স্মরণ...
শ্রীগণেশ পাইন
ণেশ পাইনের জন্ম ১৯৩৭ সালে। মধ্য কলকাতার একান্নবর্তী পরিবারটিতে পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয়। বাবা মারা গিয়েছিলেন কম বয়সে। আর্থিক অবস্থাও পড়তে শুরু করেছিল। ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে গণেশ স্থির করলেন, এ বার চাকরির চেষ্টা করা দরকার। কিন্তু স্লেট-পেনসিল ধরার বয়স থেকেই যে তাঁর আঁকার নেশা, সেটা বাড়ির কারও কারও চোখে পড়েছিল। বয়োজ্যেষ্ঠ এক আত্মীয় আর্ট কলেজে ভর্তি হওয়ার পরামর্শ দিলেন। গণেশ পাইনের জীবনের গতিপথ সম্ভবত সেই দিনই নির্ধারিত হয়ে গেল।
১৯৫৫। গণেশ ভর্তি হলেন গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজে। তাঁর আঁকা কলেজ কর্তৃপক্ষকে এতটাই চমকে দিল যে, তাঁরা গণেশকে প্রথমেই দ্বিতীয় বর্ষে ভর্তি করে নিলেন। আর্ট কলেজে এসেই পশ্চিমী চিত্রকলার সঙ্গে খুব বড় করে পরিচয় হওয়ার সুযোগ ঘটল। পিকাসো আর দালির কাজ তাঁকে নাড়া দিল। তবে গণেশ পাইনের প্রধান অনুপ্রেরণা ছিলেন তিন জন: অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, রেমব্রান্ট এবং জার্মান এক্সপ্রেশনিস্ট পল ক্লি। তার একটা বড় কারণ, গণেশ নিজেই বলতেন, রেমব্রান্ট এবং পল ক্লি-র কাজে প্রাচ্য সংস্কৃতির প্রভাব ছিল মস্ত। প্রায় নিঃস্ব অবস্থায় রেমব্রান্ট যখন মারা যান, তখনও মুঘল মিনিয়েচার ছবির একটা অ্যালবাম তিনি কাছছাড়া করেননি। গণেশ পাইনও মিনিয়েচার খুবই পছন্দ করতেন। কোনও কোনও সমালোচক যখন তাঁর ছবিকে নব্য-মধ্যযুগীয় (নিয়ো-মিডিয়েভালিস্ট) বলে চিহ্নিত করেছেন, গণেশ আপত্তি করেননি।

কিন্তু প্রকৃত চিত্ররসিকদের কাছে, গণেশ পাইনের ছবির মেজাজ শেষ পর্যন্ত প্রবল ভাবে আধুনিক এবং সমসাময়িক। গাঢ় সোনালি আলো-অন্ধকারে ঢাকা যে সব বাঁকাচোরা কঙ্কালকায় মুখচ্ছবি তাঁর ক্যানভাসে ফুটে উঠত, অবনীন্দ্রনাথ বা রেমব্রান্টের জগত্‌ থেকে তারা বহু বহু দূরে। গণেশ পাইন বলতেন, ওঁর মনের মধ্যে ওঁর একটা নিজস্ব পৃথিবী আছে। সেই গহীন দুনিয়াটা ছোটবেলার অজস্র স্মৃতিচিহ্ন দিয়ে গড়া।
ঠাকুমা পুরাণের গল্প শোনাতেন। বাড়িতে আসত ‘মৌচাক’। তাতে অবনীন্দ্রনাথের আঁকা আরব্যরজনীর ইলাস্ট্রেশন। প্রতিবেশী বাড়িতে গরুড়ের মূর্তি আর দেয়ালে টাঙানো নীল রঙের ভয়ানক মুখব্যাদান, পরে জেনেছিলেন ওটা ‘বিশ্বরূপ দর্শনে’র ছবি। পাড়ার মন্দিরে শ্রীচৈতন্যের বিগ্রহ, ছেচল্লিশের দাঙ্গায় সেটা নষ্ট হয়ে যায়।
চিত্রকর জীবনে এই প্রত্যেকটি অনুষঙ্গ বারংবার ফিরে এসেছে গণেশের ছবিতে। আর একটা শখ ছিল, কাগজের নৌকো বানানো। কাপড়ের টুকরো দিয়ে পাল। ঢাউস বালতির জলে নৌকো ভাসিয়ে দিয়ে একটু পরে আগুন ধরিয়ে দেওয়া। সেই নৌকো, অন্ধকার দরজা, হাড়গোড়, ছুরি, জন্তু-জানোয়ার গণেশ পাইনের ছবির খুব চেনা চরিত্র। ছোটবেলায় শোনা পুরাণকাহিনিগুলো অবচেতনের গূঢ় জটিলতার সঙ্গে মিশে এক নতুন সংশ্লেষের আকারে হাজির হত গণেশের ছবিতে। কখনও বেহুলা (দ্য ভয়েজ, ১৯৯৯), কখনও চৈতন্য (দ্য ফায়ার, ২০০৫)। জীবনের শেষ বড় কাজও মহাভারত নিয়ে ৪২টা ছবির সিরিজ এঁকেছিলেন ২০১০-১১ সালে।
