বেলা পৌনে চারটে এখন। মোহালি স্টেডিয়ামের মাথার ওপর এমন গনগনে রোদ্দুর যে গ্যালারিগুলোর একটাতেও ছাউনি না থাকা ভোগাতই। লোকে ছায়া খুঁজত। অনিবার্য ভাবে নীচের দিকটায় চলে যেত।
কে বলবে ঠিক তখুনি সারা দিন খেলা না হওয়ায় বেকার প্রেসবক্সের আড্ডায় মুড়ি-তেলেভাজাহীন একেবারে অন্য মাত্রার একটা টাটকা প্রসঙ্গ উঠে পড়ল! চলতি সপ্তাহটা মহেন্দ্র সিংহ ধোনির ভাল যাচ্ছে? না মন্দ?
ভাল যাচ্ছে এই দাবি জানালেন যাঁরা, তাঁদের ব্যাখ্যা, হঠাৎ করে যেমন মেঘলা পরিবেশ আর হাওয়া বইতে শুরু হল তাতে প্যাটিনসন-মিচেল জনসনরা এখানে খেললে ভারতের সাংঘাতিক সমস্যা হওয়া অনিবার্য ছিল। এমএসডি-র এমন কপাল, ঠিক এখানে এসেই কিনা আসল পেসাররা সাসপেন্ড হয়ে গেল! তর্কে যাঁরা বিপরীতগামী, তাঁদের বক্তব্য, সিরিজ এখানে ৩-০ করার জন্য হাতে সময় কমে গেল ভারত অধিনায়কের। বিষ্যুদবার গোটা দিন খেলা না হওয়ার ক্ষতিকে যতই আগামী ক’দিন আধ ঘণ্টা আগে ম্যাচ শুরু করে মেরামতের ব্যবস্থা হোক, ব্রাউনওয়াশের দিকে আর এক ধাপ এগিয়ে যেতে সময় পাওয়া যাবে মাত্র চার দিন! |
রবি শাস্ত্রী অবশ্য বরাবরের মতোই ধোনি ভাগ্যবান কি নন, সেই বিতর্কে যোগ দিতে আগ্রহী নন। এক বক্তব্যে তিনি অটল: ধোনি দেশের সর্বকালের সেরা অধিনায়ক। বললেন, “আপনাদের কলকাতার কোনও কোনও অংশের আবার এটা মেনে নিতে সমস্যা হবে। কিন্তু না মেনে উপায়ও নেই যে ধোনি একটা নতুন রেকর্ড করেছে। অস্ট্রেলিয়াকে সিরিজ চলাকালীন ও ব্যর্থতা থেকে বার হওয়ার উত্তরপত্র লিখতে বাধ্য করেছে। প্রথম ইন্ডিয়ান ক্যাপ্টেন যে অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট টিমকে পড়ুয়ার পর্যায়ে নামিয়ে এনেছে।”
“আমায় কোট করতে পারেন,” বলতে বলতে ভিআইপি লাউঞ্জ ছেড়ে ভাষ্যকার বক্সে ফেরত গেলেন শাস্ত্রী। ভিভিএস লক্ষ্মণকে দেখা গেল তখনও লাউঞ্জে ঘুরছেন। খেলা হচ্ছে না, সময় কাটাতে হবে তো! কিন্তু টানা দু’মিনিট কারও সঙ্গে কথা বলবেন সম্ভব নয়। লক্ষ্মণের জনপ্রিয়তা বোধহয় ইডেনের পরেই সবচেয়ে বেশি মোহালিতে! রিকি পন্টিংয়ের টিমের বিরুদ্ধে সেই অপরাজিত ৭৩ করে জেতানো আজও এ মাঠে খেলা অমর ম্যাচ-জেতানো ইনিংসের মধ্যে সামনের সারিতে। তিন বছর পর প্রথম এ মাঠে ফিরলেন। প্রজ্ঞান ওঝা আর ইশান্ত শর্মাকে বিপরীতে নিয়ে সেই অসম্ভব ইনিংসের মুহূর্তগুলো লক্ষ্মণের আত্মজীবনীতেও থাকবে। যা লেখার কাজে জানালেন সদ্য হাত দিয়েছেন। এ দিন তাঁকে ভাষ্যকারেরা অনেকে অভিনন্দন জানিয়ে যাচ্ছিলেন অন্য কারণে। ১৪ মার্চ ইডেনে তাঁর আর দ্রাবিড়ের চির-ঐতিহাসিক সেই পার্টনারশিপের বারো বছর পূর্তি হল। “সময় এত দ্রুত যায়। এই তো সে দিন,” সেই বিস্ময়ের পাশাপাশি আরও একটা প্রশ্ন তাড়া করছে লক্ষ্মণকে।
