ছোটবেলায় ঠাকুমার কাছে যত গল্প শুনতেন, অবনীন্দ্রনাথের ছবিতে রঙের আলতো টানে যে অর্ধ-উন্মুক্ত অর্ধ-গোপন জগত্ দেখতে পেতেন, কিংবা স্বাধীনতার আগে কলকাতার যে দাঙ্গাবিধ্বস্ত রূপটি দেখে ফেলেছিলেন গণেশ পাইন তাঁর সারাজীবনের চিত্রশিল্প সেই সব কিছুর উপর ভর করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। প্রথম জীবনে তাঁর কাজে অবনীন্দ্রনাথের প্রত্যক্ষ প্রভাব ছিল। কিন্তু ক্রমে সেই ‘বেঙ্গল স্কুল’ অতিক্রম করে গেলেন তিনি, ভারতে ষাটের দশক-পরবর্তী শিল্পধারার অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রতিনিধি হয়ে উঠলেন। সমসাময়িক শিল্পীদের মতো গণেশ পাইনের মধ্যেও আমরা দেখতে পাই ষাটের দশকের চিহ্নবাহী তীব্র অস্তিত্বের সংকট। কিন্তু পাশাপাশি একটা রহস্যময় জগত্ও তাঁর ছবির মধ্যে জায়গা খুঁজে নেয়, যেন রূপকথা থেকে নেমে আসে সেই মায়া-চিত্র। এই জন্যই তাঁর প্রজন্মের অন্যান্য শিল্পীদের থেকে তিনি বিশিষ্ট: কলকাতার নির্যাতিত আত্মার শিল্পী তিনি, একই সঙ্গে বাংলার মায়াময় অতীত ঐতিহ্যের স্মৃতিও তাঁর শিল্পকর্মে আমূল বিধৃত। |
বিষণ্ণ আঁধার আর উজ্জ্বল আলোকের এই আশ্চর্য মেলামেশা তাঁর কল্পনার পরতে পরতে, তাঁর প্রতিকৃতি-ভাবনায়, তাঁর শিল্পধারায়। নাছোড় ধৈর্য নিয়ে তিনি এঁকে যেতেন তাঁর ড্রয়িং, তাঁর শিল্পকৃতি। কলমের টানেই হোক, রঙ-তুলির আঁচড়েই হোক, তাঁর ছবির মধ্যে এক দিকে অবলীলায় ফুটে ওঠে কলকাতার যুগজীর্ণ বাড়ির দেওয়ালে পাথর হয়ে জমে থাকা ধ্বংস ও মৃত্যুর নিশানা, অন্য দিকে ঝলসে ওঠে রত্নখচিত উজ্জ্বলতা। জীবন ও মৃত্যু, অন্ধকার ও আলো তাঁর ছবিতে যেন বেণীর মতো জড়িয়ে যায়। কেন তিনি ছবিতে সমানেই মৃত্যুর কথা বলেন, সে কথা আলোচনা করতে গিয়ে এক সাক্ষাত্কারে বলেছিলেন ১৯৪৬ সালে কলকাতার দাঙ্গাক্রান্ত রাস্তায় দেখেছিলেন এক রাশ মৃতদেহ ঠেলাগাড়িতে উঠিয়ে টানতে টানতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে মর্গে; সবচেয়ে উপরে এক বয়স্ক মহিলার দেহ, নির্বস্ত্র, নির্যাতিত, ক্ষতবিক্ষত বুক থেকে প্রবহমান রক্তধারা, অসাড় ধূসর দেহে কেবল ঝকঝক করছে একটি গলার হার। তাঁর বহু অসামান্য ছবি এই অন্ধকার আর এই ঔজ্জ্বল্যেরই বাহক।
গণেশ পাইনের শিল্প-কল্পনার শিকড় এ ভাবেই ইতিহাসের মধ্যে গভীর ভাবে ছড়ানো। একই সঙ্গে সেই কল্পনাই আবার সুন্দরের সাধক। তাঁর শিল্প চিরকালীন। কিন্তু মৃত্যু এসে ছিনিয়ে নিয়ে গেল তাঁর বোধদীপ্ত মন, আমাদের সাম্প্রতিক অতীত ইতিহাসে দৃঢ় ভাবে প্রোথিত, বাংলার সমাজে ওতপ্রোত প্রবিষ্ট একটি মন।
|
ছবি: গণেশ পাইনের শিল্পকৃতি।
টেম্পারা, ১৯৮৮। সৌজন্য: সিমা |