ট্রেড লাইসেন্স নিয়ে অনিয়মের মৌচাকে মুখ্যমন্ত্রী ঘা দিতেই নড়েচড়ে বসলেন পুর-কর্তৃপক্ষ। জানা গেল, বিনা লাইসেন্সে ব্যবসা চালানোয় বছরে প্রায় এক কোটি ৮০ লক্ষ টাকা করে ক্ষতি হচ্ছে পুরসভার। আরও জানা গেল, ইনস্পেক্টর নয়, ট্রেড লাইসেন্স দেন এক শ্রেণির গোমস্তা (বেইলিফ)। গত ১২ বছর ধরে এটাই চলছে কলকাতা পুরসভায়।
সূর্য সেন মার্কেটে অগ্নিকাণ্ডের মোকাবিলায় সাহসীদের সম্মানিত করার অনুষ্ঠানে গিয়ে গত শনিবার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মন্তব্য করেছিলেন, “আগুন রোখার ব্যবস্থা নেই। ঢোকা-বেরোনোর ব্যবস্থা নেই। মোটা টাকা দিয়ে পুরসভা থেকে ট্রেড লাইসেন্স বেরিয়ে যাচ্ছে।” এর পরেই টনক নড়ে পুর-প্রশাসনের।
মুখ্যমন্ত্রীর ওই বক্তব্যের প্রেক্ষিতেই সম্প্রতি বাজারে লাইসেন্স দেওয়া নিয়ে বিশেষ বৈঠক করে পুর-প্রশাসন। পুরসভার মেয়র পারিষদ (বাজার) তারক সিংহ, পুর-কমিশনার খলিল আহমেদ, যুগ্ম পুর-কমিশনার (লাইসেন্স) অমরনাথ মল্লিক-সহ লাইসেন্স ও বাজার দফতরের আধিকারিক ও বেশ কয়েকটি বাজার সমিতির প্রতিনিধিরা ছিলেন সেখানে। বৈঠকের শুরুতেই মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্যের প্রসঙ্গ তুলে লাইসেন্স বিভাগের চিফ ম্যানেজার ভাস্কর ঘোষের কাছে লাইসেন্স নিয়ে বেনিয়মের কারণ জানতে চান কমিশনার। পুরসভা সূত্রের খবর, তখনই ভাস্করবাবু জানান, বিনা লাইসেন্সে বহু এলাকায় দোকান চালাচ্ছেন কিছু ব্যবসায়ী। যাঁদের থেকে লাইসেন্স ফি বাবদ কিছুই পায় না পুরসভা। তাই বছরে ওই টাকা ক্ষতি হচ্ছে পুরসভার।
কিন্তু বছরের পর বছর কী ভাবে ওই সব দোকান চলছে, তার কোনও ব্যাখ্যা অবশ্য দিতে পারেনি লাইসেন্স বিভাগ। এর পিছনে কার বা কাদের হাত রয়েছে, জবাব মেলেনি সে প্রশ্নেরও। পুর-কমিশনার বিষয়টি নিয়ে অবিলম্বে একটি রিপোর্ট চেয়েছেন। তারকবাবু বলেন, “বিনা লাইসেন্সে যাঁরা ব্যবসা করছেন, তাঁদের একটি তালিকা করতে বলা হয়েছে ভাস্করবাবুকে। রিপোর্ট পেলেই মুখ্যমন্ত্রীর কাছে পাঠানো হবে।”
পুরসভা সূত্রের খবর, ট্রেড লাইসেন্স দেওয়ার পদ্ধতি নিয়েও প্রশ্ন ওঠে এ দিনের বৈঠকে। গোমস্তাদের মাধ্যমে লাইসেন্স দেওয়ার কথা উঠতেই তা বদলানোর জন্য উদ্যোগী হয়েছে পুর-প্রশাসন।
