শ্রীরামকৃষ্ণের জীবন, সাধনা ও বাণীতে সর্বত্রই মানুষের জয়গান। সমগ্র অন্তর দিয়ে তিনি মানুষকে ভালবাসতেন। সে ভালবাসায় স্বার্থচিন্তা বা ভেদবুদ্ধি ছিল না। তাঁর অমোঘ আকর্ষণে সমাজের সর্ব স্তর থেকেই অজস্র মানুষ ছুটে এসেছেন দক্ষিণেশ্বরে। কেউ জমিদার, কেউ ধর্মপ্রবক্তা, কেউ পণ্ডিত, কেউ নাট্যকার বা সাহিত্যিক। তাপিত, ব্যথিত, অসহায় মানুষও এসেছেন। কেউ জীবনজিজ্ঞাসা নিয়ে, কেউ জ্ঞানের অন্বেষণে, কেউ বা শান্তির আশায়। তাঁর হদয়-দুয়ার খোলা ছিল সকলের জন্যই।
শ্রীরামকৃষ্ণ নিজেও ‘শুকনো সাধু’ ছিলেন না। নিজেকে কোনও নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে বেঁধে রাখেননি তিনি। চারিদিকেই দেখেছেন তাপিত সাধারণ মানুষের যন্ত্রণা, যে জনগোষ্ঠীর একটা বড় অংশই জানে না জীবনের লক্ষ্য কী হওয়া উচিত। তাই তিনি বলতেন, যার ‘হুঁশ’ আছে সেই হল মানুষ। যার কথাবার্তা, আচারব্যবহার, আদবকায়দা অন্যকে আহত করে, মানবপ্রেমী শ্রীরামকৃষ্ণের দৃষ্টিতে সে মনুষ্যপদবাচ্য নয়। এ জন্যই তিনি সকলকেই মানবতার বিকাশ সাধনে ব্রতী হতে আহ্বান জানিয়েছেন।
নিজেও শ্রীরামকৃষ্ণ জীবনের নানা পর্বেই ছুটে গিয়েছেন মানুষের মাঝে। কোথায় হরিসভা হচ্ছে, সেখানে গিয়েছেন, ব্রাহ্মসমাজের উপাসনা কেমন হয়, দেখতে গিয়েছেন। গিয়েছেন সার্কাসের খেলা দেখতে। জাদুঘর, থিয়েটার, বিদ্যাসাগরের বাড়ি, দেবেন্দ্রনাথের বাড়ি সব জায়গাতেই গিয়েছেন তিনি। তাঁর ছিল কৌতূহলী জিজ্ঞাসু মন। সেখানে ধর্ম, জাত, উচ্চনীচভেদের স্থান ছিল না, গতানুগতিক ধর্ম ঈশ্বরবোধ সম্প্রদায় আচারসর্বস্বতার কোনও দাম ছিল না তাঁর কাছে। এই সন্ন্যাসীর মন ছিল এক বহতা নদী, যা সততই মানবকল্যাণের অভিলাষে অনন্তের অভিমুখী।
শ্রীরামকৃষ্ণ জন্মগত ভাববিপ্লবী। যুগযুগান্তর ধরে চলে আসা যাবতীয় সামাজিক অন্ধ গোঁড়ামি, কুসংস্কার ও ধর্মীয় সংকীর্ণতার বহু ঊর্ধ্বে ছিলেন তিনি। বিভিন্ন ধর্মমতের যথার্থতা নিয়ে মানুষে মানুষে যে বিবাদ, রেষারেষি চলে আসছে তার মূলে কুঠারাঘাত করে তিনি বলেছিলেন, ‘যত মত তত পথ’। সব পথ দিয়েই ঈশ্বরকে পাওয়া যায়। তাঁর এই ধর্মব্যাখ্যা বহুবিধ ধর্মীয়ভাবাপন্ন মানুষের মনকে সত্য ও মানবতার আলোর পথ দেখিয়েছিল। মানবকল্যাণ-বিরোধী ধর্মীয় ভাবাবেগকে তিনি কখনওই গুরুত্ব দেননি। যে ধর্ম মানুষকে অবজ্ঞা করে, শুভবোধ ও সর্বব্যাপী মানসিক অনুভূতিকে আঘাত করে প্রাতিষ্ঠানিক রীতিনীতিকে বৃহত্ করে এমন ধর্মের বিশ্বাসী তিনি ছিলেন না। তাঁর দৃষ্টিতে ধর্ম হল মানুষের সেবা। দুঃস্থ, অবহেলিত মানুষের পুজা। তাঁর এই পূজার অভিনব মন্ত্র: ‘যত্র জীব তত্র শিব, শিবজ্ঞানে জীবের সেবা’। এই সহজ কথার মাধ্যমেই শ্রীরামকৃষ্ণ এক নতুন ধর্মচেতনার জন্ম দিয়েছিলেন, যার মূল কথা মানবকল্যাণ ও স্বার্থহীন সেবা। তারই পরিণতিতে পরে আমরা সেবাব্রতী সন্ন্যাসীদের সর্বত্র দেখতে পাই।
