প্রবন্ধ ১...
তাঁর ঘরানায় তিনিই শুরু, তিনিই শেষ
দুপুরবেলায় খবরটা পেয়ে যতটা আহত হয়েছি, তার চেয়েও বেশি বিস্মিত। গণেশদা এখনও ছবি আঁকছিলেন। ৭৬ বছর বয়সে তাঁর চলে যাওয়াকে তাই অকালমৃত্যু ছাড়া আর কী বলা যায়!
গণেশ পাইনকে চিনি ছাত্রজীবনের শুরু থেকে। ১৯৫৫ সালে আমরা সবে গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজে ঢুকেছি। গণেশদা এত ভাল আঁকতেন যে, ফার্স্ট ইয়ারে তাঁকে ঢুকতে হয়নি। সে বছরেই সরাসরি ঢুকলেন সেকেন্ড ইয়ারে।
কলেজে আমরা তখন অবনীন্দ্রনাথের ছবি রপ্ত করছি। ছবি আঁকতে বসে বোঝা গেল, অবনীন্দ্রনাথ কে এবং কী সেটি গণেশদা চমত্‌কার জানেন। এবং শুধু সেখানেই থেমে থাকেননি। রেমব্রান্টের ছবিতে আলো-ছায়ার খেলা দেখে মুগ্ধ হচ্ছেন এবং অবনীন্দ্রনাথের প্রথাসিদ্ধ ‘বেঙ্গল স্কুল’ মেজাজে নিয়ে আসছেন সেই খেলা। ’৫৭ সালে, আমাদের সেকেন্ড ইয়ারে রাজ্যপালের হাত থেকে পুরস্কার পেল রানি লক্ষ্মীবাইকে নিয়ে গণেশদার ছবি। গাছের নীচে ঝাঁসির রানি শুয়ে, পাশে তাঁর ঘোড়া। গাছের ডালপালা, পাতার ফাঁক দিয়ে রোদ্দুরের আলো ঠিকরে পড়ছে বীরাঙ্গনার গায়ে। অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টসের প্রদর্শনীতেও দেখা গেল সেই ছবি। অ্যাকাডেমি তখন মিউজিয়ামের বারান্দায়। সেখানেই আমরা আড্ডা মারতাম। পরে ষাটের দশকে অ্যাকাডেমি নিজস্ব বাড়িতে উঠে আসে।
এই সময়েই পল ক্লি-র ‘দ্য থিংকিং আই’ বইটির সঙ্গে গণেশদার পরিচয়। পরে বারংবার বলেছেন, সে বই তাঁর চোখ খুলে দিয়েছিল। বুঝেছিলেন, শিল্পী শুধু শব্দ দিয়ে ভাবেন না। ভাবেন রেখা দিয়ে, রং দিয়ে। যে গণেশ পাইন বেঙ্গল স্কুলের প্রভাবে ‘ঝাঁসির রানি’, ‘বাউল’ বা ‘জাহানারা’র মতো ছবি আঁকতেন, তিনি রেখা আঁকায় মজে গেলেন। এক বার দুজনে জার্মানি গিয়েছি। গণেশদা সেখানে ডুডলিং-এর জন্য দামি একটি কলম কিনলেন।
গণেশ পাইনকে নিয়ে ‘অবচেতনার অন্তর্গূঢ় শিল্পী’ ইত্যাদি কত কী-ই যে বলা হত! যেমন জীবনানন্দ মানে ‘নির্জনতার কবি’, গণেশ পাইন মানেই ‘অন্তর্লোকের আলো-আঁধারি।’ এই সব তকমায় অধ্যাপক এবং সমালোচকদের কিঞ্চিত্‌ সুবিধে হলেও হতে পারে, কিন্তু শিল্পীকে বুঝতে হবে অন্য ভাবে। প্রথমত, তিনি যে দেশে বাস করেন, তার সামগ্রিক ইতিহাস। দ্বিতীয়ত, তাঁর দৈনন্দিন জীবনযাপন, সামাজিক পরিস্থিতি। তৃতীয়ত, তাঁর সৃষ্টিশীল মন, ব্যক্তিত্ব ও দক্ষতা। তিনটি বিষয়ই ক্রমাগত একে অন্যের সঙ্গে ধাক্কা খায়, সংঘর্ষ ও সমন্বয়ে তৈরি হয় শিল্পীর কাহিনি। আজও যদি গণেশ পাইনের ওই চরিত্রলক্ষণগুলি না বুঝি, ছকবাঁধা বিশেষণের আড়ালে ঢেকে রাখি তাঁর শিল্পকলাকে, সেটিই হবে আমাদের সময়কার কিংবদন্তি শিল্পীর প্রতি অন্যতম অবিচার।
গণেশদা এবং আমার পরস্পরের বাড়িতে গতায়াত পঞ্চাশের দশক থেকেই। কবিরাজ রো-র ঘিঞ্জি গলিতে তিন পুরুষের বাড়ি। শৈশবে ঠাকুমা রামায়ণ মহাভারত পুরাণের গল্প বলতেন। শেষ দিকেও ‘মহাভারত’ নিয়ে ছবি এঁকেছেন গণেশদা, বিশাল ডানার পাখিরা বারংবার ছায়া ফেলেছে তাঁর টেম্পেরায়। ‘মিথ’ তাঁর শিল্পসত্তার অন্যতম উপজীব্য। সমসাময়িকদের মধ্যে আমি যা খুঁজেছি পটচিত্রের আঙ্গিকে, বিকাশ (ভট্টাচার্য) যাকে খুঁজেছে বাস্তবতার অলিগলিতে, গণেশ পাইন তাকেই খুঁজেছেন মিথ বা পুরাণের চিত্রকল্পে।
কবিরাজ রো-র বাড়িতে ’৪৬ সালে দাঙ্গা দেখেছেন। আর্ট কলেজ থেকে পাশ করে চাকরি না পেয়ে অ্যানিমেশন ছবি, ইলাসট্রেশন করে পেট ভরানো। তারই মধ্যে চলেছে গণেশদার আত্মানুসন্ধান। জলরঙের উচ্ছলতা নয়, খুঁজতে খুঁজতে তাই বেছে নেবেন ‘টেম্পারা’, জল রংকে অস্বচ্ছ করে ‘গুয়াশ’-এর মাধ্যম। “সব কথা বলতে পারি না। বলতে চাইও না। ভাল লাগে অস্পষ্টতা, ইঙ্গিতময়তা, অনিশ্চয়তা। তাই সূক্ষ্ম রেখায় আর স্তিমিত রঙে কাজ করতে ভালবাসি,” কত বার যে বলেছেন তিনি!
