এত দিন সাধারণ মানুষ বা প্রতিষ্ঠানের দানে চলত মুখ্যমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল। এ বার একেবারে সরকারি কোষাগার থেকেই টাকা জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে ওই তহবিলে। এই বেনজির নির্দেশে বিস্মিত সরকারি কর্তাদেরই একাংশ। তাঁদের কথায়, সাধারণ মানুষের করের টাকা ত্রাণ তহবিলে জমা পড়ার ঘটনা আগে কখনও ঘটেনি। করের টাকা কেনই বা খয়রাতিতে ব্যয় হবে, সেই প্রশ্নও তুলেছেন তাঁরা।
মার্চের ২ তারিখে মন্তেশ্বরের ‘বঞ্চিত’ চাষিদের ক্ষতিপূরণের চেক দিয়ে মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, “ত্রাণ তহবিলের সব টাকা শেষ হয়ে গেল।” তার ৭২ ঘণ্টার মধ্যে, ৫ মার্চ বাজেট বরাদ্দের পরিকল্পনা বহির্ভূত খাত থেকে ১ কোটি টাকা মুখ্যমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে জমা করার নির্দেশ জারি করেছে রাজ্য স্বরাষ্ট্র দফতর। ঘটনাচক্রে মুখ্যমন্ত্রীর নিজের হাতেই রয়েছে ওই দফতর।
কী বলা হয়েছে ওই নির্দেশে?
রাজ্য স্বরাষ্ট্র দফতরের কো-অর্ডিনেশন শাখার জারি করা নির্দেশে বলা হয়েছে, ওই দফতরের এক জন সহকারী সচিবের নামে কোষাগার থেকে ১ কোটি টাকা তোলার অনুমোদন দিচ্ছে অর্থ দফতর। ওই টাকা জমা করার জন্য একটি নতুন অ্যাকাউন্টও খোলা হয়েছে। সহকারী সচিবকে ডিলিং অ্যান্ড ডিসবার্সিং অফিসারের (ডিডিও) ক্ষমতা দিয়ে অর্থ দফতর বলেছে, সংশ্লিষ্ট অফিসার অনুমোদিত অর্থ তুলে অ্যাকাউন্ট পেয়ি চেকের মাধ্যমে ওই টাকা মুখ্যমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে জমা দেবেন। রাজ্য প্রশাসনের অফিসারেরা বলছেন, সরকারি তহবিলের ১ কোটি টাকা যাতে সরাসরি মুখ্যমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে জমা পড়ে, সেই জন্যই ঘুরপথে এই নির্দেশ জারি করেছে রাজ্য স্বরাষ্ট্র দফতর। |
ইতিমধ্যেই ওই নির্দেশ নিয়ে গুঞ্জন শুরু হয়েছে মহাকরণে। প্রশ্ন উঠেছে, সরকারি তহবিলের টাকা আদৌ এ ভাবে মুখ্যমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে জমা করা যায় কি? স্বরাষ্ট্র দফতরের নির্দেশ কি সরকারি বিধি লঙ্ঘন করছে না?
উত্তর খুঁজতে গিয়ে দু’রকম মত মিলেছে মহাকরণে। রাজ্য প্রশাসনের একাংশের বক্তব্য, সরকারি কোষাগার থেকে টাকা তুলে তা মুখ্যমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে জমা করা যাবে না, রাজ্যের অর্থ সংক্রান্ত বিধিতে নির্দিষ্ট ভাবে এমন কিছু বলা নেই। আর মুখ্যমন্ত্রীই যে হেতু প্রশাসনের প্রধান, তাই তাঁর সরকারের এক তহবিল থেকে অন্য তহবিলে টাকা পাঠানোয় ‘অন্যায়’ দেখছেন না ওই অফিসারেরা। তবে বিষয়টি যে প্রথা বহির্ভূত এবং নজিরবিহীন, সে কথা কবুল করেছেন তাঁরা।
