স্ত্রীকে নিয়ে সন্তান কামনায় তারাপীঠে পুজো দিতে যাচ্ছিলেন। পথেই সব শেষ হয়ে গেল।
সোমবার রাতে বহরমপুর কোর্ট স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে শুয়ে ছিলেন ঘোষদম্পতি। রেল পুলিশের এক কনস্টেবল তাঁদের পরিচয় জিজ্ঞাসা করেন। রমাদেবী বলে ফেলেছিলেন তাঁর বাপের বাড়ির পদবি, বিশ্বাস। উত্তরে সন্তুষ্ট হননি ওই কনস্টেবল পরিতোষ বিশ্বাস। প্রচণ্ড মারধর করা হয় দিলীপবাবুকে। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে চিকিৎসকেরা তাঁকে মৃত বলে ঘোষণা করেন।
খবর আসার পর মঙ্গলবার সকাল থেকেই এলাকার মানুষজন আস্তে আস্তে ভিড় করছিলেন দিলীপবাবুর বাড়ির সামনে। সকলেই শোকস্তব্ধ। অনেকেই বৃথা চোখের জল চেপে রাখার চেষ্টা করছিলেন। কথাও হচ্ছিল খুব নিচুস্বরে। কারণ ঘরের ভিতরে আছেন দিলীপবাবুর বাবা খগেন্দ্রনাথ ঘোষ ও মা অঞ্জলিদেবী। তখনও ছেলের মৃত্যু সংবাদ তাঁদের দেওয়া হয়নি। কারণ, খগেন্দ্রনাথবাবুর এর আগে একবার বাইপাস সার্জারি হয়ে গিয়েছে। ছেলের মৃত্যু সংবাদ যদি সইতে না পারেন! |
জীববিদ্যায় স্নাতক দিলীপবাবু এলাকায় গ্রামীণ চিকিৎসকের কাজ করতেন। গৃহশিক্ষকতাও করতেন। প্রতিবেশীরা জানালেন, ইংরেজিতেও বেশ চৌখস ছিলেন তিনি। দিলীপবাবুরা পাঁচ ভাইবোন। পরিবারে ছেলে বলতে তিনি একাই। তিন বোনের বিয়ে হয়ে গেলেও এখনও অবিবাহিত এক বোন শঙ্করী। স্থানীয় বাসিন্দারা জানালেন, তাঁর বিয়ের জন্য পাত্র দেখাও শুরু করেছিলেন দিলীপবাবু। তার আগেই সব শেষ হয়ে গেল।
বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ির সামনে ভিড় বাড়ছিল আস্তে আস্তে। শোকের সঙ্গে মিশে যাচ্ছিল ক্ষোভ। উপস্থিত আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশীদের দাবি, ‘‘দিলীপবাবুকে খুন করেছে রেল পুলিশ।’’ অভিযুক্তের কঠোর শাস্তির দাবি জানাচ্ছেন তাঁরা। স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, বছর পনেরো আগে বনগাঁর সুভাষপল্লির বাসিন্দা রমাদেবীকে ভালবেসে বিয়ে করেছিলেন দিলীপবাবু। বাবা-মা সেই বিয়ে মেনে নেননি। তাই রমাদেবী বাপের বাড়িতেই থাকতেন। তবে এর জন্য বৃদ্ধ বাবা মার প্রতি শ্রদ্ধা কমেনি দিলীপবাবুর। কর্তব্যেও কোনও খামতি ছিল না। নিয়মিত বাবা-মার খোঁজ নেওয়া ছাড়াও যাবতীয় দায়দায়িত্ব সামলাতেন।
শঙ্করীদেবী বললেন, “সকালে দুর্ঘটনার খবর পেয়ে দাদার মোবাইলে ফোন করি। অন্য একজন ফোন ধরে জানাল সব কথা। সোমবার সন্ধ্যাতেই দাদা বাড়িতে এসে সবার সঙ্গে দেখা করে গেল। এখনও বিশ্বাস করতে পারছি না যে দাদা নেই। আমরা অনাথ হয়ে গেলাম।” কথা শেষ না হতেই ডুকরে উঠলেন তিনি।
বাড়ির সামনে থমথমে মুখের ভিড় বাড়তে দেখে বাইরে বেরিয়ে এলেন দিলীপবাবুর বাবা। কেউ কিছু না বললেও সবই বুঝতে পারছিলেন তিনি। কাঁদতে কাঁদতেই প্রতিবেশীদের প্রশ্ন করছিলেন ছেলের কিছু হয়েছে কিনা। বিকেলবেলা দিলীপবাবুর এক বোন থাকতে না পেরে প্রকৃত ঘটনা জানান তাঁদের। তারপর থেকেই ঘনঘন জ্ঞান হারাচ্ছেন খগেন্দ্রবাবু। মা অঞ্জলিদেবী বাকরুদ্ধ।
দিলীপবাবুর আত্মীয় লালুবাবু ও অমলবাবুরা বলেন, “দিলীপই ছিল পরিবারের একমাত্র রোজগেরে সদস্য। এখন কী হবে কে জানে? যে বা যারা এই খুন করল তাদের কঠোর শাস্তি চাই। রেল কর্তৃপক্ষের কাছে অনুরোধ করব, যেন পরিবারটিকে আর্থিক সাহায্য করা হয়।” খবর পেয়ে বাড়িতে আসেন স্থানীয় কাউন্সিলার সিপিএমের সুনীল সরকার।
যাঁরা এসেছিলেন বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গে পাতলা হতে থাকে ভিড়। একে একে বাড়ির পথ ধরলেন সবাই। শূন্যদৃষ্টিতে সেদিকেই তাকিয়ে ছিলেন খগেন্দ্রবাবু। নির্বাক।
ছেলে হারানোর শূন্যতা কি মাপা যায়?
|