এই অস্পষ্ট, অনিশ্চিত পর্বের মধ্যে ছিল নিঃসঙ্গতা, ছিল হতাশা। ‘ট্রাডিশনাল’ গণেশ পাইন কলেজ জীবন থেকে ধুতি পরতেন, এই সময়ে তাঁর পাঞ্জাবির রং বেশির ভাগ সময় গেরুয়া। ত্যাগের রং। “আমার সব শেষ হয়ে গিয়েছে। আর বোধ হয় ছবি আঁকতে পারব না,” ’৯০ দশকের শুরুতেও মাঝে মাঝে আক্ষেপ করতেন স্বল্পভাষী গণেশদা।
জীবনটা পাল্টে গেল ’৯১ সালে মীরা বউদির সঙ্গে বিয়ের পর। ফের ছবি আঁকতে শুরু করলেন। ষাটের দশকেই মীরা বউদির সঙ্গে তাঁর প্রথম আলাপ। বিয়ে হল তিরিশ বছরের ব্যবধানে, অনেক স্রোত পেরিয়ে আসার পর।
কবিরাজ রো-র বাড়ি ছেড়ে গণেশদা উঠে এলেন দক্ষিণ কলকাতায়। ছবিগুলিতে আর বিষণ্ণতা নয়, এল অন্য আবহ। আলোর ব্যবহার বাড়ল। ব্রড ব্রাশ নয়, শৌখিন সরু তুলির ছোট ছোট স্ট্রোক। ‘দ্য হ্যান্ড?’ ছবিতে স্বর্ণাভ আলোর বিচ্ছুরণে নারী এই সময়েই আঁকা। গেরুয়ার বদলে রঙিন পাঞ্জাবি। ধুতি নয়, পায়জামা। বিষণ্ণতা একদা গণেশদাকে কুরে কুরে খেত, এখন তিনি নিজের ওপর আর চাপ রাখেন না। মাস কয়েক আগে শান্তিনিকেতনে এক সভায় জিজ্ঞেস করলেন, ‘এই কি সেই পরিবর্তন?’ প্রশ্নটা আমার ভাল লাগেনি। গণেশদার সব বিষয়ে স্পষ্ট মত ছিল, রাজনীতি বিষয়েও, কিন্তু সরাসরি কখনও মুখ খুলতেন না। জরুরি অবস্থা, নন্দীগ্রাম কোনও বিষয়েই নয়। গণেশ পাইন তা হলে বদলে গিয়েছিলেন?
আজ বুঝি, বদলাননি। ক্রিস্টি, সাদবিতে এত বিক্রি, ভারতীয় চিত্রকলার প্রধান মুখ তিনি। কিন্তু কত বার বিদেশ গিয়েছেন? জার্মানি, মিশর এবং তুরস্কের মতো গোটা তিনেক ছুটকোছাটকা উদাহরণ ছাড়া কিছুই মনে পড়ছে না। “আমার জীবনে ব্যাপ্তি নেই, বৈচিত্র্য নেই, ভ্রমণে আমার প্রবল অনীহা,” নিজেই তো লিখেছিলেন তিনি।
গণেশ পাইনকে ছবি বিক্রি, নির্জনতা ইত্যাদি হিসেবে মাপতে গেলে ভুল হবে। তিনি বেঙ্গল স্কুলের সঙ্গে মুঘল মিনিয়েচার, পল ক্লি, রেমব্রাঁকে মিশিয়ে তৈরি করেন নিজস্ব ঘরানা। তার সঙ্গে মিশিয়ে দেন অন্তর্গূঢ় সাহিত্যবোধ। শক্তি, সুনীল থেকে জয় গোস্বামী সকলের কবিতা পড়তেন। আলি আকবর থেকে বিলায়েত, রবিশঙ্কর... ধ্রুপদী সঙ্গীতের অন্যতম সমঝদার।
তকমা লাগানো নয়, গণেশ পাইনের এ বার যথার্থ মূল্যায়ন শুরু হোক! ইন্টারনেট, মোবাইল অধ্যুষিত এই যুগে ঐতিহ্য আর আধুনিকতায় থাকবে না এমন স্বচ্ছন্দ গতায়াত। পুরাণ আর কবিতায়, কল্পনা আর অভিজ্ঞতার সেতুতে এ ভাবে আর হেঁটে যাবে না একাকী কোনও স্বপ্নসন্ধানী। সম্ভবত, তাঁর ঘরানায় তিনিই শুরু। তিনিই শেষ!


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.