|
|
|
|
আনন্দplus এক্সক্লুসিভ |
মিমোর বাড়িতে
তিনটে মার্সেডিজ। ছাপ্পান্নটা কুকুর। কলকাতা থেকে নিয়ে যাওয়া ফুলের তৈরি বাগান।
এই প্রথম সংবাদ মাধ্যমের সামনে মুম্বইয়ের মাড আইল্যান্ডের ‘মিমো কটেজ’
খুলে দিলেন ছেলের বাবা। দেখে এলেন অরিজিৎ চক্রবর্তী |
মিমোর বাড়ির বাইরে কোথাও কোনও নামফলক নেই।
‘মন্নত’ বা ‘প্রতীক্ষা’র মতো জিপিএস ম্যাপও ‘মিমো কটেজ’-এর লোকেশন দেখায় না।
তবে আনন্দ প্লাসের প্রতিনিধি এসেছে শুনে তিন মিনিটের মধ্যেই সপুত্র দেখা করলেন মিমো চক্রবর্তীর বাবা। লোকে যাঁকে ভালবেসে বলে মিঠুন চক্রবর্তী।
তিন একরেরও বেশি এই ফার্ম হাউজের লোহার গেট তেমন স্টার সুলভ নয়। যদিও ওই গেটের পিছনে দাঁড়িয়ে পাঁচটা বিদেশি গাড়ি। সামনেই রঙবেরঙের ফুলের বাগান। বাঁ-পাশে সবজি বাগান। জাল দিয়ে ঘেরা একটা বড় জায়গায় ছেড়ে রাখা পাখি।
আপ বাহার কিঁউ আয়ে
নামেই মুম্বই। যদিও ‘মিমো কটেজ’-এর সর্বত্র ছড়িয়ে বাঙালিয়ানা। প্রথম দেখায় তো মনে হবে কোনও বাঙালি উচ্চবিত্তের বাগানবাড়িতে ঢুকে পড়েছেন। হবে নাই বা কেন! বাগানের গাছ-গাছালির বীজ প্রায় সবই তো কলকাতা থেকে কেনা। গত রবিবারেও কলকাতা থেকে কিনে এনেছেন হাজার কুড়ি টাকার বীজ।
মাড আইল্যান্ডের ‘মিমো কটেজে’র সিটিং রুমে তখন বসে। স্বাভাবিক কৌতূহলে দরজা খুলে বাইরে বেরোতেই রে রে করে এল একজন, “আপ বাহার কিঁউ আয়ে। সব কুত্তা খুল্লা ছোড়া হ্যায়। কাট দেগা।” তার মানে মুম্বইয়ের এই বাড়িই তাঁর ‘৫৬ জন চারপেয়ে বন্ধু’র সঙ্গে মিঠুন চক্রবর্তী পরিবারের অফিশিয়াল ঠিকানা। |
বুলডগ ‘পার্টনার’য়ের সঙ্গে মিমো। |
উটির বাড়ি, হোটেল, স্কুল ছেড়ে মুম্বইতে পাকাপাকি চলে আসা। কারণটা কী? ছেলে মিমোর কেরিয়ার? তাও আবার এমন বাগান ঘেরা ছোট কটেজে! নাকি মিঠুন চক্রবর্তীর এ এক প্রকার বানপ্রস্থ! “উটিতে যাওয়া ছেলে-মেয়ের ভবিষ্যতের জন্য। কেউ তো সারা জীবন স্টার হয়ে থাকতে পারবে না। যত বড় তারকাই হও না কেন একদিন স্টারডম কমবেই। তাই উটির হোটেল ব্যবসা, স্কুল। এখন মিমো বড় হয়েছে। সিনেমা করছে। মুম্বইতে থাকাই ওর কেরিয়ারের পক্ষে ভাল,” জানালেন মিঠুন চক্রবর্তী।
কিন্তু তা বলে শহর থেকে এত দূর? এয়ারপোটর্র্ থেকেই তো ঘণ্টা দেড়েক লেগে যায় আসতে? “আমার তো কোনও অসুবিধা মনে হয় না। এমনিতেই বাবা শহরে থাকতে পারবে না। লোকের সব সময়ের অ্যাটেনশন বাবার অসহ্য লাগে। এখানেই বাবা শান্তিতে থাকে। বাগান করে। কুকুর-পাখিদের নিয়ে মেতে থাকে। শহরে থাকলেও তো ট্র্যাফিক জ্যামে আটকে থাকতে হতে পারে আধ ঘণ্টা,” স্পষ্ট জানালেন মিমো ওরফে মহাক্ষয় চক্রবর্তী।
মিঠু ছেলে হিসাবে গর্বিত, কিন্তু...
