অঞ্জন-ব্যঞ্জন
ভেজ কয় যাহারে
নিরামিষ শব্দটা শুনলেই খিদে-টিদে যাঁদের হাওয়া হয়ে যায়, এই লেখা তাঁদের জন্য নয়। বরং, কচিপাঁঠার পাশাপাশি যাঁরা গাছপাঁঠারও কদর করতে জানেন, আজকের লেখা সেই সব সুরসিক ভেজভোজীদের কথা ভেবে। আমার এক ঠাকুমা ছিলেন যিনি অসম্ভব ভাল দই মাছ রাঁধতেন, নিজে সাত্ত্বিক বিধবা, মাছের নাম অবধি মুখে নিতেন না, বলতেন জলের ফসল, কিন্তু আমরা সব মুখিয়ে থাকতাম তাঁর হাতে মানকচুর ঝাল খাওয়ার জন্য। সে যে কী অপূর্ব স্বাদ, কোথায় লাগে দই মাছ! এমনও হয়েছে, পাড়ার মা-মাসিমারা ঠাকুমার কাছে শিখতে আসতেন সেই সব অমৃত রেসিপি। না কোনও খাতা, না বই, পুরো পদ্ধতিটাই ছাপা ছিল ঠাকুমার মাথায়। তিনি গত হওয়ার পর, সেই সব রান্না মহাকালের ইতিহাসে বিলীন হয়ে গেছে।
আর আজ যখন, নিজের পেশার তাগিদে নিরামিষ রান্নার প্রসঙ্গ ওঠে, আমি সবচেয়ে মিস করি আমার ঠাকুমাকে। যাই হোক, সময় এগিয়ে চলেছে। পিছনে ফিরে তাকানোর ফুরসত নেই কারও। যে ভাবে হোক এগিয়ে যেতে হবে। তাতে যদি দু’একটা শেকড় উপড়ে ফেলতে হয়, তো হবে। তবু, কারও কারও এমনই স্বভাব, যেমন আমার, যাঁরা পুরনো জিনিসের মধ্যেও নতুন কিছু খুঁজতে চান, আবিষ্কার করেন। তাঁরা পারলে এঁচোড়ের কোপ্তা বা পটলের দোলমাকেও কন্টেম্পোরারি করেন। প্রশ্ন তোলেন, কেন শুক্তো সার্ভ করা হবে না পাঁচতারা হোটেলের মেনুতে? লুচি-ছোলার ডালের একটা জেনারেশন নেক্সট্ অপশন দেখান তো! মাংসের চপ তো নতুন কিছু নয়, মোচার চপের কাছে সে তো শিশু।
তবে, আশার কথা, ভেজাহারীদের দলও ভারী হচ্ছে। আজকের কোলেস্টেরল আর ইউরিক অ্যাসিড কবলিত বঙ্গ সমাজে তাঁরা আর সংখ্যালঘু নন। স্বাস্থ্য সচেতনতাই এখন ইন থিং। যে হারে চারদিকে জিম গজিয়ে উঠছে, ভেজিটেরিয়ান ক্লাবও রমরমিয়ে উঠল বলে। নাগরিক কলকাতার বুকে এখন বাঙালি নিরামিষ রান্নার উৎসবেও রীতিমতো ভিড়। আমাদের ওহ্! ক্যালকাটায় তো এখন নিরামিষ রান্না নিয়ে হুলস্থুল পড়ে গেছে।
গন্ধরাজ পনির টিক্কা, ছানা আমকাসুন্দি পাতুরি, সয়া মোচার টিকিয়া, হিং বড়ি আলুর টিকিয়া বাঙালিদের পাশাপাশি অবাঙালিদেরও মন জয় করেছে। একই ভাবে রকমারি সব বাঙাল রান্না যেমন, বরিশালের পোলাও, ঢাকাই কুলচা, ফুলকপি আমকাসুন্দি, তিল লঙ্কার তরকারি, এঁচোড়ের কষা বাঙাল-বাঙালি দু’য়েরই জিভে জল আনছে।
ওপার বাংলার কথা যখন এল, তখন কৃতজ্ঞতা স্বীকারে দোষ নেই। আমরা কিন্তু, অধিকাংশ নিরামিষ রান্নার হদিস পেয়েছি পূর্ববঙ্গের থেকে। সোনামুগের ডাল হোক বা সজনে ফুলের তরকারি খাস বাংলাদেশের হৃদয় হতে। আজও যখনই ঢাকায় যাই, আমার রসনাশিকারি মন খুঁজে নেয় নিত্য নতুন বাঙালি রেসিপি, মজার কথা হল অনেক বাংলাদেশি এ ব্যাপারে খুব একটা অবগত নন, যদিও তাঁরা এপার বাঙালিদের মতো অত উদাসীনও নন।
তবে, আশার কথা আজও বেশ কিছু রসনাশিল্পী রয়েছেন দুই বাংলারই মাটিতে, যাঁরা একালের মানুষ হয়েও বহন করে চলেছেন সেকালের ট্র্যাডিশন। সেই সব অশ্রুত, অখ্যাত মা-মাসিমা, আপা বা আম্মাকে আমার কুর্নিশ, নিরামিষ রান্নাকে যাঁরা নিরন্তর আমিষের ছোঁয়া থেকে বাঁচিয়ে চলেছেন!

ছবি: শুভেন্দু চাকী




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.