নগদ ছ’লক্ষ টাকা দিলেই রেলে চাকরির নিয়োগপত্র। সঙ্গে রেলের প্রশিক্ষণও। প্রশিক্ষণ শেষে রেলের পদস্থ কর্তাদের শিলমোহর দেওয়া শংসাপত্র। সব শেষে দেশের বিভিন্ন রেল স্টেশনে পোস্টিং এবং মাস শেষে বেতন।
ঠিক এ ভাবেই কয়েকশো প্রার্থীকে ভুয়ো চাকরি দিয়ে প্রায় ১৬ কোটি টাকা প্রতারণার পরে অবশেষে রবিবার রাতে হাওড়া সিটি পুলিশের গোয়েন্দা দফতরের হাতে ধরা পড়ল একটি বড়সড় আন্তঃরাজ্য প্রতারণা-চক্রের এক পাণ্ডা। পুলিশ জানিয়েছে, ধৃত ব্যক্তির নাম সন্দীপ শর্মা। বছর আঠাশের ওই যুবকের বাড়ি বিহারের আরা জেলায়। বেশ কয়েক দিন ধরে ওই যুবকের গতিবিধি নজরে রাখার পরে রবিবার রাতে হাওড়া স্টেশনের কাছে জিআর রোড থেকে তাকে গ্রেফতার করেন গোয়েন্দারা। ধৃতের কাছ থেকে উদ্ধার হয়েছে রেলের একটি জাল হাজিরা খাতা, যাতে রয়েছে রেলে ভুয়ো চাকরি পাওয়া ২৫৯ জন যুবক-যুবতীর নাম ও সই। পাওয়া গিয়েছে, ধৃতের নামে আটটি ব্যাঙ্কের পাশবই, এটিম কার্ড, জাল নিয়োগপত্র, জাল প্রশিক্ষণের শংসাপত্র, উচ্চপদস্থ কর্তাদের রাবার স্ট্যাম্প এবং নগদ চার হাজার টাকা।
সোমবার হাওড়া সিটি পুলিশের এসি (ডিডি) তন্ময় সরকার বলেন, “ঠিক কত দিন ধরে চক্রটি সক্রিয় রয়েছে, আমাদের কাছে তা এখনও পরিষ্কার নয়। তবে আমাদের ধারণা, তদন্তে এখনও পর্যন্ত যে ২৫৯ জনের নাম ঠিকানা লেখা হাজিরা খাতা পাওয়া গিয়েছে, সেটাই শেষ নয়। মনে হয় এমনই আরও কয়েকটা হাজিরা খাতা পাওয়া যাবে, তখন সারা দেশে চক্রটি ঠিক কত দিন ধরে, কত কোটি টাকা প্রতারণা করেছে, তা পরিষ্কার হয়ে যাবে।” |
কী ভাবে পাওয়া গেল এই প্রতারণা-চক্রের হদিস?
হাওড়া সিটি পুলিশের গোয়েন্দারা জানিয়েছেন, গত ১৯ ফেব্রুয়ারি মধ্যপ্রদেশের বাসিন্দা, অমিত সিংহ নামে এক যুবক গোলাবাড়ি থানায় একটি অভিযোগ দায়ের করেন। তাতে ওই ব্যক্তি জানান, রেলে চাকরি দেওয়ার নামে লক্ষ লক্ষ টাকা নিয়ে বেকার যুবকদের প্রতারণা করছে একটা চক্র। তিনিও প্রতারিতদের মধ্যে এক জন। এই অভিযোগ পাওয়ার পরে তদন্ত শুরু করে হাওড়া সিটি পুলিশের গোয়েন্দারা। পুলিশকে অমিতই সন্দীপ সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য দেন এবং তাকে চিনিয়েও দেন। এর পরেই পুলিশ সন্দীপের গতিবিধি অনুসরণ করতে শুরু করে।
প্রাথমিক তদন্তের পরে হাওড়া সিটি পুলিশের গোয়েন্দারা জানান, মূলত পশ্চিমবঙ্গ, উত্তরপ্রদেশ, বিহার, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান-সহ আরও কয়েকটি রাজ্যে এই চক্রটি কাজ করেছে। চাকরি করে দেওয়ার প্রথম শর্ত হিসেবে নেওয়া হয়েছে প্রতি প্রার্থীর থেকে ছ’লক্ষ টাকা। টাকা দিলেই মিলেছে রেলের জাল নিয়োগপত্র, প্রশিক্ষণের জাল শংসাপত্র, এমনকী বিভিন্ন স্টেশনে পোস্টিং। তদন্তে জানা গিয়েছে, চাকরি দেওয়ার পরে মাস তিনেক জাল পে-স্লিপ-সহ বেতনও দেওয়া হয় ওই সমস্ত যুবক-যুবতীদের। কিন্তু শেষে নানা কারণ দেখিয়ে মাস তিনেক পরেই চাকরি থেকে তাঁদের একে একে বরখাস্ত করে দেওয়া হয়।
তদন্তকারীদের ধারণা, দেশে বিভিন্ন রাজ্যে চক্রটি ছড়িয়ে থাকলেও চক্রটির মূল ঘাঁটি হল কলকাতা ও হাওড়া। তদন্তে এমনটাই প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। কারণ জানা গিয়েছে, চক্রটির বৈঠক হলে কলকাতা ও হাওড়াতেই হত। রবিবারও এমনই একটা গোপন বৈঠকে যোগ দিতে এসেছিল সন্দীপ শর্মা। তখনই খবর পেয়ে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। তবে এই চক্রে সঙ্গে রেলের কোনও অফিসার বা কর্মী জড়িত রয়েছেন কি না, তা অবশ্য এখনও জানা যায়নি। গোয়েন্দাদের ধারণা, ধৃতকে জেরা করে ওই চক্রের অন্য পাণ্ডাদেরও যেমন খোঁজ মিলবে, তেমনই মিলতে পারে আরও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। এ জন্য ধৃতকে এ দিন হাওড়া আদালতে তোলা হলে তার ১৪ দিনের পুলিশি হেফাজতের আবেদন করা হয়। আদালত আবেদন মঞ্জুর করে। |