যাঁর কেরিয়ারের জন্য চক্রবর্তী পরিবারের মুম্বইয়ের স্থায়ী বাসিন্দা হওয়া, সেই মিমোর কেরিয়ারের ওপেনিং ইনিংস কিন্তু বেশ নড়বড়ে ছিল। অডিশনে অডি করে যাওয়া। মার্সেডিজ কিংবা জাগুয়ার। গ্যারাজে সবই ছিল। কিন্তু ২০১১য় ‘হন্টেড থ্রি ডি’র আগে বক্স অফিসে কোনও সাফল্য ছিল না। বাবার সঙ্গে তো বটেই, ছিল আর এক স্টার পুত্র অভিষেক বচ্চনের সঙ্গে তুলনাও। “হ্যাঁ, জানি সময়টা খুব খারাপ যাচ্ছিল। কিন্তু ২০০৮-এ যখন ‘জিমি’ রিলিজ করে তখন আমি টিনএজার। জানতাম না কোন ছবি করব। কোনটা করা ঠিক নয়। আই ওয়াজ ইগার টু ডু এনি ফিল্ম। বাবা কোনও দিন আমার হয়ে কাউকে ফোন করেনি। মেক আপ ভ্যানের বাইরে বসে থেকেছি। বাবা-মায়ের থেকে এই শিক্ষাটা পেয়েছিলাম যে, পরিশ্রমের বিকল্প নেই। তার রিটার্নে যে রেসপেক্টটা পাব সেটা আমারই। আমি মিঠুন চক্রবর্তীর ছেলে হয়ে গর্বিত। কিন্তু স্টারের ছেলে হওয়ার কিছু ব্যাগেজও থাকে,” মিমো বললেন। “আ ব্যাড ব্যাগেজ। আমার মনে হয়, স্টারের ছেলে হওয়া অভিশাপ,” ছেলের কথার রেশ ধরে বললেন মিঠুন। যোগ করলেন, “সুবিধা হল তোমার খাওয়ার কোনও চিন্তা থাকবে না, গ্যারেজে দামি গাড়ি থাকবে। কিন্তু প্রতি পদে পদে লোকে তোমাকে বাবার সঙ্গে মাপবে। অভিনয় ছাড়ুন, লোকে তো বলবে মিঠুনের মতো হাঁটতেও পারে না মিমো।”
মিমো কিন্তু অনেকটা পথ নিজেই হেঁটেছেন। বলিউডের পাশাপাশি অভিনয় করেছেন বাংলা সিনেমাতেও। ভেঙ্কটেশ ফিল্মসের ব্যানারে সুজিত মণ্ডলের ছবি ‘রকি’। এটাই তাঁর প্রথম বাংলা ছবি। এই প্রথম পর্দায় নাচ বাবার সঙ্গে। কেমন ছিল ‘ডিস্কো ডান্সার’-এর সঙ্গে নাচার অভিজ্ঞতা? “ওহ্, এ তো স্বপ্ন সত্যি হওয়া! এখন তো খালি নাচ শেখার হিড়িক। ‘রকি’তে বাবাকে সেটে নাচতে দেখে বুঝলাম নাচ শেখা যায় না, শুধু ফিল করতে হয়। আর বাবা এত দিন সেটাই করে এসেছে।” আর ছেলের নাচ সম্বন্ধে বাবার কী অভিমত? “মিমো আমার থেকে অনেক ভাল নাচে। আমাদের সময় এক রকম ট্রেন্ড ছিল। এখন অন্য। এখন মিমো আমাকে হামেশাই হারিয়ে দেবে,” বললেন ‘ডিস্কো ডান্সার’-এর ‘জিমি’। |
নিজের তৈরি বাগানে মিঠুন চক্রবর্তী |
আজ কাজ, কাল পার্টি
লোকে তো সেটাই চায়। স্টারদের মধ্যে তুলনা। স্টারের সঙ্গে ছেলের তুলনা। এমনকী কাটাছেঁড়া করবে তার জীবন নিয়ে। কার সঙ্গে প্রেম করে? কোন ক্লাবে পার্টি করে? “বাবা কিন্তু পার্টিতে একদমই যায় না। মনে আছে আমেরিকায় একটা শোতে গিয়েছে বাবা। বাবা এগারোটার মধ্যেই খাবার-দাবার নিয়ে হোটেলে ফিরে এল। শুধু আমাদের সঙ্গে সময় কাটাবে বলে,” জানালেন মিমো। বাবা না হয় পার্টি করেন না। কিন্তু ছেলে? মিমোকেও তো খুব একটা পার্টিতে দেখা যায় না। সেটা কি স্বেচ্ছায়? নাকি বাবার অনুশাসন?
