|
|
|
|
|
|
|
হাঁড়ির খবর |
ধন্যি নিরামিষ
ঋজু বসু |
|
তরুণ কাঁঠালের ডালনা মুখে দিয়ে যাঁরা গোবৎসের মাংস বলে ভুল করবেন, আমি সেই গোত্রে পড়ি না। জীবনে প্রকৃত পাঁঠার ঝোল কব্জি ডুবিয়ে চাখার পরে গাছপাঁঠায় সন্তুষ্টি আমার পোষাবে না। তা ছাড়া, শাকাহারীদের জন্য প্রস্তুত আমিষগন্ধী নিরামিষে আমার একটুও রুচি নেই। —বুদ্ধদেব বসু
|
উপরের লাইনগুলো যে কোনও ঘোর আমিষাশী, খাসি-পাঁঠার যম দৃপ্ত বাঙালিরই প্রাণের কথা হতে পারে! ওহ্! ক্যালকাটা-র এঁচোড়ের কষাটা খেতে বসলে সেই তিনিই নির্ঘাত বাক্স্তব্ধ হবেন। চিন দেশের ‘মক মিট’ও আগে চাখার অভিজ্ঞতা হয়েছে। খোদার উপরে খোদকারি করা সেই আমিষ আসলে আমিষ নয়। সয়া প্রোটিন। কিন্তু ডাক, চিকেন, ল্যাম্ব বা প্রনের আদলটা হুবহ নকল করেছে। আমিষ মশলায় রান্নার পরে সেই মায়া-মাংসকেই আসল মাংস বলে ভ্রম হয়। ও সব খেয়ে মাছ-মাংসের স্বাদ থেকে বঞ্চিত নিরামিষাশীরা ধন্য-ধন্য করতে পারেন, আমিষ-নিরামিষ দু’টি রসই প্রাণ ভরে উপভোগ করে থাকলে মুখে রুচবে বলে মনে হয় না। গাছপাঁঠা অবশ্য অনেক আমিশাষীরই প্রিয়।
কট্টর ছাগমাংস-রসিকের তবু ব্যাপারটা কেমন-কেমন লাগে।
ওহ্! ক্যালকাটা-র এঁচোড়ে বুঁদ হয়ে সেই অস্বস্তি মুহূর্তে উধাও।
এঁচোড়কে বুদ্ধদেব বসু কেন ‘তরুণ কাঁঠাল’ বলে সম্বোধন করেছিলেন, তা ক্বচিৎ-কদাচিৎ অনুভব করা যায়। স্রেফ মাংসের মতো রাঁধলেই এঁচোড় এমন পূর্ণতা লাভ করে না। ওহ্! ক্যালকাটা-র শেফ সুবীর দেব বলছিলেন, তাঁদের হেঁসেলের বাঁধা সাপ্লায়ারের আমদানি এক ধরনের ছোট সাইজের এঁচোড়ের কথা। রান্নার গুণে যার গা-টা সুসিদ্ধ খাসি-পাঁঠার মতো মোলায়েম কিন্তু আঁটোসাঁটো। আর তার সঙ্গে মাত্রা জুড়েছে হাল্কা কাঁঠালসুলভ ঘ্রাণের আবেশ। মাটনগোছের কিছু একটা খেলাম, অথচ মাটন খেলাম না বলে মনপ্রাণ বেদনায় ভরে উঠল না, এমন আশ্চর্য অভিজ্ঞতা মাটন-অন্ত-প্রাণদের জীবনে কমই ঘটে। তবে আফশোস হতে পারে, এই তরুণ কাঁঠালের সঙ্গে হুইস্কি অর্ডার না-করলে। ওহ্! ক্যালকাটার ডাব-ভদকার ককটেল ডাবকা যতই বেড়ে লাগুক, এমন এঁচোড়কে মর্যাদা দিতে একটু হুইস্কি না-হলে চলে! খাদ্যমদ্য রসিক শাকাহারী বন্ধু-আত্মীয়কে এই বাঙালিয়ানার স্বাদটুকু উপহার দিতে পারলে নির্ঘাত প্রভূত আনন্দ অনুভব করবেন। |
|
ওহ্! ক্যালকাটা-র মতো বাঙালি খানার ঠেকেও এমন নিরামিষের দাপট ক্রমেই বাড়ছে। জগদ্বিখ্যাত তন্দুরি চিকেনের টানে আইটিসি সোনার-এর পেশাওয়ারিতে ঢুকলেও তন্দুরি আলু, তন্দুরি শিমলা মির্চ বা তন্দুরি ব্রকোলি-টকোলিরই রমরমা। ফরাসিরা দীর্ঘ দিন পর্যন্ত নিরামিষ খানা খায় না মাথায় দেয়, বুঝতেন না। সেই তাঁরাও এ দেশে ফরাসি রান্নার রেস্তোরাঁ খুলতে গেলে আগেভাগে একটা লম্বা নিরামিষ মেনু রাখার পরিকল্পনা করেন। এখন বাঙালি রেস্তোরাঁও নতুন নতুন নিরামিষ উৎকর্ষের খোঁজ করছে।
