
এক দুপুরে শিখরের বিশ্বমঞ্চে উত্থান কি কাকতালীয় ভাবে কুড়িয়ে পাওয়া পরশপাথর? নাকি শরীরের সিক্স প্যাকের মতোই অর্জন করা মাণিক্য যা থাকার জন্য এসেছে? আন্তর্জাতিক ক্রিকেট বিশ্ব কাল থেকে প্রকল্পটার সমাধানে হাত দিতে বসবে!
|
ছবি: উৎপল সরকার।
|
অস্ট্রেলিয়া
প্রথম ইনিংস
(আগের দিন ২৭৩-৭) |
স্মিথ স্টাঃ ধোনি বো প্রজ্ঞান ৯২
স্টার্ক ক ধোনি বো ইশান্ত ৯৯
লিয়ঁ ন.আ. ৯
ডোহার্টি এলবিডব্লিউ অশ্বিন ৫ অতিরিক্ত ২৩ মোট ৪০৮। পতন:১৩৯, ১৩৯, ১৫১, ১৯৮, ২৪৪, ২৪৪, ২৫১, ৩৪৮, ৩৯৯।
বোলিং: ভুবনেশ্বর ৯-০-৪৪-০, ইশান্ত ৩০-৮-৭২-৩, অশ্বিন ৪৩.৫-৯-৯৭-২
প্রজ্ঞান ২৮-৫-৯৮-২, জাডেজা ৩১-৭-৭৭-৩। |
ভারত প্রথম ইনিংস
|
মুরলী ব্যাটিং ৮৩
ধবন ব্যাটিং ১৮৫
অতিরিক্ত ১৫
মোট ২৮৩-০।
বোলিং: স্টার্ক ১১-১-৪৬-০, সিডল ১২-৩-৩৫-০, এনরিকে ৭-০-৩৮-০
লিয়ঁ ১৫-৩-৬৯-০, ডোহার্টি ১০-২-৫৭-০, স্মিথ ৩-০-২৪-০। |
|
|
|
|
|
|
|