ঘন কালো আকাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে অসংখ্য আলোর বিন্দু। কোনওটা উজ্জ্বল, কোনওটা আবার মিট্মিট্ করে জ্বলছে। আকাশে উঠেছে গোল থালার মতো পৃথিবী। তার আলোয় ঝলমল করছে চারপাশ। কচ্ছপের খোলের মতো দেখতে একটা বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলেন এক ব্যক্তি। পিঠে অক্সিজেন সিলিন্ডার, গায়ে মহাকাশচারীর পোশাক। জায়গাটা পৃথিবীর একমাত্র উপগ্রহ, চাঁদ।
কল্পবিজ্ঞানের গল্প কিংবা হলিউডি ফিল্মের দৃশ্য নয়। বরং বাস্তবেই এমন কিছু ঘটানোর চেষ্টা করছে ইউরোপীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ‘ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি’ (ইএসএ)। পিছিয়ে নেই নাসাও। চাঁদের মাটিতে মানুষের আস্তানা গড়তে উঠে পড়ে লেগেছে তারা-ও। তবে প্রাথমিক ভাবে আস্তানা বলতে তৈরি হবে গবেষণাগার।
কিন্তু কী ভাবে তৈরি হবে এই চাঁদের বাড়ি? বাড়ি বানানোর মালমশলা বয়ে নিয়ে যেতে হবে পৃথিবী থেকেই? বিজ্ঞানীরা বলছেন, ইট-বালি-সিমেন্ট, কিছুই নিয়ে যেতে হবে না পৃথিবী থেকে। বাড়ি বানাতে ব্যবহার করা হবে চাঁদেরই মাটি। আর এই কাজে লাগবে শুধু একটা থ্রি-ডি মুদ্রণ যন্ত্র (প্রিন্টার)। সেটি অবশ্য এই গ্রহ থেকেই মহাকাশযানে চাপিয়ে পাঠানো হবে চাঁদে। ইএসএ-র বিজ্ঞানী স্কট হোভল্যান্ড ই-মেলে বলেন, “এই যন্ত্রের সাহায্যে চাঁদের মাটি ব্যবহার করে বাড়ি বানানো যাবে। তাতে বাড়ি বানানোর রসদ পৃথিবী থেকে বয়ে নিয়ে যেতে হবে না। ফলে যাওয়ার বাড়তি বোঝাও কমে যাবে।” |
কী এই থ্রি-ডি মুদ্রণ যন্ত্র? গবেষকেরা জানান, থ্রিডি ছাপার যন্ত্রে কোনও ত্রিমাত্রিক বস্তুর হুবহু প্রতিলিপি তৈরি করা যায়। এই থ্রিডি বা ত্রিমাত্রিক মুদ্রণে কাগজ কিংবা কাপড় লাগে না। ছাপা বলতে কাগজের উপর সারি সারি অক্ষরমালাও নয়। এমন ছাপা যার দৈর্ঘ্য, প্রস্থও, উচ্চতা আছে। থ্রি-ডি মুদ্রণ যন্ত্রে লাগানো কম্পিউটারে থাকবে চাঁদের বাড়ির বিভিন্ন অংশের নকশা। কালি হিসেবে ব্যবহার করা হবে চাঁদের মাটি। কম্পিউটারের ‘প্রিন্ট’ অপশনে গিয়ে মাউস ক্লিক করলেই, ওই মাটির মিশ্রণ স্তরে স্তরে জমে চেহারা নেবে ঘনবস্তুর। তৈরি হবে বাড়ির এক একটা অংশ। এই পুরো ব্যাপারটাই হাতেকলমে করে দেখিয়েছেন ইএসএ-র গবেষকরা। মধ্য ইতালির একটি আগ্নেয়গিরির ব্যাসল্ট পাথর থেকে একটা বিশেষ উপাদান খুঁজে পেয়েছিলেন বিজ্ঞানীরা। তার সঙ্গে ৯৯.