বাংলার কপালে শিল্প মানে কলা-ই, মানল এনভিডি দেশ বিতর্কসভা
শিল্প মানে কি শুধুই লোহা, ইস্পাত ও কলকারখানা? নাকি মাটির পুতুল, ঝুলন, ধনেখালির তাঁত এবং রবীন্দ্রসঙ্গীত?
শুক্রবার সন্ধ্যায় বিড়লা সভাঘরে ‘এনভিডি দেশ বিতর্ক’ বোঝাল, এই সব ভারী শিল্প, চারুশিল্পের বাইরে আরও একটা শিল্প আছে। সাহসের সঙ্গে সত্য কথা বলার শিল্প। মিশেল ফুকো যাকে বলতেন ‘পারহেসিয়া’!
সেই সাহসী শিল্পের জেরেই এ দিন সবচেয়ে বেশি হাততালি জিতে নিলেন সুবোধ সরকার। ‘রবীন্দ্রনাথের ছবি বসছে, তার নীচে ধূপকাঠি। ধূপকাঠি শিল্প ছাড়া বাংলায় আর কিছু নেই। ন্যানো তাড়াও, ধূপকাঠি জ্বালাও!’ বললেন, ‘‘আমি আশাবাদী। মেরিলিন মনরো যদি অনাথ আশ্রম থেকে অস্কার পেতে পারেন, আইনস্টাইন তিন বার পলিটেকনিকে ফেল করে বিশ্ববরেণ্য বিজ্ঞানী হতে পারেন, তা হলে কালীঘাটও এক দিন নিশ্চয় লন্ডন হবে।’’ দিনের শেষে দর্শকদের রায়ে সুবোধ, কৌশিক ঘোষ এবং শকুন্তলা ঘোষের টিমই বিতর্কে জয়ী।
বিতর্কের ক্যাচলাইন কিন্তু মোটেই সহজ ছিল না। শিল্প মানেই কলা! দুই রকম অর্থই উঁকি দিচ্ছিল তার আড়াল থেকে। তা হলে কলাশিল্পই সব, অন্যরা ভো-কাট্টা? নাকি ওই তিন শব্দের আড়ালে রয়েছে ব্যঙ্গের ঝাঁঝ? যে ঝাঁঝ বোঝায়, শিল্প মানে পশ্চিমবঙ্গের কপালে এখন শুধুই কলা! জয়ী দলের সদস্য, অর্থোপেডিক কৌশিক ঘোষ অবশ্য কলার ‘ফুড ভ্যালু’ও টেনেছিলেন। ‘‘রজার ফেডেরার খুব কলা খান। কারণ, ওতে এনার্জি দেয়। ৭০ শতাংশ সুগার, বাকিটা প্রোটিন। ফলে প্রোটিনের ঘাটতি মেটাতে ফেডেরারকে অন্য খাবার খেতে হয়। সে রকম, আমার এখানে কলাশিল্প আছে বলে ভারী শিল্পকে বাতিল করে দেব?’’
