পূর্ব কলকাতা
নিধিরাম
দম নেই দমকলের
পাঁচ নম্বর সেক্টরের একটি বহুতলে অগ্নিকাণ্ডের সময়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছলেও সেই বহুতল থেকে কর্মীদের বার করতেই বেশ কিছুটা সময় পার হয়ে গেল। উপরন্তু কোথা থেকে জল পাওয়া যাবে তা জানতেই সময় গেল আরও কিছুটা। এর উপরে বহুতলের মধ্যে গোলকধাঁধার মতো পথ। সব মিলিয়ে আগুন নেভাতেও হিমসিম খেতে হল দমকল কর্মীদের।
কেন এমন হল?
দমকল দফতর সূত্রে খবর, পাঁচ নম্বর সেক্টর এবং সল্টলেকে বাড়িগুলি সম্পর্কে পর্যাপ্ত তথ্যই নেই দমকলের কাছে। অথচ নন্দরাম মার্কেট, আমরি হাসপাতালে অগ্নিকাণ্ডের পরে বহুতল সম্পর্কে প্রয়োজনীয় তথ্য দমকলকে সরবরাহ করার কথা ঘোষণা হয়েছিল। সরকারি দফতরগুলিতে সে সম্পর্কে প্রয়োজনীয় নির্দেশও পাঠানো হয়েছিল বলে প্রশাসন সূত্রে খবর।
কিন্তু সেই নির্দেশ কতটা পালিত হল? শিয়ালদহের সূর্য সেন মার্কেটে অগ্নিকাণ্ডের পরে এ প্রশ্ন ফের উঠেছে। পাশাপাশি, দমকলের পরিকাঠামোও পর্যাপ্ত মানের নয় বলে অভিযোগ। বিশেষত সল্টলেক ও পাঁচ নম্বর সেক্টরের মতো এলাকায় যেখানে গত দশকে লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে বহুতলের সংখ্যা। এর পাশাপাশি পাঁচ নম্বর সেক্টরের দমকল কেন্দ্রের মানোন্নয়নের দাবিও উঠেছে।
বহুতল সম্পর্কে কী ধরনের তথ্য দমকলের কাছে থাকা প্রয়োজন?
দমকল দফতরের এক আধিকারিক জানান, বাড়িগুলির প্রশাসনিক চরিত্র কেমন, আবাসিক না কি বাণিজ্যিক? সেখানে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা কতটা মজুত রয়েছে? নিরাপত্তার জন্য আলাদা করে কোনও কর্মী আছেন কি না? বাণিজ্যিক বাড়ি হলে কী ধরনের ব্যবসা সেখানে হয়? সেই বহুতলে জলের ব্যবস্থা কতটা মজুত আছে প্রমুখ।
সেখানেই সরকারি দফতরগুলির মধ্যে সমন্বয়ের অভাব স্পষ্ট। যেমন ,বিধাননগর পুরসভা শুধুমাত্র তাঁদের পুরভবন সম্পর্কে তথ্য দমকল দফতরকে পাঠিয়েছে বলে কার্যনির্বাহী আধিকারিক মলয় মুখোপাধ্যায় জানান। কিন্তু পুর এলাকায় অন্যান্য বহুতল সম্পর্কে পর্যাপ্ত তথ্য আজও দমকল দফতরের কাছে জমা পড়েনি বলেই সূত্রের খবর।
এ ক্ষেত্রে সরকারি দফতরগুলির মধ্যে সমন্বয়ের অভাব দায়ী বলে অনেকের অভিযোগ। কিন্তু বাসিন্দাদের অভিযোগ, তথ্য নেই বললেই হবে না। তথ্য না থাকলে কী ভাবে দমকল দফতর নো অবজেকশন সার্টিফিকেট দিচ্ছে?
