স্বামীর পদবি ঘোষ। স্ত্রী বলেছিলেন বাপের বাড়ির পদবি, বিশ্বাস। বহরমপুর কোর্ট স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে শুয়ে থাকা দম্পতির এই জবাব ‘সন্তোষজনক’ মনে হয়নি রেল পুলিশের কনস্টেবলের। বাধে বচসা। অভিযোগ, তার জেরে সোমবার রাতে স্বামী, দিলীপ ঘোষকে (৪৮) মারধর করে ঠেলে রেললাইনে ফেলে দেন ওই কনস্টেবল। প্ল্যাটফর্মে থাকা জনতা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার আগে প্রায় ৪০ মিনিট লাইনেই পড়েছিলেন দিলীপবাবু। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে চিকিৎসকেরা মৃত বলে ঘোষণা করেন তাঁকে।
পেশায় গ্রামীণ চিকিৎসক দিলীপবাবুর বাড়ি উত্তর ২৪ পরগনার বনগাঁয়। সন্তানকামনায় তারাপীঠে পুজো দিতে যাচ্ছিলেন স্ত্রী রমা ঘোষের (বিশ্বাস) সঙ্গে। ট্রেন থেকে নেমে রাত কাটাচ্ছিলেন প্ল্যাটফর্মে।
পরিতোষ বিশ্বাস নামে ওই কনস্টেবলকে সোমবার রাতেই স্টেশন লাগোয়া এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয়। তিনি সাসপেন্ডও হন। তবে রেল প্রতিমন্ত্রী অধীর চৌধুরীর শহর বহরমপুরে স্টেশন চত্বরে রেল পুলিশের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ ওঠায় অস্বস্তিতে রয়েছে রেল এবং রেল পুলিশদু’পক্ষই। ঘটনার প্রতিবাদে মঙ্গবার দুপুরে রেল পুলিশের বহরমপুর থানায় বিক্ষোভ দেখায় সিপিএম। |
দিল্লি থেকে ফোনে অধীরবাবু বলেন, “গর্হিত অপরাধ করেছেন ওই পুলিশকর্মী। রেল পুলিশের কনস্টেবল সরাসরি রেলের নন, রাজ্য পুলিশের কর্মী। রেলের তরফে ওই ঘটনায় বহরমপুরে রেল পুলিশের কাছে একটি অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। এ ব্যাপারে পুলিশ যা ব্যবস্থা নেওয়ার, নেবে। রেলের পক্ষ থেকে আমরা ওই মহিলার পাশে রয়েছি।” তিনি জানান, দিলীপবাবুর মৃতদেহ বনগাঁর বাড়িতে পাঠানোর ব্যাপারে কংগ্রেস পরিচালনাধীন বহরমপুর পুর-কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অস্বস্তি আড়াল করেননি এসআরপি (শিয়ালদহ) উৎপল নস্কর। তাঁর কথায়, “ঘটনাটি বাঞ্ছনীয় নয়। ওই পুলিশকর্মীর বিরুদ্ধে খুনের মামলা রুজু করা হয়েছে।”
সোমবার রাত ১২টারও পরে বনগাঁ থেকে রানাঘাট হয়ে রাতের শেষ লোকালে বহরমপুরে পৌঁছন দিলীপবাবু ও রমাদেবী। ভোরে বহরমপুর বাসস্ট্যান্ড থেকে প্রথম বাসেই তাঁরা তারাপীঠ পাড়ি দেবেন, এমনই ভেবেছিলেন। ঠাঁই নেন ১ নম্বর প্ল্যাটফর্মে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, স্টেশন চত্বরেই রেল পুলিশের থানা লাগোয়া এলাকায় একটি অনুষ্ঠান চলছিল। রাত সওয়া ১টা নাগাদ সে দিক থেকেই ‘টলোমলো পা-য়’ ওই দম্পতির দিকে যেতে দেখা যায় কনস্টেবল পরিতোষবাবুকে।