কেন? কারণটা সোজা! এ দেশে রেস্তোরাঁয় ঢালাও খরচের ক্ষমতায় শাকাহারীরা মাংসাশীদের থেকে অবশ্যই এগিয়ে। এবং সেই রেস্তদার খাইয়েরা ক্রমশ বাঙালি রান্নার মর্ম বুঝছেন। এতটুকু বয়স থেকে শুক্তো, বড়ি দেওয়া শাকের ঘণ্ট, পোস্ত বা থোড় খেয়ে জিভের তার তৈরি হয়েছে যে-সব বঙ্গসন্তানের রেস্তোরাঁর সৃষ্টি নিরামিষ তাদের মনে ধরতে সময় লাগবে। কিন্তু তাঁরাও শেফ সুবীরের হিং-বড়ি-আলুর টিকিয়া বা সয়া-মোচার টিকিয়ার স্টার্টার খেয়ে দিব্যি খুশি হচ্ছেন। এই সব টিকিয়ায় পেঁয়াজের ছোঁয়া অবধি নেই। মোচার চমৎকার স্বাদ সয়াবিনের সঙ্গে মিশে রীতিমতো শিল্পোত্তীর্ণ হয়ে উঠেছে। সজনে ফুল থেকে সজনে ডাঁটা হতে এখনও কিছুটা দেরি আছে। সেই সজনেফুল-শিমের পাতুরিও খেলে মনে থাকবে। এমন লো-ক্যালরি সুস্বাদ সচরাচর বরাতে জোটে না।
আমাদের চেনা-জানা নিরামিষের মধ্যে আর একটি বস্তুর জনপ্রিয়তাও ক্রমশ উর্ধ্বগামী। পনির। ছানার জল বার করা ওই নিষ্প্রাণ বস্তুটিতে স্বাদ আরোপ করতে বালতি-বালতি মাখন ঢেলে যে বাটার মশলা তৈরি হয়, তার নাম শুনলেই কোলেস্টেরল বেড়ে যেতে বাধ্য! ওহ্! ক্যালকাটা এই পনিরকেই মোক্ষম পোষ মানিয়ে একেবারে বাঙালি করে ছেড়েছে। পনির টিক্কায় ভরপুর গন্ধরাজের সুরভি! ঘোর পনির-বিরোধীও তাতে গলে জল। ভেতরে খোয়া-কাজু-কিসমিস ঠাসা ছানার রকমারি কালিয়াও মেনুতে রাখা হয়েছে। আর ছানার রোলে পালংশাক ঠেসে দই, কাঁচালঙ্কা, ধনে-পুদিনা-শুল্পো পাতার হোয়াইট গ্রেভিতে আর একটি নতুন পদও বেশ!
বাঙালি রান্নায় অদীক্ষিত খাইয়েদের কথা ভেবেও পাল্টাচ্ছে রেস্তোরাঁর খাবার। বোহেমিয়ান-এর শেফ জয়মাল্য বন্দ্যোপাধ্যায় যেমন পাঁচফোড়নের তেল দিয়ে আলুর স্টার্টার বা আলফান্সো আম দিয়ে নানা কিসিমের সব্জির তরকারি নামিয়ে ফেলেছেন। ওহ্! ক্যালকাটা-য় তেমনই, তিল-লঙ্কার একটা দারুণ সব্জি হচ্ছে। কপি-ব্রকোলি-কড়াইশুঁটি-গাজরে হাল্কা ঝাল রান্না। তবে কাঁচা লঙ্কার উপস্থিতি দেখে ভয়ের কিছু নেই। লঙ্কার গন্ধটা কব্জা করাই টার্গেট। তাই বীজ-ছাড়িয়ে ফালি-ফালি লঙ্কা উপরে সাজানো হয়েছে। সব্জি ভরপুর একটা খুব ভালো গোবিন্দভোগের পোলাও-ও হচ্ছে। তবে তরকারিগুলো বোধহয় এই পোলাও দিয়ে না-খাওয়াই ভাল। তাতে পোলাওয়ের নিজস্ব মহিমা খাটো হয়। বিরিয়ানির সঙ্গে স্রেফ শুকনো কাবাব খেতে যেমন জমে, গোবিন্দভোগ পোলাও খাওয়ার ফাঁকে-ফাঁকে নানা কিসিমের নিরিমিষ টিকিয়ায় কামড়ই ঢের উপভোগ্য হবে। তিল-লঙ্কার সব্জিটাও মনে হয় শুধু ভাত দিয়েই বেশি জমবে। মেনুতে লুচির সঙ্গে ফুলো-ফুলো ঢাকাই কুলচা বা মশলা রুটি রাখা হয়েছে। কুলচার পেটে সব্জি-টব্জি ঠাসা আর রুটিতেও ঝাল-ঝাল মশলার প্রলেপ। শেষপাতে চকোলেট ও নলেনগুড়ের ভাপা সন্দেশ, গন্ধরাজের সুফলের মাধুর্য। আমিষাশী বাঙালির নিরামিষ-চর্চা যে চিরকেলে ধোকার ডালনা, শুক্তো-পোস্ততে আটকে নেই, এটুকু বুঝতে এর পরে ভুল হওয়ার কথা নয়। |
ছবি: রাজীব বসু |
|
|
|
|
|