এনভিডি দেশ বিতর্কসভায় পার্থ ঘোষ, ঈলীনা বণিক, স্বপন চক্রবর্তী,
হর্ষ দত্ত, কৌশিক ঘোষ, শকুন্তলা ঘোষ, সুবোধ সরকার। —নিজস্ব চিত্র
দ্বৈত অর্থের এই কলায় পা পিছলেছেন অনেক তার্কিকই। প্রস্তাবের সমর্থনে প্রথমে বলতে উঠেছিলেন সল্টলেকের ‘উইপ্রো ক্যাম্পাস’, ‘ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব জুরিডিক্যাল সায়েন্স’-এর স্থাপত্যসংস্থা, ‘ঘোষ, বোস অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস’-এর কর্ণধার শকুন্তলা ঘোষ। গ্রিন বিল্ডিংস কাউন্সিলের এই চেয়ারপার্সনের কথায় এল পরিবেশ ভাবনা, দূষণ নিয়ন্ত্রণ। এল ধোঁয়া, দূষণহীন স্বপ্নের পৃথিবীর কথা। ‘শিল্প মানেই কলা’ প্রস্তাবকে একেবারে আক্ষরিক অর্থে মেনে নিয়েছেন তিনি।
প্রস্তাবের বিপক্ষে এ বার উঠলেন ঈলীনা বণিক। তিনিও শকুন্তলা দেবীর মতোই ভারী শিল্পের বিরুদ্ধে গ্রাম, শ্রীনিকেতন, লোকশিল্প, মৎস্যচাষ, ‘দাও ফিরে সে অরণ্য, লও হে নগর’ বলছিলেন। তাঁর কাছে তখন শিল্প মানে শুধুই চারুকলা। বিতর্কের প্রস্তাববাক্যেই যে লুকিয়ে আছে বিপজ্জনক চারুকলা, কেউ খেয়াল করেনি। প্রস্তাবের বিপক্ষে বলতে উঠে জাতীয় গ্রন্থাগারের ডিরেক্টর জেনারেল স্বপন চক্রবর্তী এক বার চৌষট্টি কলার কথা তুলেছিলেন, তার পর থেমেও গেলেন, ‘‘থাকুক, এখানে অতটা বলা উচিত হবে না।’’ বললেন, ‘‘শিল্পের দুটো অংশ। একটা ব্যবহারিক শিল্প। অন্যটি সারপ্লাস। তাজমহলকে তো আমরা কবর হিসাবে দেখি না, সেখানে কেউ থাকতেও যায় না।’’
কিন্তু বিতর্কে এসে নন্দনকলা কে শুনতে চায়? যে কোনও বিতর্কের অন্যতম উপভোগ্য বিষয়, তার্কিকদের পরস্পরকে ফালাফালা করা। স্বপনবাবু প্লাতোকে টেনে সেটাই করলেন, ‘‘শকুন্তলা যেটি করেন, স্থাপত্যশিল্প, সেটি ব্যবহারিক শিল্প বা ইউজফুল আর্ট। আর সুবোধ কবিতা লেখেন, ওটি ইউজলেস আর্ট।’’ পদার্থবিজ্ঞানী পার্থ ঘোষ স্বপনবাবুদের টিমেই ছিলেন। প্রস্তাবের বিপক্ষে বলতে উঠে তিনি সুইৎজারল্যান্ডের কথা আনলেন, ‘‘সুইৎজারল্যান্ডের মতো উন্নত দেশেও ভারী শিল্প নেই।’’ সুবোধ ‘সাম আপ’ করতে উঠে হাসতে হাসতে জানালেন, ‘‘প্লাতো? সুইজারল্যান্ড? দূর! লোকে কি এ সব শোনার জন্য আমাদের ডেকেছে? সোজা কথাটা বললেই হয়।’’ বিতর্ক মানে শুধুই খেউড় বা তরজা নয়। বরং বিপক্ষের যুক্তি খণ্ডন করে নিজেদের নিয়ে হাসাহাসি করা... শুক্রবারের ‘এনভিডি দেশ বিতর্ক পাওয়ার্ড বাই ওমিশা’ সে কথাও মনে পড়িয়ে দিল। পার্থ ঘোষ আর একটি কথা মনে করিয়েছেন। ‘‘প্রস্তাবের পক্ষে বা বিপক্ষে বলছি মানে এই নয় যে, আমি ব্যক্তিগত ভাবে সেটি সমর্থন করি।’’ পার্থবাবু বলছিলেন, “ভারী শিল্পের বদলে কুটির শিল্প দিয়ে কি ঘুরে দাঁড়ানো যায়? সে জন্য চাই রাজনৈতিক সদিচ্ছা, বিপুল লগ্নি, আধুনিক ম্যানেজমেন্ট।’’ বিজ্ঞানীও পিছলে গেলেন। তাঁর হৃদয় কোন দিকে, কোন শিল্পের কথা বলতে চান পরিষ্কার বোঝা গেল। বিতর্ক তো শুধু যুক্তি নয়। এক কথার আড়ালে অন্য কথাকে প্রচ্ছন্ন রাখার কারুকলাও বটে!



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.