ইছামতী সংস্কার নিয়ে বনগাঁ ও বসিরহাট মহকুমার বাসিন্দাদের অতীতের স্মৃতি খুব সুখের নয়। ঢাক-ঢোল পিটিয়ে কোটি টাকা খরচ করে এর আগে কয়েক দফায় নদীর বুক থেকে পলি সরানো, কচুরিপানা পরিষ্কারের কাজ হলেও ওই সংস্কারের সুফল জোটেনি বনগাঁ, বাগদা, গাইঘাটা থেকে বসিরহাটের নদীপাড়ের মানুষের কপালে। যতবার সেই কাজ হয়েছে ততবারই প্রশ্ন উঠেছে কাজের প্রকৃতি, প্রকল্পে বরাদ্দ টাকার দুর্নীতি নিয়ে। আর তাই আজও নদীপাড়ের মানুষের বক্তব্য, “ইছামতী থেকে গিয়েছে ইছামতীতেই’। তাই নতুন রাজ্য সরকার ক্ষমতায় আসার পর মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ইছামতী সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দিলেও তা থেকে খুব একটা আশান্বিত হননি বনগাঁ ও বসিরহাটের নদীপাড়ের মানুষ। তাই এ বার বাজেটে রাজ্য সরকারের বরাদ্দ ৩১. ১৫ কোটি টাকায় ইছামতী নদী সংস্কারের কাজ শুরু হওয়ায় পুরনো প্রশ্নগুলিই ফের উঁকি দিতে শুরু করেছে। বৃহস্পতিবার স্বরূপনগরের শগুনা পঞ্চায়েতের শ্রীনাথপুর গ্রামে এই কাজের উদ্বোধন করেন রাজ্যের খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক। উপস্থিত ছিলেন সেচমন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়, উদ্বাস্তু-পুনর্বাসন মন্ত্রী মঞ্জুলকৃষ্ণ ঠাকুর, স্বরূপনগরের বিধায়ক বীণা মণ্ডল, বনগাঁ দক্ষিণের বিধায়ক বিশ্বজিত্ সরকার প্রমুখ। |
বনগাঁর বেড়িগোপালপুর। ২০০৫ সালে সংস্কার হয়। এখন ইছামতীর অবস্থা। |
দু’টি পর্যায়ে এ বার ইছামতী সংস্কারের কাজ হচ্ছে। প্রথম পর্যায়ে বনগাঁ মহকুমার গাইঘাটার কালাঞ্চি থেকে বসিরহাট মহকুমার স্বরূপনগরের টিপি পর্যন্ত সাড়ে ১১ কিলোমিটার নদীপথের সংস্কার হবে। পরবর্তীতে টিপি থেকে বাদুড়িয়ার কাবিলপুর পর্যন্ত সংস্কারের কাজ হবে। নদীর বুক থেকে মাটি তুলে ফেলা হবে। নদীর পলি তুলে কমপক্ষে ৫০০ মিটার দূরে ফেলা হবে। নদীর গভীরতা যেখানে বেশি সেই সব অংশে ৫০ ফুট চওড়া করে কাটা হবে।
সেচমন্ত্রী বলেন, “অতীতে দেখা গিয়েছে, বর্ষার সময় সংস্কার প্রকল্পে নদী থেকে পলি তুলে পাড়া রাখার পর ফের তা জলে ধুয়ে নদীতে গিয়ে মিশত। ফলে সংস্কারের সুফল পেতেন না মানুষ। যা নিয়ে বিস্তর অভিযোগ ছিল নদীপাড়ের বাসিন্দাদের। এ বার সেই বিষয়টি নজরে রেখে বর্ষার আগেই যাতে কাজ শেষ করা যায় তা দেখা হবে। এর ফলে গাইঘাটা ও স্বরূপনগর ব্লকের এক লক্ষ মানুষ উপকৃত হবেন।
২০০৫ সালে গাইঘাটার কালাঞ্চি থেকে স্বরূপনগরের তেঁতুলিয়া পর্যন্ত ইছামতী সংস্কারের জন্য তদানীন্তন বামফ্রন্ট সরকার ২৫ কোটি টাকা খরচ করেছিল। সেই সময় তৃণমূল ও স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ ছিল, নদী থেকে কাটা মাটি পাড়ে রাখায় বৃষ্টিতে তা ধুয়ে ফের নদীতে মিশে যাওয়ায় সংস্কারের উদ্দেশ্যই বিফলে গিয়েছে। দীর্ঘদিন ধরেই স্থানীয় মানুষ নদিয়ার পাবাখালিতে ইছামতীর উত্সমুখ সংস্কারের দাবি জানিয়ে আসছেন। এ ব্যাপারে সেচমন্ত্রী জানান, এ জন্য কেন্দ্রের কাছে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। সেচ দফতরের মুখ্য বাস্তুকার দিল্লিতে রয়েছে। তিনি ফিরলে বিষয়টির অগ্রগতি সম্পর্কে জানা যাবে। |
বনগাঁর কালাঞ্চি। যে অংশে এ বার সংস্কার হচ্ছে। |
পূর্ব অভিজ্ঞতা খারাপ হলেও ইছামতী নদী সংস্কার সহায়তা কমিটির পক্ষ থেকে অবশ্য রাজ্য সরকারের এই উদ্যোগকে স্বাগত জানানো হয়েছে। কমিটির সম্পাদক সুভাষ চট্টোপাধ্যায় বলেন, “কালাঞ্চি থেকে টিপি পর্যন্ত সংস্কারের ফলে নীচের দিকে জল বের হওয়ার সুবিধা হবে। তেমন হলে ইছামতী সংলগ্ন এলাকার মানুষ বন্যার হাত থেকে রেহাই পাবেন।” রাজ্য সরকার টিপি থেকে কোতলপুর এবং নদীর উত্সমুখ পাবাখালি থেকে ভাজনঘাট পর্যন্ত সাড়ে ১৯ কিলোমিটার নদীপথ সংস্কারে যে ভাবে উদ্যোগী হয়েছে তাতে সুভাষবাবুর আশা, কাজ ঠিকমতো হলে ইছামতী তার আগের অবস্থা অনেকটাই ফিরে পাবে। জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক বলেন, “কালাঞ্চি থেকে টিপি পর্যন্ত ইছামতীর সংস্কারের জন্য বাম আমলে বহুবার দাবি জানিয়েছিলাম। কিন্তু কাজ হয়নি। মুখ্যমন্ত্রী তাঁর প্রতিশ্রুতিমতো এই কাজে উদ্যোগী হয়েছেন। শুধু পলি তোলাই নয়, নদীর বুক থেকে কচুরিপানা-সহ সব রকম বাধা (মাছ ধরার ভেচাল, কোথাও কোথাও প্রবাহ আটকে চাষাবাদ) সরিয়ে ফেলা হবে।” তিনি আরও বলেন, “টিপিতে আগের বাম সরকার ৪৪ লক্ষ টাকা খরচ করে টিপি পার্ক তৈরি করেছিল। এটা অর্থের অপচয় ছাড়া আর কিছু নয়। কী উদ্দেশ্য এটা তৈরি হয়েছিল তা নিয়ে তদন্ত করবে রাজ্য সরকার। আমরা অতীত থেকে শিক্ষা নিয়েছি। তাই নদীর পলি যতটা সম্ভব দূরেই ফেলার ব্যবস্থা হচ্ছে।”
ইছামতী সংস্কার নিয়ে বর্তমান সরকারের উদ্যোগ কতটা সফল হয় সেটাই এখন দেখার।
|