রমাদেবী বলেন, “আমরা শুয়েছিলাম। ওই কনস্টেবল ঠেলে তোলেন। মুখে মদের গন্ধ ছিল। উনি প্রথমে স্বামীর নাম জিজ্ঞাসা করেন। পরে আমার। আমি বাপেরবাড়ির পদবি বিশ্বাস বলে ফেলি। সঙ্গে সঙ্গে ওই কনস্টেবল বলতে শুরু করেন, ‘ঘোষের বউয়ের পদবি বিশ্বাস কী করে হয়?’ বললাম, ‘পনেরো বছর বিয়ে হয়েছে। দরকারে বাপেরবাড়িতে ফোন করুন’। কিন্তু উনি মানতেই চাননি আমরা স্বামী-স্ত্রী। তা নিয়েই শুরু হয় কথা কাটাকাটি।”
ওই দম্পতির মতো রাতের জন্য প্ল্যাটফর্মেই আশ্রয় নিয়েছিলেন রানিনগরের মহম্মদ সম্রাট, বহরমপুরের সুবীর সেন, হুগলির সঞ্জয় বন্দোপাধ্যায়রা। তাঁদের বক্তব্য, “ওই মদ্যপ কনস্টেবল আচমকা ভদ্রমহিলার স্বামীকে মারধর শুরু করেন। আমরা বাধা দিতে যাওয়ার আগেই ভদ্রলোককে প্ল্যাটফর্ম থেকে ঠেলে ফেলে দিয়ে ওই পুলিশকর্মী প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে চলে যান।” সুবীর-সম্রাট-সঞ্জয়দের ক্ষোভ, “সাহায্যের জন্য রেল পুলিশের কাউকে পাইনি। জোগাড়যন্ত্র করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার আগে প্রায় ৪০ মিনিট ভদ্রলোক লাইনেই পড়ে ছিলেন।” মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজে নিয়ে যাওয়া হলে চিকিৎসকেরা জানান, মারা গিয়েছেন দিলীপবাবু। ময়না-তদন্তের প্রাথমিক রিপোর্টে জানা গিয়েছে, তাঁর মাথায় গুরুতর চোট ছিল। এ দিন দুপুরে বনগাঁর খয়রামারি-নাগপাড়া থেকে পরিবারের লোকজন এসে পৌঁছনো পর্যন্ত রমাদেবীকে আগলে রেখেছিলেন প্ল্যাটফর্মের ‘বন্ধু’রাই।
বনগাঁয় দিলীপবাবুর বাড়িতে রয়েছেন অবিবাহিতা বোন, বৃদ্ধ বাবা-মা। বোন শঙ্করী ঘোষ বলেন, “দাদার আয়েই সংসার চলত। টিভি-তে খবর দেখে বিশ্বাস হয়নি। দাদার মোবাইলে ফোন করলাম। অন্য এক জন ফোন ধরে বললেন, সব শেষ!” দুঃসংবাদ পেয়ে ঘনঘন সংজ্ঞা হারাচ্ছেন দিলীপবাবুর বাবা খগেন্দ্রনাথবাবু। মা অঞ্জলিদেবী নির্বাক।
ঘটনা জানাজানি হতেই রেল পুলিশের বহরমপুর থানায় ভিড় করে জনতা। পরিস্থিতি উত্তপ্ত হচ্ছে দেখে ধৃত কনস্টেবলকে সরানো হয় রাজ্য পুলিশের বহরমপুর থানায়। সেখানে বসে অবশ্য সব অভিযোগই উড়িয়ে দেন পরিতোষবাবু। তাঁর দাবি, “আমি মদ্যপ অবস্থায় ছিলাম না। ওই ভদ্রলোক-মহিলার ভাবভঙ্গি আমার আপত্তিজনক মনে হয়েছিল। ওঁদের জেরা করে সন্তোষজনক জবাব না পেয়ে প্ল্যাটফর্মে রেল পুলিশের থানায় নিয়ে যাচ্ছিলাম। পথে আচমকা পা ফস্কে রেললাইনে পড়ে যান ভদ্রলোক। আমি মারধর করিনি।” তা হলে রেললাইনে পড়ে যাওয়া দিলীপবাবুকে তুলে থানায় নিয়ে গেলেন না কেন? এ বার নিরুত্তর পরিতোষ। বহরমপুর আদালতে হাজির করানো হলে বিচারক তাঁকে তিন দিন রেল পুলিশের হেফাজতে রাখার নির্দেশ দেন। রমাদেবীর আক্ষেপ, “কত বার লোকটাকে বললাম, ‘আমার বিয়ের আগের পদবি বিশ্বাস’। কথাটা বিশ্বাসই করাতে পারলাম না!”
|