পুরসভার লাইসেন্স বিভাগের এক ইনস্পেক্টর জানান, গত তৃণমূল বোর্ডের আমলে সুব্রত মুখোপাধ্যায় মেয়র থাকাকালীন শুরু হয় লাইসেন্স দেওয়ার এই প্রথা। আগে ইমস্পেক্টরেরাই ট্রেড লাইসেন্স দিতেন। তত্কালীন পুর-কমিশনার দেবাশিস সোম একটি সার্কুলার জারি করে নির্দেশ দেন, বেইলিফরা যে কোনও জায়গায় গিয়ে স্পট লাইসেন্স দিতে পারবেন। পুর-কমিশনারের পক্ষে তাঁরাই লাইসেন্সে সই করবেন। ওই ইনস্পেক্টরের কথায়, “লাইসেন্সের ক্ষেত্রে যে সব কাগজপত্র দেখা হত, এর পর থেকে ভাটা পড়ে তাতেও।” আর সেই ফাঁকেই বেআইনি ভাবে অনেক লাইসেন্স বেরিয়ে গিয়েছে বলে আশঙ্কা ওই অফিসারের।
এই বক্তব্য অবশ্য মানতে নারাজ তত্কালীন মেয়র তথা রাজ্যের বর্তমান পঞ্চায়েত ও জনস্বাস্থ্য কারিগরিমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়। তিনি বলেন, “তখন বহু দোকান বিনা লাইসেন্সে ব্যবসা চালাচ্ছিল। পুরসভার আয় বাড়াতেই বেইলিফদের স্পট লাইসেন্স দেওয়ার অধিকার দেওয়া হয়।” তাঁর আরও বক্তব্য, “বেইলিফ প্রথা তুলে দিলেই ঘুষ দিয়ে ট্রেড লাইসেন্স দেওয়ার রেওয়াজ উঠে যাবে, এ ধারণা যুক্তিহীন। আগেও তো ঘুষ দিয়ে লাইসেন্স দেওয়ার অভিযোগ উঠত। এ ব্যাপারে কী বলবেন পুর-কর্তারা?”
সুব্রতবাবুর শুরু করা প্রথায় পরবর্তী বাম বোর্ডও কাজ চালিয়েছে বলে খবর। যদিও তত্কালীন মেয়র বিকাশ ভট্টাচার্যের দাবি, “আমরা পুরসভায় আসার পরে দেবাশিস সোমের দেওয়া অনেক সার্কুলার বাতিল করি। তার মধ্যে বেইলিফের লাইসেন্স দেওয়ার বিষয়টিও ছিল।”
পুরসভা সূত্রের খবর, শহরে পুরসভার নিজস্ব বাজার ৪৬টি। বেসরকারি বাজার প্রায় সাতশো। মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে সব বাজারের পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে হবে পুরসভাকেই। পুর-প্রশাসন বাজার বিভাগে আরও এক জন চিফ ম্যানেজার নিযুক্ত করেছে। তারকবাবু বলেন, “কাজের সুবিধার জন্য কলকাতা উত্তর ও দক্ষিণে দু’জন চিফ ম্যানেজার নিয়োগ করা হল।” তিনি জানান, ইতিমধ্যেই তিনশোর বেশি বাজার পরিদর্শন হয়েছে। ১৮ তারিখ পর্যন্ত ওই কাজ চলবে। তার পরে জানা যাবে, কোন বাজারে আগুন রোখার ব্যবস্থা আছে বা কোন বাজারে রান্নাবান্না হয়। পুরসভা সূত্রের খবর, সব কিছু জানার পরে ২৫ মার্চ পুরসভায় ফের বৈঠক হবে। সেখানে চূড়ান্ত হবে বাজারগুলির ক্ষেত্রে কী ব্যবস্থা নেবে পুর-প্রশাসন।
ঘুষ দিয়ে ট্রেড লাইসেন্স বেরোনোর অভিযোগ মানতে নারাজ পুর-লাইসেন্স বিভাগ। বৈঠকে পুর-কমিশনারের উপস্থিতিতে এক অফিসার জানান, মুখ্যমন্ত্রীকে কেউ ভুল তথ্য দিয়েছেন। তাঁদের কোনও গাফিলতি নেই। |