পশ্চিমবঙ্গ পরিকাঠামো উন্নয়ন ও বিত্ত নিগমের ১২০ কোটি টাকা তছরুপের তদন্তে নেমে এক ব্যাঙ্ক ম্যানেজারকে গ্রেফতার করল লালবাজারের গোয়েন্দা বিভাগ। বুধবার এই তছরুপের অভিযোগ দায়ের করেন নিগমের চেয়ারম্যান অভিরূপ সরকার। তাঁর অভিযোগের ভিত্তিতে রাতেই তল্লাশি শুরু হয় শহরের নানা প্রান্তে। বৃহস্পতিবার সকালে এই ঘটনার সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগে গ্রেফতার করা হয় ইউকো ব্যাঙ্কের ওই ম্যানেজারকে।
বৃহস্পতিবার কলকাতা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (অপরাধ দমন) পল্লবকান্তি ঘোষ বলেন, “তদন্ত হচ্ছে। ইউকো ব্যাঙ্কের সার্কাস অ্যাভিনিউ শাখার ম্যানেজার অ্যালয়েস লাকড়াকে গ্রেফতার করা হয়েছে।” তদন্তকারীদের মতে, এই ঘটনার শিকড় আরও গভীরে। এর আগে রাজ্য বিপণন পর্ষদের ১৭ কোটি টাকা এবং পশ্চিমবঙ্গ প্রাণী ও মৎস্যবিজ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫ কোটি টাকাও একই ভাবে গায়েব হয়েছিল বলে জানান তদন্তকারীরা। এর মধ্যে পুলিশ বিপণন পর্ষদের মামলায় ৬ জনকে গ্রেফতারও করে।
বিত্ত নিগমের পক্ষ থেকে কী অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে?
লালবাজারের এক গোয়েন্দাকর্তা বলেন, “সার্কাস অ্যাভিনিউয়ের ইউকো ব্যাঙ্কে নিগম দু’দফায় ১২০ কোটি টাকার (৫৯ কোটি ও ৬১ কোটি) এফডি করে। সেই সার্টিফিকেটও দেওয়া হয় তাদের। পরে দেখা যায়, সেগুলি জাল। নিগমের টাকা অন্য একটি সংস্থার অ্যাকাউন্টে চলে গিয়েছে।”
পুলিশ সূত্রের খবর, সব ক্ষেত্রেই ব্যাঙ্কের প্রতিনিধি সেজে বিভিন্ন সরকারি সংস্থার কর্তাদের কাছে হাজির হয় প্রতারকেরা। তার পর বেশি সুদের টোপ দিয়ে টাকা এফডি করতে বলে। টাকা স্থানান্তরের জন্য একটি অ্যাকাউন্ট নম্বরও দেয় তারা। পরে একটি এফডি সার্টিফিকেটও দিয়ে যায় তারা। কয়েক মাস পরে জানা যায়, সার্টিফিকেটগুলি জাল। তত দিনে পুরো টাকাটাই গায়েব হয়ে গিয়েছে। |
কী ভাবে ধরা পড়ল নিগমের এই জালিয়াতির ঘটনা?
লালবাজারের একটি সূত্র জানাচ্ছে, বছরের শেষে ব্যাঙ্কের সঙ্গে সমন্বয় করে ‘ব্যাঙ্ক রিকনসিলিয়েশন স্টেটমেন্ট’ তৈরি করে নিগম। সেখানে সারা বছরের যাবতীয় হিসেবনিকেশ থাকে। তখনই এফডি জালিয়াতির কথা জানতে পারে নিগম। যদিও অন্য একটি সূত্রের খবর, ব্যাঙ্ক জালিয়াতি নিয়ে নজরদারি চালানোর সময় ইউকো ব্যাঙ্ক ও ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার মধ্যে কিছু সন্দেহজনক লেনদেন চোখে পড়ে গোয়েন্দাদের। সেটি থেকেই ঘটনার প্রথম সূত্র মেলে।
বুধবার বিকেলে নিগমের চেয়ারম্যান অভিরূপ সরকার কলকাতার পুলিশ কমিশনার সুরজিৎ করপুরকায়স্থের সঙ্গে দেখা করে বিষয়টি জানান। হেয়ার স্ট্রিট থানায় একটি এফআইআর দায়ের করা হয়। তদন্তে নামে লালবাজারের ব্যাঙ্ক জালিয়াতি দমন শাখা। পুলিশ সূত্রের খবর, রাতেই শহরের নানা প্রান্তে হানা দেন তদন্তকারীরা। এ দিন বিকেল পর্যন্ত অন্তত ২০০টি ভুয়ো অ্যাকাউন্টের হদিস মিলেছে। একটি সূত্রের খবর, বিষয়টি নিয়ে খোঁজখবর নিচ্ছে সিবিআইয়ের আর্থিক অপরাধ দমন শাখাও। এক পুলিশকর্তার কথায়, “সাধারণত ২০ কোটি টাকার বেশি ব্যাঙ্ক জালিয়াতির ঘটনা ঘটলে সিবিআই খোঁজখবর নেয়।”
প্রশ্ন উঠেছে, ওই ব্যাঙ্কেই কেন এফডি করা হল? কেনই বা এত দিন ঘটনার কথা জানতে পারল না নিগম?
অভিরূপবাবুর বক্তব্য, “ইউকো ব্যাঙ্কের ওই শাখা সব থেকে বেশি সুদের প্রস্তাব দিয়েছিল।” তিনি বলেন, “তিন বছরের জন্য স্থায়ী আমানতে (এফডি) বিনিয়োগ করা হয়েছিল। মেয়াদ শেষে সুদ-সহ টাকা ফেরত দেওয়ার কথা ছিল। তাই অ্যাকাউন্ট সম্পর্কে বিশদ খোঁজ নেওয়া হয়নি।”
তবে এর বাইরেও একটি প্রশ্ন ভাবাচ্ছে তদন্তকারীদের। তাঁরা বলছেন, “গত জানুয়ারি মাসে বিপণন পর্ষদ ও প্রাণী বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন ঘটনা ঘটেছে। তার পরেও টনক নড়েনি প্রশাসনের।” দফায় দফায় কেন সরকারি সংস্থার কোটি কোটি টাকার জালিয়াতির ঘটনার অভিযোগ করা হচ্ছে, সেই প্রশ্ন নিয়েও নাড়াচাড়া করছেন গোয়েন্দারা।
তদন্তকারীদের একাংশ বলছেন, এমন জালিয়াতির ঘটনা আরও হয়েছে। সেগুলি হয়তো ভবিষ্যতে সামনে আসবে। তদন্তকারীদের অনুমান, বিপণন পর্ষদের মামলায় ধৃতদের সঙ্গে এই ঘটনার যোগসূত্র থাকতে পারে। এ দিনই জেলে গিয়ে তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ করেন গোয়েন্দারা। ঘটনাটি জানার পর নড়েচড়ে বসেছে নিগম। সূত্রের খবর, বৃহস্পতিবার তাদের ‘বোর্ড মিটিং’-এ বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। |