৮ শতাংশ মিল রয়েছে, এমন রাসায়নিক রয়েছে চাঁদের মাটিতে। এই রাসায়নিকটাকেই বাড়ি তৈরির ‘সিমেন্ট’ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে পরীক্ষার সময়। রাসায়নিকটির সঙ্গে মেশানো হয়েছে ম্যাগনেসিয়াম অক্সাইড এবং ‘বাইন্ডিং সল্ট’। এই গোটা মিশ্রণটিকে ছাপার কালি হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। এবং থ্রি-ডি যন্ত্রে ছেপে বের হয়ে এসেছে বাড়ির এক একটা অংশ। কার্যত থ্রিডি ছাপার যন্ত্রটি চাঁদে কাজ করবে বাড়ি তৈরির যন্ত্র হিসেবে। বিজ্ঞানীদের দাবি, ছাপার গতিবেগ ঘণ্টায় সাড়ে তিন মিটার। আর তাতে এক সপ্তাহেই চাঁদে তৈরি হয়ে যাবে ওই আস্তানা।
তবে চাঁদে বাড়ি বানানো নিয়ে বেশ কিছু সমস্যার কথাও বলছেন বিজ্ঞানীরা। তাঁরা বলছেন, পৃথিবীর এই উপগ্রহের মাটিতে যে কোনও সময় আছড়ে পড়তে পারে উল্কা। বায়ুমণ্ডল নেই। ফলে ব্যাপক প্রভাব তেজষ্ক্রিয় বিকিরণেরও। এ ছাড়া চাঁদের ঝড় রয়েছে, বিশাল ফারাক রয়েছে দিন ও রাতে তাপমাত্রার মধ্যেও। এ সবের হাত থেকে বাঁচতে বাড়ি যথেষ্ট পোক্ত বানাতে হবে। বাড়ির দেওয়াল হবে ফাঁপা, অনেকগুলো খোপ পর পর সাজানো অনেকটা পাখির হাড়ের মতো, ওজন কম, গঠন মজবুত।
এ ছাড়াও গবেষকদের একাংশের মতে, গবেষণায় সাফল্য এসেছে পৃথিবীতে। চাঁদে নয়! সেখানে জলবায়ু-পরিবেশ পৃথিবীর মতো নয়। সমস্যা কাটাতে কী করছেন বিজ্ঞানীরা?
ইএসএ-র এই প্রকল্পের অন্যতম বিশেষজ্ঞ জেভিয়ার ই-মেল মারফত জানান, ঠিক এই জন্যই তাঁরা গবেষণার জন্য প্রতিকূল আবহাওয়া রয়েছে, এমন একটা জায়গা বেছে নিয়েছিলেন। সেখানে বাড়ি তৈরিতে স্থানীয় মাটি ব্যবহার করা হয়েছে। তাঁর বক্তব্য, “চাঁদেও তো এটাই করতে হবে।”
কিন্তু এত কিছুর পরেও অশনি সঙ্কেত দেখাচ্ছে চাঁদে মাধ্যাকর্ষণ শক্তির অভাব। চাঁদের মাধ্যাকর্ষণ শক্তি পৃথিবীর থেকে কম, ৬ ভাগের ৫ ভাগ। সেই সঙ্গে বায়ুমণ্ডলের অনুপস্থিতি। শূন্যস্থানে ছাপা হবে কী ভাবে? তরল পদার্থ শূন্যস্থানে ফেলামাত্রই উবে যাবে। কিন্তু বাড়ি তৈরির জন্য মাটির মিশ্রণটি বানাতে তো তরল পদার্থ লাগবেই। তা হলে? তারও একটা উপায় বের করেছেন বিজ্ঞানীরা। শূন্যস্থান তৈরি করে মাটির নীচে ছাপা শুরু করেন তাঁরা। দেখা যায়, মাটির নীচে ক্যাপিলারি শক্তির (মাধ্যাকর্ষণের প্রভাব ছাড়াই সূক্ষ্ম স্থানের মধ্যে দিয়ে তরলের অবাধ যাতায়াত) টানে ২ মিমি পর্যন্ত তরল বিন্দু বন্দি হতে পারে, উবে যায় না।
আর নাসার পরিকল্পনা কী? সবিস্তার বোঝা না গেলেও, তারাও যে পিছিয়ে নেই জানা গেল ওয়াশিংটন স্টেট ইউনিভার্সিটির দুই বিজ্ঞানীর থেকে। ত্রিমাত্রিক মুদ্রণ নিয়ে গবেষণা করছেন অমিত বন্দ্যোপাধ্যায় ও সুস্মিতা বসু। চাঁদে বেস ক্যাম্প বানাতে নাসা সাহায্য চেয়েছে তাঁদের কাছে। অমিত ও সুস্মিতা দু’জনেই বললেন, “এমন কিছু করে দেখানোর স্বপ্ন তো দেখছি। কিন্তু মাধ্যাকর্ষণের অভাব ও শূন্যস্থান, এ দু’টো বিষয়ই ভাবাচ্ছে।” |