সরকারের এই বেনজির পদক্ষেপ নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন রাজ্য প্রশাসনের অন্য একটি অংশ। তাঁদের বক্তব্য, সাধারণ ভাবে ত্রাণ তহবিল চলে দানের টাকায়। বিভিন্ন সময়ে অনেকেই স্বেচ্ছায় মুখ্যমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে টাকা দান করেন। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সময়ে বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকেও ত্রাণ তহবিলে টাকা জমা করা হয়। সেই টাকায় বিপর্যয়ে ত্রাণ বিলি করা ছাড়াও বছরভর গরিবদের শিক্ষা ও চিকিৎসার প্রয়োজনে টাকা দেওয়া হয়। মহাকরণের এক কর্তা বলেন, “বাম আমলে ত্রাণ তহবিলে টাকা কমে গেলে দলীয় সংগঠন বা শাখা সংগঠনগুলিকে ঘাটতি পুরণ করার জন্য দলের তরফেই বলা হত।
দলের কর্মীরা টাকা তুলে জমা দিতেন তহবিলে।”
কিন্তু এ বার সেই ঘাটতি মেটানোর দায়িত্ব নিয়েছে সরকারি কোষাগারই। এবং তাতে হাত পড়া মানেই যে সাধারণ মানুষের করের টাকায় ভাগ বসানো, তা মানছেন অর্থ দফতরের কর্তারাই। ওই অফিসারদের যুক্তি, রাজস্ব আদায়ের মাধ্যমেই সরকারি কোষাগার ফুলেফেঁপে ওঠে। পরিকল্পনা বা পরিকল্পনা বহির্ভূত, যে খাতেই সরকার অর্থ বরাদ্দ করুক, তা সাধারণ মানুষের কাছ থেকে আদায় করা করেরই টাকা। সেই টাকায় দান-খয়রাতি করা কোনও ভাবেই সঙ্গত হতে পারে না। রাজ্য স্বরাষ্ট্র দফতরের এক কর্তা বলেন, “কিন্তু উপর মহল নির্দেশ দিলে তা মেনে চলা ছাড়া কী-ই বা করার আছে?” মুখ্যমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল যে হেতু করের টাকায় চলে না, তাই তার অর্থ খরচের ক্ষেত্রে সরকারি বিধি প্রয়োগের কোনও বাধ্যবাধকতা নেই বলে মত ওই অফিসারদের। রাজ্য প্রশাসনের একাধিক কর্তা বলেন, “করের টাকায় বিভিন্ন দফতরের বাজেট বরাদ্দ হয়। তাই ওই অর্থ খরচের নির্দিষ্ট বিধি আছে সরকারি আইনে। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী নিজের ত্রাণ তহবিলের টাকা কী ভাবে খরচ করবেন, তার কোনও নির্দিষ্ট বিধি নেই। এমনকী, ত্রাণের সংজ্ঞা ঠিক করার ক্ষমতাও তাঁর।” মহাকরণ সূত্রের খবর, ক্ষমতায় এসে নিজের আঁকা ছবি বিক্রির ১ কোটি টাকা মুখ্যমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে দান করার ঘোষণা করেছিলেন মমতা। তার পরে বেশ কিছু সংগঠন টাকা জমা করলেও আয়ের চেয়ে ব্যয় এত বেড়ে গিয়েছে যে তহবিলের অর্থ একেবারে তলানিতে এসে ঠেকেছে। এবং সেই ঘাটতি পূরণ করতেই শেষ পর্যন্ত করের টাকায় ভাগ বসাতে হচ্ছে বলে মত রাজ্য প্রশাসনের একাংশের। বিরোধীদের অভিযোগ, খয়রাতিতেই কোটি টাকা গলে যাচ্ছে। পরিকল্পনা খাতের টাকা তুলে পরিকল্পনা বহির্ভূত খাতে খরচ করা হচ্ছে। কোনও আর্থিক শৃঙ্খলা মানছে না সরকার।
বিরোধীদের সুরে রাজ্য প্রশাসনেরও একাংশ বলছেন, মন্তেশ্বরের যে ১৬৬ জন ‘বঞ্চিত’ চাষির হাতে নিজের ত্রাণ তহবিল থেকে ৪৫ লক্ষ টাকার চেক তুলে দিয়ে এলেন মুখ্যমন্ত্রী, সেই টাকা তো অভিযুক্ত চালকল কর্তৃপক্ষের দেওয়ার কথা। কিন্তু আইনি পথে তাদের টাকা দিতে বাধ্য না করে ‘ক্ষতিপূরণ’ দেওয়ার মাধ্যমে খয়রাতির পথেই হাঁটল সরকার। প্রশ্ন উঠেছে, পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে আরও কিছু খয়রাতির জন্যই কি সরকারি কোষাগারের টাকায় ত্রাণ তহবিলের সঞ্চয় বাড়ানো হল? |