পুস্তক পরিচয় ...
নিরন্তর আত্ম-আবিষ্কারে সচেষ্ট
গণেশ পাইন/ ছবিতে কথায়, অঞ্জন সেন। চর্চাপদ, ২৫০.০০
ণেশ পাইন সম্পর্কে লিখতে বসে অঞ্জন সেনের গণেশ পাইন, ছবিতে কথায় বইটি হাতে এল। বইটিতে নানা প্রসঙ্গে শিল্পী শিল্পচেতনায় মিথ এবং লোককথার মধ্যে তাঁর নানা ভাবনার কথা বলেছেন। এখানে অঞ্জন সেন নানা ভাবে শিল্পী গণেশ পাইনকে বিশ্লেষণ করতে চেষ্টা করেছেন এবং তাঁর শিল্প-মানসিকতাকে গভীর ভাবে অনুধাবন করেছেন। কারণ শিল্পীর সঙ্গে অঞ্জন সেনের খুব অন্তরঙ্গ যোগাযোগ ছিল। ফলে শিল্পীকে জানার পক্ষে বইটির ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।
বইটির প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে আমি নিজের চিন্তাকে কিছুটা প্রশ্রয় দিয়ে ফেলেছি। গণেশের কাজের মধ্যে যে আত্মজৈবনিকতার স্ফুরণ তা এক দার্শনিক আধারে ধৃত। নান্দনিকতাকে তিনি যে ভাবে ধরেছেন, যে ভাবে গভীর মননশীলতার মধ্যে তাঁর নিজস্ব একটা পরিমণ্ডল গড়ে তুলেছেন তা হয়তো তাঁর বিষাদাচ্ছন্ন মনের প্রকাশ। তাঁর কাজে চিত্রগত রীতি-প্রকরণ খুবই আত্মগত এবং সংযত।
নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্যে দীর্ঘকাল নিজেকে আবিষ্কার করতে তিনি বেশ সচেতন ছিলেন। তাঁর কাজ তাৎক্ষণিকতার ফসল নয়, তা গভীর মনন এবং গবেষণাজাত। বিভিন্ন পর্যায়ে তিনি নানা ভাবে রেখা এবং বর্ণের মধ্যে একটা সমন্বয় ঘটাতে সচেষ্ট ছিলেন। তাঁর কাজের মধ্যে যে নীরবতার আবরণ তা আমাদের ভাবিত করে, আপ্লুত করে।
চিত্রগত বিন্যাসের ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে কিউবিজম এবং আরও কিছু পাশ্চাত্য রীতি-ভাবনা তাঁর মধ্যে কাজ করলেও এ দেশীয় নানা শিল্পরীতি সম্বন্ধেও তিনি যে বেশ সচেতন ছিলেন তাতে সন্দেহ নেই। তাঁর শিল্পশিক্ষার প্রথম দিকে বেঙ্গল স্কুলের যেমন প্রভাব পাওয়া যায় তেমনই বিভিন্ন পর্যায়ে গভীর আত্মসমীক্ষার মধ্যে তিনি নিজেকে আবিষ্কার করতে প্রয়াসী ছিলেন। নিজের কথায় তিনি যে সব বিষয়ে কিছু বলেন বা শিল্পকলা সম্বন্ধে যখন তাঁর ধ্যানধারণার কথা বলেন তখন তাঁর মধ্যে এক গভীর মগ্নতা থাকে। গণেশের কাজের মধ্যে এক বিপন্নতাবোধ কাজ করে, যার রহস্য ভেদ করলে আলোর সরণিতে উত্তরণ ঘটে দর্শকদের।
অনেক ক্ষেত্রেই তাঁর কাজের মধ্যে এক বৈষ্ণবীয় ভাবনার ইঙ্গিত আছে। বলা যায় তা এত আত্মগত যে মানুষ গণেশের জীবনাচরণের মধ্যে তা অধরা নয়। আমরা সাধারণত জীবনাচরণে বাইরের যে সংকটাপন্নতা দেখি বা বোধ করি, তা প্রকাশ করি আমাদের নিজস্ব বিপন্নতা ঘিরে। ফলে অধিকাংশ শিল্পী যাঁরা প্রায় আমাদের সমকালীন তাঁদের কাজে রাগ, ক্ষোভ, আনন্দ, বেদনা খুব অস্পষ্ট থাকে