কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র আফাজুদ্দিন শেখ এবং প্রাথমিক স্কুলের অসবরপ্রাপ্ত শিক্ষক অনাদিনাথ ধরকে মিলিয়ে দিল বইমেলা।
আফাজুদ্দিনের বাড়ি মুর্শিদাবাদের রানিতলার প্রত্যন্ত গ্রাম কোলানে। খেতমজুুর পরিবারের তরুণের প্রতি দিন ভরপেট ভাত জোটে না। তবে তিনি কবি। কিন্তু তাঁর কবিতা কী করে আলোর মুখ দেখবে? মুশকিল আসান ‘মুর্শিদাবাদ জেলা কবিতা আকাদেমি’ প্রকাশনা সংস্থা। সেখান থেকে ‘এসো প্রেম’ নাম দিয়ে নবীন কবি আফাজুদ্দিনের প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হল। এ বছর বইমেলায় ওই একই প্রকাশনা থেকে বেরিয়েছে অনাদিনাথবাবুর ‘রকমারি ছড়া’। প্রকাশের খরচের অধিকাংশটাই বহন করেছেন অনাদিবাবু। আর নিজের কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের জন্য একটি কানাকড়িও দিতে পারেননি আফাজুদ্দিন। ওই প্রকাশনী থেকে গত দশ বছরে ছাপা হয়েছে ১৭টি গ্রন্থ।
ওই উদ্যোগের সলতে পাকানো শুরু হয়েছিল ১৯৯৯ সালে। স্বরচিত কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ পাঠ ও সে সব নিয়ে আলোচনার জন্য ‘মুর্শিদাবাদ জেলা কবিতা আকাদেমি’ প্রতিষ্ঠিত হয় সে বছর। প্রতি মাসের শেষ রবিবার বসে পাঠচক্র। ‘আকাদেমি’ সম্পাদক কুশলকুমার বাগচি বলেন, “নবীন ও অখ্যাত লেখকদের লেখা গ্রন্থবদ্ধ করার তেমন সুযোগ নেই। আর মফস্সলে তো আরও দুরবস্থা। ফলে অ-বাণিজ্যিক উদ্দেশে পাঠচক্রের সদস্যরা মিলিত ভাবে ২০০২ সালে প্রকাশনী সংস্থা গড়লাম।” তিনি জানান, তাঁরা প্রথম প্রকাশ করেন ইসলামপুরের ফিরোজা বেগমের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ছঁুয়ে যাই ধ্বনি, ছড়াই নির্যাস’। একই ভাবে ২০০২ সালে গঠিত হয় ‘মুর্শিদাবাদ সাহিত্য অ্যাকাদেমি’। ওই সংস্থার অন্যতম কর্ণধার রিনা কংসবণিক বলেন, “কলকাতার প্রকাশনা সংস্থার কাছে যাঁরা কল্কে পান না, বা পেলেও অনেক বেশি টাকা গুনতে হয় যাঁদের, মফস্সলের সেই সব লেখকেদের বই প্রকাশের জন্য ২০ জন সদস্য নিয়ে ‘মুর্শিদাবাদ সাহিত্য অ্যাকাদেমি’র জন্ম। এ পর্যন্ত ১২টি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে।” ‘মুর্শিদাবাদ সাহিত্য অ্যাকাদেমি’র অন্যতম পৃষ্ঠপোষক কবি সমীরণ ঘোষ বলেন, “সংস্থাটি মূলত তিন জনের উপর নির্ভরশীল ছিল। তাঁদের মধ্যে নুরুল আমিন বিশ্বাস চাকরি সূত্রে মুর্শিদাবাদের বাইরে, দুর্ঘটনার ফলে এবাদুল হক শারীরিক কারণে অক্ষম। রইলেন কেবল রিনা কংসবণিক। ফলে গত বছরের থেকে ‘মুর্শিদাবাদ সাহিত্য অ্যাকাদেমি’র কাজকর্ম এক রকম স্থগিত রয়েছে। তবুও মানতেই হবে তুলসীচরণ মণ্ডলের ‘আলকাপ সম্রাট ঝাঁকসু’, রিনা কংসবণিক সম্পাদিত প্রবন্ধ সংকলন ‘মেয়েলি সাহিত্য’-এর মতো গ্রন্থগুলি ‘মুর্শিদাবাদ সাহিত্য অ্যাকাদেমি’র মতো প্রকাশনী ছাড়া বের হওয়া অসম্ভব ছিল।” বছর খানেক বয়সের ‘ছাপাখানার গলি’ বা দু’দশক আগে জন্ম নেওয়া ‘অর্কেস্ট্রা’ থেকে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। যেমন সুশান্ত বিশ্বাসের ‘মুর্শিদাবাদের কারুশিল্প’ বা সৈয়দ খালেদ নৌমানের ‘মুর্শিদাবাদের কবিতা চর্চার ধারা’ এবং সুশীল ভৌমিকের কাব্যগ্রন্থ ‘আমি তবু’। বছর খানেকের মধ্যে ‘ছাপাখানার গলি’ থেকে প্রকাশিত হয়েছে দেবাশিস সাহার কাব্যগ্রন্থ ‘প্রজাপতি রঙের গ্রাম’, সন্ধিনী রায়চৌধুরীর প্রবন্ধ সংকলন ‘জীবনের এই ঝরণা ধারায়, প্রকাশ দাস বিশ্বাসের ‘রবীন্দ্রনাথ ও মুর্শিদাবাদ’ ও অধ্যাপক আবুল হাসনাতের ‘ইতস্তত ১’। ‘অর্কেস্ট্রা’র সৈয়দ খালেদ নৌমান ও ‘ছাপাখানার গলি’র দেবাশিস সাহা দু’জনই বলেন, “কলকাতার বড় প্রকাশনার কাছে যাঁরা পাত্তা পাবেন না, তাঁদের বই, তাঁদের টাকাতেই সততার সঙ্গে প্রকাশ করা জন্য অবাণিজ্যিক ভাবা গড়ে উঠেছে মফস্সলের এই সব প্রকাশনা সংস্থাগুলি।” বহরমপুরের ‘বইঘর’ প্রকাশনাও এ রকম একটি সংস্থা। এখান থেকে প্রকাশিত হয়েছে রমাপ্রসাদ ভাস্করের গবেষণামূলক দু’টি গ্রন্থ ‘সংগীত চর্চার ধারায় মুর্শিদাবাদ’ ও ‘মুর্শিদাবাদ মনীষাপ্রথম খণ্ড’। এ রকমই ক্ষূদ্র প্রকাশনা ‘উদার আকাশ’ মাত্র চার বছরের মধ্যে প্রকাশ করছে ৩৫টি বই। তার মধ্যে রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ দু’টি বই অধাপক সৌমেন্দ্রকুমার গুপ্তের প্রবন্ধ সংকলন ‘পরিবর্তনের সন্ধানে মুর্শিদাবাদের বাঙালি মুসলমান’ এবং খাজিম আহমদের ‘পশ্চিমবাঙলার বাঙালি মুসলমান: অন্তহীন সমস্যা’। প্রকাশক ফারুখ আহমদের বক্তব্য, “মফস্সলের ওই গুণিজনদের আবিষ্কার করতে যে উদ্যোগ দরকার তা বৃহত্ প্রতিষ্ঠানগুলির মধ্যে দেখা য়ায় না। অথচ ওই সব গুণিজনদের গবেষণামূলক লেখাগুলি গ্রন্থবদ্ধ না হলে আগামী দিনের গবেষকরা বঞ্চিত হবেন। ওই তাগিদ থেকে প্রকাশনা সংস্থার জন্ম।”
ব্যতিক্রম কেবল বহরমপুরের পেশাদার প্রকাশনা সংস্থা ‘শিল্পনগরী’। ওই সংস্থার কর্ণধার কল্যাণকুমার দাস বলেন, “অনেক প্রকাশনা সংস্থা লেখকদের প্রতারিত করেছে। ওই অভিজ্ঞতা থেকে মফস্সলের লেখকদের জন্য একটি সত্ প্রকাশনা সংস্থার জন্ম দেওয়া। গত ৮ বছরে মোট ১৬টি বই প্রকাশ করেছি। তার মধ্যে আমার সম্পাদিত শরত্চন্দ্র পণ্ডিতের উপর প্রবন্ধ সংকলন ‘অনন্য দাদাঠাকুর’, পুলকেন্দু সিংহের ‘মধ্যবঙ্গের লোকসঙ্গীত’ এ বার মুশির্দাবাদ জেলার দু’টি বইমেলাতেই ভাল বিক্রি হয়েছে। এখন প্রকাশনাই আমার পেশা।” করপোরেট জগতের বৃহত্ প্রকাশনা সংস্থার সঙ্গে অসমে লড়ায়ে মুর্শিদাবাদের মতো মফস্বলের অতি ক্ষূদ্র ওই সব প্রকাশনা সংস্থার টিকে থাকার ক্ষেত্রে প্রচ্ছদশিল্পীদের অবদান অসামান্য। কবি সমীরণ ঘোষ, শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায়, চিত্রশিল্পী কৃষ্ণজিত্ সেনগুপ্ত, সৈয়দ সুশোভন রফি প্রমুখরা বিনা পারিশ্রমিকে অথবা নামমাত্র পারিশ্রমিকে প্রচ্ছদ এঁকে দিয়ে প্রকাশকদের বেশ কিছুটা স্বস্তি যোগান। লেখক, সম্পাদক, প্রকাশক ও প্রচ্ছদশিল্পীদের ওই সম্মিলিত উদ্যোগে টিকে রয়েছে মফ্ফসলের প্রকাশনা শিল্প।” |