|
|
|
|
|
|
|
পুস্তক পরিচয় ১... |
|
‘ছবি আঁকতেই ভালো লাগে’
|
সুনীল দাস |
শিল্পচিন্তা, গণেশ পাইন। আনন্দ, ৭৫০.০০ |
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর নিজের শিল্পসৃষ্টি নিয়ে বিশেষ কিছু লেখেননি। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন লেখক তখন শিল্পদর্শনের অনুপম এক ব্যাখ্যাকার, নিজের আঁকা ছবির পট-উন্মোচক নন। নন্দলাল বসুও নিজের ছবির প্রেক্ষিত, প্রেরণাকে মেলে ধরেননি সাহিত্যের ভাষায়। শিল্পের ইতিহাসে, কী ভারত কী বিশ্ব, শিল্পীরা কথা বলেন মূলত তাঁদের শিল্পের ভাষাতেই। সেটাই স্বাভাবিক, কারণ কথা দিয়ে সেই অন্তরালের রসায়নের কথা আর কতটা বলা যায়?
সদ্য-প্রয়াত গণেশ পাইনের শিল্পচিন্তা নামে একটি বই আমরা পড়তে পেয়েছি। ‘দেশ’ পত্রিকায় ‘শিল্পভাবনা’ নামে এ বইয়ের চিঠিগুলি প্রকাশিত হত। গণেশ পাইনের শিল্পচিন্তা এ বই, সুতরাং আশা করতেই পারি তাঁর নিজস্ব নন্দনদৃষ্টি, ঐতিহাসিক বীক্ষণ এ বইয়ের পাতায় পাতায় ছড়ানো থাকবে। ভারতশিল্পে ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন তিনি, তাই প্রত্যাশাটা আরও বেশি ছিল।
কিন্তু এ বই তো নিজের শিল্পচিন্তা প্রকাশ করবেন বলে লেখেননি গণেশ পাইন, বস্তুত বই লিখবেন বলেই লেখেননি। প্রায় সমবয়সী এক প্রবাসী অনুরাগী অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত ১৯৭৫-এ জার্মানি থেকে গণেশ পাইনকে একটি অনুসন্ধিৎসু পত্র লেখেন। সেই সূত্রে পরবর্তী কুড়ি বছরে গণেশের লেখা ৬২টি জবাবি পত্র নিয়ে তৈরি হয়েছে এ বই। চিঠিগুলি চিঠিই, বহু কেজো কথায় ভরা। সেটাই তো স্বাভাবিক। শিল্পী চিঠি লিখলেই সেটা শিল্পচিন্তায় ঠাসা হবে এমন কথা তো নেই। চিঠি তো ব্যক্তিগত বিনিময়, আর সেই ব্যক্তিগত থেকে মানুষটি সম্পর্কে একটা ধারণা হয়তো হয়, কিন্তু তাঁর শিল্পচিন্তা বুঝতে গেলে তাঁর ছবিই ভরসা। সেই ছবি, ওই চিঠিতেই এঁকে দেওয়া অনেক ড্রইং, কখনও পেন্টিংও এ বইয়ের একমাত্র দর্শনীয়। গণেশ সেখানেই, তাঁর নিজস্ব ভাষায়, অর্থাৎ শিল্পের ভাষায় যা বচনীয় এবং অনির্বচনীয় তা প্রকাশ করেছেন। সেটাই আমাদের লাভ। অসামান্য অঙ্গসজ্জায় সেই প্রকাশ সংগ্রহযোগ্য হয়ে উঠেছে, কম লাভ নয় এটাও।
শিল্পচিন্তা এ বইয়ে বিশেষ নেই। যেটুকু আছে তা-ও খুব নতুন কিছু নয়। যেখানে সেই পুরনো নিয়ে তর্ক জমে ওঠার সম্ভাবনা ছিল সেখানেও অচিন্ত্যকুমারের মূল চিঠিটি পড়তে না পাওয়ায় সেটি সমূলে বিনষ্ট হয়েছে। ৩৩ সংখ্যক চিঠিটি পড়ি, ‘শিল্পের সংজ্ঞা আর প্রক্রিয়া নিয়ে যা লিখেছো তা তোমার উপলব্ধ সত্য। তাত্ত্বিকেরা কী ফরমান দেবেন জানি না। মানুষী চেতনা প্রকৃতির অংশভূত, তা সত্ত্বেও এই চেতনা নিজেকে এবং প্রকৃতিকে জয় করার যুগপৎ চেষ্টায় ব্যাপৃত। শিল্পী মন আর সৃষ্টিপ্রক্রিয়ার ব্যাখ্যা করতে গিয়ে এই কথাটা তুমি চমৎকার ভাবে ধরিয়ে দিয়েছো। ঘরে বাইরের এই লড়াই শিল্পের ক্ষেত্রে নন্দনতত্ত্বের সত্তা অতিক্রম করে না বলেই সংঘর্ষ সমন্বয়ে রূপান্তরিত হয়, তোমার এই প্রত্যয়টিতেই আমি ঠেকে গেছি।’ অচিন্ত্যকুমার, ওরফে কানু, শিল্পের সংজ্ঞা আর প্রক্রিয়া নিয়ে ঠিক কী লিখেছিলেন? পরোক্ষ উদ্ধৃতিতে নয়, প্রত্যক্ষ ভাবে জানা জরুরি ছিল। নইলে গণেশের শিল্পচিন্তা বুঝব কী করে? একটি চিঠিতে একটি ছবি, তার সঙ্গে গণেশ লিখছেন, ‘এর মধ্যে ব্যাধ আর ঋষি একাকার হোয়েছে, মাংসহীন বিহংগের স্বর্ণাভ পাখা আকাশে উড়াল দিয়েছে। ছবিটি যথেষ্ট উদ্ভুট্টে, এ জন্যে তিরস্কার কোরো।’ এ শিল্পচিন্তা নয়, নিজের ছবির ব্যাখ্যা। শিল্পচিন্তা নিয়ে লিখতে চাইলে গণেশ সে কাজ করতেন কি? এই বাষট্টিটি চিঠির বেশিটাই ব্যক্তিগত নানা তথ্যে ভরা। সে সবে জীবনীকারের নিশ্চয়ই প্রয়োজন থাকবে, ভাষ্যকারের নেই। সে সব বাদ দিয়ে শুধু ক্ষীরটি নিয়ে অনেক ছোট অথচ সারগর্ভ একটি বই তৈরি হতে পারত।
তবু যা হয়েছে তা-ও অনেক, আমি কবি-সাহিত্যিকদের এটি পড়তে বলি, কারণ এ বই পুরোটা পড়লে, তার নীরটুকুতে ডুবে গিয়েও দু’একটি বিচ্ছিন্ন অতল মুক্তো খুঁজে পেলে তাঁরা বুঝবেন শব্দই ব্রহ্ম নয়, যাঁর যা ভাষা সেটাই ব্রহ্ম। গণেশের স্বভাবসিদ্ধ উদাসীনতায় তেমনই একটি চিঠিতে একটি অনুকরণীয় সত্য সে বড় সহজে বলেছে, ‘ছবি আঁকতেই ভালো লাগে। ছাইপাঁশ যা-ই হোক ওর মধ্যেই নিজেকে খরচ করে ফেলতে চাই।’ |
|
|
|
|
|
|