মিমো বললেন, “অ্যাক্টিংয়ের কোর্স করতে তখন লস এঞ্জেলেসে। ওখানে তো প্রতিদিন পার্টি। বাবা আমার সঙ্গে ছিল। আমার ইচ্ছে হত পার্টিতে যাওয়ার কিন্তু যেতে পারতাম না। সপ্তাহখানেক পরে বাবা টের পেল আমার ইচ্ছে। আমাকে ডেকে বললেন, ‘আজ তুমি পার্টিতে যেতেই পার। কিন্তু নিজে ঠিক করে নাও কী করবে। আজ পার্টি করবে আর ছোটখাটো কোনও চাকরি করে জীবন কাটাবে, নাকি আজ নিজের সর্বস্ব নিংড়ে দেবে আর কাল লোকে তোমাকে পার্টিতে নিয়ে যাওয়ার জন্য পাগল করে দেবে?’ সে দিনই ঠিক করে নিয়েছিলাম আজ কাজ, কাল পার্টি।’”
এক ঘণ্টা=চার ঘণ্টা
সেই অনুশাসন ‘মিমো কটেজ’-এর সর্বত্র। এখনও প্রতিদিন ভোর তিনটেয় ওঠেন মিমো। নিজের ঘর নিজেই পরিষ্কার করেন। সেটাও বাবার থেকেই শেখা। কোনও কাজে অন্যের উপর নির্ভরশীল না হওয়া। মিক্সড মার্শাল আর্টের ট্রেনিংও সেই অনুশাসনেরই অংশ। কিন্তু সারা বাড়ির কোথাও তো সে অর্থে কোনও জিম দেখা গেল না। “আমি তো ওয়েট ট্রেনিং করি না। তাই জিমেরও কোনও প্রয়োজন হয় না। যেটা করি সেটা হল এমএমএ ট্রেনিং। তাও ওই ঘণ্টাখানেক,” বললেন মিমো। “এমএমএ ট্রেনিংয়ে এক ঘণ্টা মানে কিন্তু সাধারণ জিমে চার ঘণ্টা কাটানোর সমান,” হাসতে হাসতে যোগ করলেন মিঠুন।
মিঠুনও তেমন জিমভক্ত নন। কাজের ফাঁকে চুটিয়ে চালাচ্ছেন হবি। পোষ্যদের দেখভাল করা। বাগান করা। “বাবা মালিদের কেমন ডিটেলড ইনস্ট্রাকশন দেয়, দেখে অবাক হয়ে যাবেন,” বললেন মিমো।
ট্যুইটার-স্যুইটার-গাটার
বাড়ির পিছনে দু’টো পুরোনো গাড়ি। সিলভার মার্সেডিজ আর হলুদ ফোক্সভাগেন বিটল। জীবনের প্রথম কেনা গাড়ি দু’টো এখনও রেখে দিয়েছেন। “বিটলটা যখন কিনি, মুম্বইতে তখন আমার কোনও বাড়ি ছিল না। কোনও কন্সট্রাকশন সাইটের গার্ডকে টাকা দিয়ে সেখানে পার্ক করতাম। তার পর গাড়ির মধ্যেই ঘুমাতাম,” বিটলটা দেখিয়ে মিঠুন বললেন। মিমোকে তাঁর ছাব্বিশ বছরের জন্মদিনে উপহার দিয়েছেন মার্সেডিজ এসএল ক্লাস রোডস্টার। দু’জনেই গাড়ি নিয়ে আগ্রহী। আগ্রহী ইউএফসি (আলটিমেট ফাইটিং চ্যাম্পিয়নশিপ) নিয়েও। |
কটেজের সামনে মিমো-মিঠুন |
অবশ্য আর একটা বিষয়েও অদ্ভুত মিল দু’জনের। কেউই সোশ্যাল মিডিয়া সাইটে যুক্ত নন। মিমো বললেন, “আমি তো তিন বছর হল ফেসবুক করা ছেড়ে দিয়েছি। বাবা বলেছিল, এ ভাবে নিজের এনার্জি ক্ষয় করে দেওয়ার মানে হয় না।” কিন্তু সেটা আগের জেনারেশনের কম্পিউটারে অ্যালার্জি নয় তো? “কী বলছেন কী! ভাইয়ের জন্য বাবা কম্পিউটারে ভিডিও এডিটিং সফটওয়ার ইন্সটল করে দেয়,” জানালেন মিমো।