পাঁচ নম্বর সেক্টরের ভারপ্রাপ্ত সংস্থা নবদিগন্ত শিল্পনগরী কর্তৃপক্ষের কার্যনির্বাহী আধিকারিক বদ্রিনারায়ণ কর বলেন, “শিল্পনগরীতে প্রায় ২৫০টি বাড়ি রয়েছে। ইতিমধ্যে প্রায় ১৫০টি বাড়ির ক্ষেত্রে ফায়ার অডিট করা হয়েছে। দু’টি বেসরকারি সংস্থা এই কাজ করছে। কাজ শেষ হলে সব তথ্য দমকলকে দেওয়া হবে। এই কাজের সঙ্গে দমকলের আধিকারিকরাও যুক্ত রয়েছেন।”
কিন্তু তথ্য থাকলেই কি পাঁচ নম্বর সেক্টরের দমকল কেন্দ্রের পক্ষে সল্টলেক ও শিল্পনগরীতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা প্রতিরোধ করা সম্ভব? দমকলেরই সূত্র জানাচ্ছে, স্রেফ দমকল কর্মীদের অদম্য মানসিকতার জন্য আপাতত কাজ চলছে। কিন্তু জনসংখ্যা, বহুতলের সংখ্যা-সহ বিভিন্ন দিক মিলিয়ে সমগ্র সল্টলেকের প্রেক্ষিতে দমকল কেন্দ্রের মানোন্নয়নের আশু প্রয়োজন।
পরিকাঠামোয় কোথায় পিছিয়ে রয়েছে পাঁচ নম্বর সেক্টরের দমকল কেন্দ্রটি?
দমকল দফতর সূত্রে খবর, ওই কেন্দ্রে থাকার কথা চারটি গাড়ি। আছে তিনটি। যার মধ্যে একটি বন্টো স্কাই ল্যাডার। এই যন্ত্রটি ব্যবহার করে ২০-২২ তলা পর্যন্ত অগ্নিকাণ্ডের মোকাবিলায় সক্ষম দমকলকর্মীরা। কিন্তু যন্ত্রটিকে ঘোরাতে চার দিকে ন্যূনতম ৪০ ফুট জায়গা থাকা প্রয়োজন। অন্তত পাঁচ নম্বর সেক্টরে তা নেই।
যন্ত্রের যন্ত্রণার এখানেই শেষ নয়। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গিয়েছে, কোথাও আগুন লাগলে জানলা কিংবা দরজা ভাঙার প্রয়োজন হচ্ছে। তাই গ্রিল জাতীয় সামগ্রী কাটবার জন্য উন্নতমানের কাটার (রোটারিং) যন্ত্র নেই। পাশাপাশি স্টিফেন কোর্ট বিল্ডিং অগ্নিকাণ্ডের সময়ে দেখা গিয়েছে যে, অনেকে নীচে লাফ দিয়ে পড়ে মারা গিয়েছেন। সে সব ক্ষেত্রে মানুষকে বাঁচাতে প্রয়োজন এয়ার জাম্পিং শিট। তা-ও নেই। যদিও অফিসার, স্কোয়াড লিডার, ফায়ার ফাইটার-সহ ৬০ জনেরও বেশি কর্মী সল্টলেকের অন্যতম ভরসা।
এই সব অভিযোগ প্রসঙ্গে রাজ্যের পুর ও নগরোন্নয়নমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম বলেন, “এ বিষয়ে সবিস্তার খোঁজ নিচ্ছি। তবে বিভিন্ন সরকারি দফতরেই ফায়ার অডিট করা হচ্ছে। সে ক্ষেত্রে অডিট রিপোর্ট সমেত সংশ্লিষ্ট বাড়ির পুরো তথ্যই পাওয়া যাবে।”
সমস্যার কথা স্বীকার করে দমকলমন্ত্রী জাভেদ খান বলেন, “বহুতল সম্পর্কে তথ্য থাকলে প্রতিরোধক ব্যবস্থা গড়ে তোলা যায়। তথ্যের অভাব রয়েছে। দ্রুত পদক্ষেপ করা হবে।” পরিকাঠামোর মান নিয়ে ওঠা অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “সল্টলেক আলাদা নয়, সামগ্রিক ভাবেই পরিকাঠামোর মান বাড়ানোর চেষ্টা চলছে। ইতিমধ্যেই জিপিআরএস পদ্ধতি ব্যবহার করা হবে। যাতে কম সময়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছনো যায়। সে ক্ষেত্রেও অবশ্য তথ্যভাণ্ডার থাকা আবশ্যক। ছোট-বড় মিলিয়ে অসংখ্য গাড়ি কেনা হচ্ছে। আরও আধুনিক যন্ত্রপাতি আমদানি করার কথাও ভাবা হচ্ছে।”

ছবি: সুব্রত রায়




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.