না যা সরাসরি দর্শকচিত্তে সহজেই ধরা দেয়। এখানে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মধ্যে এক ধরনের তাৎক্ষণিকতা কাজ করে যা মনের গভীরে সহজে প্রবেশ করতে পারে না। কিন্তু তাঁর সমসময়ে যে সব ঘটনা এবং দেশজ নানা সমস্যা দেখা দিয়েছিল, তা তাঁর শিল্পচেতনায় এক গভীর আত্মমগ্নতাকে আশ্রয় করে গড়ে ওঠে। তাঁর এই গভীর বিষণ্ণ বেদনাবোধ দর্শকমনে গভীর ভাবে কাজ করে। তাঁর চিত্রময়তায় উদ্দাম উচ্ছ্বাস অনুভূত হয় না। গণেশ সমকালকে নিজস্ব বোধ দিয়ে আবিষ্কারে সচেষ্ট ছিলেন।
এক পরিশীলিত মনের অধিকারী ছিলেন গণেশ যা তাঁকে বাইরের দিক থেকে কোনও উচ্ছ্বাসে নিমগ্ন হতে দিত না। তাঁর মননে আদিমতা এবং লৌকিক পরিমণ্ডলের ছাপ অস্পষ্ট নয়। তাঁর কাজে যে আলো-আঁধারের খেলা চলে তা বর্ণাশ্রিত হলেও রেখার গতিপ্রকৃতিকে তিনি এমন ভাবে বিন্যস্ত করেছেন যা আমাদের আকর্ষণ করে। তাঁর মননের দীপ্তিময়তা বিষণ্ণতাকে ছাপিয়ে অন্য এক মগ্নতায় আক্রান্ত করে, আমাদের উজ্জীবিত করে সৃষ্টির আলোকে।
গণেশের শিল্পমানসে মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যের ভাবনাচিন্তার উপস্থিতি অপ্রত্যক্ষ নয় যা জানা প্রয়োজন এ কারণে যে তাঁর মানসগঠনে যে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া, যেখানে শুধু যে কিছু ভারতীয় তথা বিদেশি ধ্যানধারণা তাঁর শিল্পলোককে প্রভাবিত করেছে এমন নয়, বেশ কিছু লৌকিক এবং উপকথার আত্মিক সম্পর্ক স্পষ্ট বোঝা যায়। তাঁর কাজের মধ্যে যে ছায়াপাতই ঘটুক না কেন, আসলে নিজস্ব নিঃসঙ্গ এক দার্শনিকের ভাবনায় উদ্ভাসিত তাঁর শিল্পসম্ভার।
অনেকের কাছে শুনেছি তাঁর আদি বাড়ির পরিবেশের মধ্যে যে প্রাচীনতা, স্তব্ধতা, আধা-আচ্ছন্নতা এবং পারিবারিক জীবনচেতনা তা সামগ্রিক ভাবে বাল্যকাল থেকেই তাঁর মানসিকতাকে অন্য এক ভাবনায় গড়ে তুলেছিল। অন্ধকারের মধ্যেই আলোর সন্ধান করতে হয়েছে তাঁকে। এই সন্ধান-রহস্যের মধ্যে অন্য এক দার্শনিকতা দেখতে পাই।
একটা সময়ে ওঁর সঙ্গে ব্যক্তিগত ভাবে আমার বেশ যোগাযোগ ছিল। দেখেছি ব্যক্তিমানুষ গণেশ কখনওই সরব ছিলেন না, মৃদুভাষী, তৎসত্ত্বেও বক্তব্যে সরাসরি নিজের জানা কথা স্পষ্ট ভাবে বলতে অভ্যস্ত ছিলেন।
যে ভাবেই দেখি না কেন, তাঁর শিল্পকলার গঠনে, মননে যে পারিপাট্য তা সময়ের নিরিখে কথা বলে। শুধু দৈর্ঘ্যপ্রস্থের স্বল্পপরিসরে তাঁর বিষয়ভাবনাকে আবদ্ধ রাখেননি। সময়কে তিনি বিশেষ মান্যতা দিয়ে, বোধ দিয়ে বিচারবিশ্লেষণ করেছেন। বর্ণলেপন এবং রেখার মায়াজালের খেলায় তিনি নিরন্তর নিজেকে আবিষ্কারে সচেতন, সচেষ্ট ছিলেন।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.