তা হলে এই ফেসবুক-ট্যুইটার বিরোধিতার কারণ কী? “সব সোশ্যল সাইটই তো অন্যকে ইমপ্রেস করতে। আমি কাউকে ইমপ্রেস করতে চাই না। ট্যুইটার যাবে স্যুইটার আসবে। সেটা চলে গেলে গাটার আসবে। আমি ও সবে নেই। আর থেকেই বা কী হবে? কোনও ভাল চিন্তার কথা লিখলে ক’জনেই বা বুঝবে!” বললেন মিঠুন। বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আবার বললেন, “সবাই কন্ট্রোভার্সি চায়, স্কুপ চায়। আমি দিতে পারব না। কেউ যদি ওই ভিতরকার জার্নিটা বুঝতে চায়, শুধু স্ট্রাগল নয়, বহু বছর আগে ৯ সেপ্টেম্বর হাওড়া স্টেশন থেকে মুম্বইয়ে যাত্রা করা ছেলেটার দ্য জার্নি ইনসাইড। সেটা বলতে চাই।”
তা মিমো কখনও কলকাতার ২০সি মথুর সেন গার্ডেন লেনে গিয়েছেন? তাঁর বাবার আদি বাসস্থানে? “অনেক বার। প্রথম যাই লস এঞ্জেলেসে যাওয়ার আগে। বাবা বলেছিল ওখান থেকে ঘুরে আসতে। দ্যাট ওয়াজ আ আই ওপেনার। এক সপ্তাহ বিশ্বাসই করতে পারিনি বাবা ওখানে বড় হয়েছে। পরে অনুভব করেছিলাম স্ট্রাগল একজনকে কোথায় নিয়ে যেতে পারে!”
|
‘অনেক স্মৃতি এই বাড়িতে’ |
মুম্বই শহরের এই ট্রাফিক, হর্নের আওয়াজ, চেঁচামেচি এড়াতেই ১৯৮৪তে মাড আইল্যান্ডে এই বাড়িটা কিনি।
তখন কিনেছিলাম দেড় একর। তার পর বাকি দেড় একর জায়গাটা কিনে নিই ১৯৯৩ সালে।
আগে যখন মুম্বইতে থাকতাম নিয়মিত, তখনও এটাই ছিল আমার ঠিকানা। মনে আছে, সপ্তাহে পাঁচ দিন এই বাড়িতেই থাকতাম। আর বাকি দু’দিন বান্দ্রার ফ্ল্যাটে।
কত দারুণ সময় কাটিয়েছি। অনেক স্মৃতি এই বাড়িতে। মনে আছে ‘ইলাকা’ ছবির সময় মাধুরী দীক্ষিতের সঙ্গে কাজ করার আগে মাধুরীকে লঞ্চ করিয়েছিলাম এই বাড়িতে বিরাট পার্টি দিয়ে। |
জীবনের প্রথম কেনা গাড়ি ‘বিটল’য়ের পাশে |
আজকে আমি এখানে আমার বন্ধুদের সঙ্গে ভাল আছি পাখি আর কুকুর। আমি অবশ্য ওদের ওই নামে ডাকি না। পাখিরা আমার ‘উইং ফ্রেন্ডস’ আর কুকুররা আমার ‘ফোর লেগেড ফ্রেন্ডস’। ওদের সঙ্গে খেলা করি। গাছের সঙ্গে কথা বলি। মাঝে মাঝে মনে হয় মুম্বইতে এই বাড়িটা না থাকলে মি পাগল হয়ে যেতাম। এই বাড়িটা, প্রকৃতির সঙ্গে এই থাকাটা, আমায় বাঁচতে সাহায্য করে।
|
ছবি: অরিজিৎ চক্রবর্তী |
|
|
|
|
|