“কলকাতায় বরাবর দর্শক আমাকে ডেকেছে ‘লক্ষ্মণ’ বলে। কখনও ‘লাক্সমন’ বলেনি। অথচ তাঁরা ইডেনে আমরা ওপেন জিপে ঘোরার সময় আমাকে ‘ভিভিএস’ বলে চিৎকারে ভরিয়ে দিল। এত মন ভরিয়ে দেওয়া সংবর্ধনা জীবনে কখনও পাইনি। কিন্তু এটাও ভেবে পাইনি সম্বোধনটা চেঞ্জ হয়ে গেল কী করে?” লক্ষ্মণের মুখে হালকা হাসি। |
খেলা হচ্ছে না। হাতে অঢেল সময়। কপিল দেবতিনি চলে এলেন প্রেসবক্সে। বহু বছর বাদে প্রেসবক্সে। আর এই মাঠে! নিজের শহরের ঘরের মাঠে তাঁর প্রত্যাবর্তনকে ছাপিয়ে লক্ষ্মণের মোহালি প্রত্যাবর্তনকে স্থানীয় মিডিয়া বেশি গুরুত্ব দিল দেখে অবাকই লাগছে! কপিলেরটা অনেক বেশি তাৎপর্যপূর্ণ।
কপিলের যে ঘরের মাঠে ক্রিকেট দেখতে ফেরা বারো-চোদ্দো বছর বাদে। ভারতের কোচ থাকাকালীন শেষ এখানে এসেছিলেন। তার পরই পঞ্জাব ক্রিকেট সংস্থার প্রধান আই এস বিন্দ্রার সঙ্গে নানান বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন যা আন্তর্জাতিক চেহারা নিয়েছিল। পরবর্তী কালে দু’পক্ষে উত্তেজিত বাদানুবাদ হতে থাকে। তাঁর আর পঞ্জাব ক্রিকেট সংস্থার কর্তাদের সম্পর্কের অবনতিতে এতটাই উত্তেজিত ছিলেন যে মোহালি ক্রিকেট জাদুঘরে দান করে দেওয়া নিজের সব স্মারক লিখিত ভাবে ফেরত চেয়েছিলেন। বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে এত বড় ম্যাচ হল ভারত-পাকিস্তান! সেটা কিনা মাত্র আড়াইশো কিলোমিটার দূরের দিল্লিতে বসে থেকেও দেখতে আসেননি।
আজ অবশ্য স্থানীয় ক্রিকেটমহল খুব আন্তরিক অভিবাদন জানাল ঘরের ছেলেকে। সময় সব কিছু ভুলিয়ে দেয়। বহু বহু বছরের তিক্ততাও।
প্রত্যাবর্তনের এমন আবেগঘন দিনে বৃষ্টিরও যে পশলায় পশলায় প্রত্যাবর্তন ঘটবে তাতে আর আশ্চর্য কী! অস্ট্রেলিয়া অবশ্য টেস্ট শুরুর তোয়াক্কা না করে টসের আগেই দল জানিয়ে দিল।
তারা দুই স্পিনার খেলাতে বাধ্য হচ্ছে গ্লেন ম্যাক্সওয়েলকে বাইরে রেখে। বিচিত্র পরিস্থিতি। ত্রয়োদশ প্লেয়ার মাঠে নামাবার দরকার হলে তাদের কেউ নেই। আর চার দিনে বহু টেস্ট যিনি ভারতকে ধুয়াধার বল্লেবাজিতে জিতিয়েছেন, সেই বীরেন্দ্র সহবাগও নেই এ বার এ দিকে।
শুক্রবার আম্পায়ার ‘প্লে’ বলে ম্যাচ শুরুর আগে পর্যন্ত তাই ধোনি ভাগ্যবানও নন। দুঃখীও না। টেস্ট শুরু হবে ‘লাভ অল’।
|