অনন্তমনা শ্রীরামকৃষ্ণের সেবা-ভাবনার মূল হাতিয়ার হয়ে উঠেছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ। সিমলানিবাসী তরুণ নরেনকে দেখেই শ্রীরামকৃষ্ণ বুঝতে পেরেছিলেন, এই সেই যুবক যে দেশে দেশে ‘শিক্ষে দিয়ে’ মানুষকে আত্মবিশ্বাসী হতে, আপন পায়ে দাঁড়াতে এবং দুস্থ-তাপিতদের সেবা করতে নির্দেশ দেবে। তাই তো দক্ষিণেশ্বরে নরেন্দ্রনাথকে দেখেই তিনি বলে উঠেছিলেন, “মা তোকে তাঁর কাজ করবার জন্য সংসারে টেনে এনেছেন, তোকে আমার পশ্চাতে ফিরতেই হবে, তুই যাবি কোথায়? তুই শিক্ষে দিবি।” ঠাকুরের সেই কথা পরবর্তী কালে অক্ষরে অক্ষরে মিলে যায়।
বর্তমান অস্থির বিশ্বে এই মানুষ হয়ে ওঠার ভাবনাটাই সকলের জীবনে, দেশের ও রাষ্ট্রের কাছে সব থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে প্রতিপন্ন হচ্ছে। আর এই মনুষ্যত্ব অর্জনের প্রধান সাধনাই হল সত্য, পরমতসহিষ্ণুতা, অপরকে সম্মান দেওয়া, এগিয়ে চলার সাহস দেখানো। এগিয়ে চলা মানে শুধু প্রথাগত ধর্মীয় চেতনায় আবদ্ধ হওয়া নয়, তা দেশের শিল্পে, সাহিত্যে, সঙ্গীতে, খেলাধুলায়, সুন্দর সমাজ চেতনায়, পরস্পর সহানুভূতিতে, যথার্থ ভালবাসার বহুমুখী মহান আদর্শে উদ্বুদ্ধ হওয়া বোঝায়। তাই শ্রীরামকৃষ্ণের আকুল প্রার্থনা, “মা! আমায় শুকনো সাধু করিস না। আমাকে রসে-বশে রাখিস।”
মানবতার মহান কর্মযজ্ঞে অংশ নেওয়ার জন্যই এই সন্ন্যাসী কখনও দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছেন, কখনও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের কাছে। কখনও কেশবচন্দ্র সেন, কখনও বা বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে কথা বলেছেন। বুঝতে চেয়েছেন তাঁদের মনের পরিসর, চেতনার গূঢ় অর্থ ও ভাবনার বহুমুখিতার তাত্পর্য। আবার আশীর্বাদ করেছেন মদ্যপ গিরিশ ঘোষ, পতিতা নটী বিনোদিনী, রসিক মেথর, বৃন্দা ঝি-সহ বহু দুর্বলচিত্ত নরনারীকে। কোনও কিছুকে তুচ্ছ করে উড়িয়ে দেওয়া বা আঘাত করে দূরে সরিয়ে দেওয়া তাঁর ধাতে ছিল না। পাপী-তাপী, অবহেলিত, ব্যথিত সকলেই সমান স্নেহ ও সম্মান তাঁর কাছে পেয়েছেন। সকলের উন্নতি, সুখ, শান্তি ও মনুষ্যত্ব বিকাশের জন্য চিন্তা করে গেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণের মানবতাবাদের আর একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ দিক হল, সকল নারীকে যথাযথ সম্মান প্রদান। সে সময়ে সকল নারীকেই কার্যত পুরুষের দাসী হিসেবেই ভাবা হত। শ্রীরামকৃষ্ণ এই ধারণায় তীব্র আঘাত এনে বলেছিলেন, “মেয়েরা হল জগন্মাতার অংশ।” বারাঙ্গনাদের মধ্যে গিয়েও তিনি তাঁদের ‘মা’ ডাকে মোহিত করেছিলেন। নটী বিনোদিনীকে ‘মা, তোমার চৈতন্য হোক’ বলে আশীর্বাদ করেছিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণের এই আশীর্বাদ হল সমাজের তুচ্ছ অবহেলিত থেকে শুরু করে সকল শ্রেণির নারীর প্রতি এক অভিনব মর্যাদা জ্ঞাপন। বলতে কী, মানুষকে যথার্থ মনুষ্যত্বে প্রতিষ্ঠিত হতে গেলে, দেশ ও জাতিকে যথার্থ মহিমায় ও উন্নতির শিখরে পৌঁছতে গেলে নারীজাতিকে শ্রদ্ধা ও সম্মান জানাতেই হবে। |