এই সরকারেরই প্রাক্তন মন্ত্রীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ, তদন্তের নির্দেশ দিলেন বর্তমান মন্ত্রী।
শ্যামল মণ্ডল সুন্দরবন উন্নয়ন মন্ত্রী ছিলেন সাকুল্যে বছর দেড়েক। কিন্তু তার মধ্যেই নানা ধরনের আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে তাঁর বিরুদ্ধে। সেই দফতরেরই বর্তমান মন্ত্রী মন্টুরাম পাখিরা আগের মন্ত্রীর দুর্নীতির তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন। আর এ সব শুনে প্রাক্তন মন্ত্রীর প্রতিক্রিয়া সবই ষড়যন্ত্র। দলেরই একাংশ তাঁর বিরুদ্ধে এই কাজ করছে।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ২০১১-র ২০ মে মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে শপথ নিয়ে দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা থেকে যে ক’জনকে মন্ত্রিসভায় নিয়েছিলেন, শ্যামল মণ্ডল তাঁদের অন্যতম। সুন্দরবন এলাকারই বিধায়ক। তাই আয়লা-বিধ্বস্ত ওই এলাকা পুনর্গঠনের কাজ এগিয়ে নিয়ে যেতে শ্যামলবাবুকেই মন্ত্রী বেছে নিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। এমনকী শ্যামলবাবুর নাম নিয়ে আপত্তি এলেও আমল দেননি তিনি। তবে একের পর এক অভিযোগের ধাক্কায় দেড় বছরের মধ্যেই শ্যামল মণ্ডলকে মন্ত্রিসভা থেকে সরিয়ে দিতে বাধ্য হন মুখ্যমন্ত্রী। দলের এক জেলা নেতার কথায়, “নতুন আমলে কয়েক জন মন্ত্রীর দফতর বদল হলেও শ্যামল মণ্ডলকে আর মন্ত্রিসভাতেই রাখা হয়নি।”
শ্যামলবাবুর বিরুদ্ধে কী অভিযোগ সুন্দরবন উন্নয়ন দফতরের? |
সূত্রের খবর, ২০১২-১৩ আর্থিক বছরে বনসৃজন প্রকল্পে সুন্দরবন এলাকায় গাছ লাগানোর কর্মসূচি নেওয়া হয়। দফতরের বর্তমান মন্ত্রী মন্টুরাম পাখিরার কথায়, “চলতি আর্থিক বছরে এক হাজার হেক্টর জমিতে গাছ লাগানোর কথা ছিল। এ জন্য রাজ্য ২ কোটি ২৪ লক্ষ টাকা বরাদ্দ করে। কিন্তু দফতরের আধিকারিকদের পেশ করা ওই কাজের রিপোর্টের সঙ্গে বাস্তবের বিস্তর গরমিল ধরা পড়ে। রিপোর্টে এ-ও বলা হয়, প্রায় ৩০ হেক্টর জমিতে নতুন বনসৃজনের চিহ্নই মেলেনি। অথচ বিপুল অর্থ খরচ হয়েছে।” দফতর সূত্রের খবর, মূলত গোসাবা, নামখানা, কাকদ্বীপ ও সাগর এলাকাতেই এ ধরনের অভিযোগ উঠেছে।
অভিযোগ আরও আছে। সুন্দরবনের বাদাবনে দামি গরান প্রজাতির ‘ম্যানগ্রোভ’ গাছ লাগানোর প্রকল্প হাতে নিয়েছিল শ্যামলবাবুর দফতর। গরানের চারা কিনতে বিপুল টাকা খরচ হলেও সে গাছ কোথায় লাগানো হয়েছে, হদিস মেলেনি। এ নিয়ে এত অভিযোগ উঠেছে যে সুন্দরবনে ম্যানগ্রোভ লাগানোর দায়িত্বই আর নিতে চাইছে না দফতর। মন্টুরামবাবুর কথায়, “আমাদের দফতর আর ম্যানগ্রোভ লাগাবে না। বন দফতর লাগাক। তবে সুন্দরবনের বিভিন্ন ব্লকে রাস্তার দু’ধারে গাছ পোঁতার কাজ করবে আমাদের দফতর।” পূর্বসূরির বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ নিয়ে কোনও রাখঢাক করেননি বর্তমান মন্ত্রী। উল্টে বলেছেন, “যাবতীয় অভিযোগের বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ দিয়েছি।”
মন্টুরামবাবুর কথায়, “দু’মাসের মধ্যে তদন্ত শেষ করে রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে। বনসৃজন প্রকল্পে সুন্দরবনের বিভিন্ন এলাকায় ঠিক কত জমিতে কত গাছ লাগানো হয়েছে, তদন্তে তা খতিয়ে দেখা হবে। এই পরিসংখ্যান সংগ্রহের জন্য জিপিএস (গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম)-এরও সাহায্য নেওয়া হবে।” তবে তদন্তে পূর্বসূরির বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ হলেও তিনি যে কিছুই করতে পারবেন না, তা-ও ভালই জানেন মন্টুরামবাবু। দফতরের খবর, তদন্ত-রিপোর্ট হাতে এলে তা মুখ্যমন্ত্রীর হাতে তুলে দেওয়ার কথাই ভাবছেন মন্ত্রী। এর পর তিনিই যা করার করবেন।
কিন্তু বর্তমান যে ভাবেই তদন্ত করুন, প্রাক্তন তাকে গুরুত্ব দিতে নারাজ! সব অভিযোগ উড়িয়ে শ্যামলবাবুর পাল্টা অভিযোগ, “এটা ষড়যন্ত্র। ভিত্তিহীন অভিযোগ তুলে আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচার করা হচ্ছে।” কিন্তু কে বা কারা এই যড়যন্ত্র করল? শ্যামলবাবুর ইঙ্গিত দলের একাংশের বিরুদ্ধে। কিন্তু তাঁকে কেন মন্ত্রিত্ব থেকে সরিয়ে দিলেন মুখ্যমন্ত্রী? এ বার রীতিমতো সতর্ক প্রাক্তন মন্ত্রী। শুধু বললেন, “এ নিয়ে কোনও কথা নয়। ওটা নেত্রীর সিদ্ধান্ত।”
শ্যামলবাবু যা-ই দাবি করুন, তাঁর মন্ত্রিত্বের শুরু থেকেই তাঁকে নিয়ে বিতর্ক দানা বেধেছিল। মহাকরণের খবর, শ্যামলবাবুর আমলে দফতরের নানা অনিয়ম ও দুর্নীতি নিয়ে সব চেয়ে সরব ছিলেন সুন্দরবন উন্নয়ন পর্ষদের একাধিক সদস্য, যাঁদের অন্যতম এখনকার মন্ত্রী এবং ওই জেলারই বিধায়ক মন্টুরাম পাখিরা। দলের এক নেতার কথায়, সুন্দরবন এলাকার কর্তৃত্ব কার হাতে থাকবে, তা নিয়ে দু’জনের লড়াই বহু দিনের। এখন সুযোগ পেয়ে ফায়দা তুলতে চাইছেন মন্টুরামবাবু। এ বার তদন্তে অভিযোগ প্রমাণ হলে মুখ্যমন্ত্রী তথা দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শ্যামলবাবুর বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেন কি না, সেটাই দেখার। |