ছবি আঁকতেন অনেক সময় নিয়ে। বছরে তিন-চারটির বেশি কদাপি নয়। কলেজ স্ট্রিট বা এসপ্লানেডের দু’একটা বাঁধা আড্ডা ছাড়া খুব একটা মুখও খুলতেন না। মিতভাষী, আত্মম্ভরিতাহীন, বিনয়ী অথচ আত্মপ্রত্যয়ী গণেশ পাইন বরাবর নির্জনতাপ্রিয়। শিল্পীসুলভ উদ্দামতায় গা ভাসাতে কোনও দিন দেখা যায়নি তাঁকে। তার মানে অবশ্য এ নয় যে, চারপাশের জগত্‌-জীবন বিষয়ে নির্লিপ্ত ছিলেন। বহুরূপীর নাটক, শক্তির কবিতা, ফেলিনির সিনেমা, সবই তাঁর ছবির বিষয় হয়েছে। উত্তাল সত্তরের মুখ তাঁর ক্যানভাসে হয়ে উঠেছে অশ্বত্থামা (দি অ্যাসাসিন, ১৯৭৯)।
গণেশের ছবি মানে প্রধানত মৃত্যু, বিষাদ, ভয় আর নিঃসঙ্গতার পরাবাস্তব অবয়ব। কখনও সখনও, যখন মনে হয়েছে, ছবিগুলো বড় বেশি ব্যক্তিগত হয়ে উঠছে, দর্শক হয়তো তার খেই পাবেন না, কেবল তখনই বাইরের দুনিয়ার ছবি এঁকেছেন কয়েকটা। ১৯৮৭ সালের আগে একক প্রদর্শনী অবধি করেননি। জীবনের বেশির ভাগটা কবিরাজ রোয়-এর সরু গলিতে কাটিয়েছেন। গোটা পৃথিবী নিজের গরজে সেখানে এসে ভিড় জমিয়েছে। শুধু ছবির বাজারদরে নয়, শৈলজ মুখোপাধ্যায়ের পরে গণেশ পাইন একমাত্র বাঙালি চিত্রকর, যাঁকে তাবত্‌ বিশ্বের শিল্পী ও শিল্পরসিকরা প্রথম সারিতে রেখে আনত কুর্নিশ জানিয়েছেন।
এই আসনটা অর্জন করতে গণেশ পাইনকে পেরোতে হয়েছে অনেক লম্বা একটা পথ। ১৯৫৯-য় পাশ করে বেরনোর পরে ১৯৬৭ পর্যন্ত তেমন কোনও কাজ পাননি। বইয়ের প্রচ্ছদ-ইলাস্ট্রেশন করা থেকে শুরু করে মন্দার মল্লিকের সঙ্গে অ্যানিমেশন ছবি, মায় যাত্রার পোস্টারও এঁকেছেন। চাকরি জোটেনি। ১৯৬৩ সালে যোগ দিলেন ‘সোসাইটি অব কনটেম্পোরারি আর্টিস্টস’ গোষ্ঠীতে। আরও পাঁচ বছর পর থেকে গণেশের ছবি বিক্রি হতে শুরু করল। ১৯৭০ সালে পৌঁছে টেক্সটাইল ডিজাইনারের একটা চাকরি পেয়েছিলেন। চাকরিটা নিতে যাচ্ছেন, বাস থেকে একটা হতদরিদ্র বাচ্চা মেয়ের দিকে চোখ পড়ল। মেয়েটা ফ্রকের কোনায় প্রাণপণে একটা সিঙাড়া আঁকড়ে রেখেছিল। গণেশ বাস থেকে নেমে পড়লেন। ঠিক করে ফেললেন, যা হয় হোক! চাকরি তিনি করবেন না।
১৯৭০-এই সাদবি-র নিলামে ‘দি অ্যানিমাল’ ছবিটা বিক্রি হল। উচ্ছ্বসিত ক্রেতা নিজে গণেশকে চিঠি লিখলেন, তাঁর নাম ইহুদি মেনুহিন। ওই বছরেরই আর একটা দিন, ইন্দিরা গাঁধী গিয়েছেন ন্যাশনাল আর্ট গ্যালারিতে, চোখ আটকে গেল একটি টেম্পারা-য়, ‘মাদার অ্যান্ড চাইল্ড’। ইন্দিরার আগ্রহে সেই টেম্পারা পর দিন প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ে নিয়ে যাওয়া হল। জলরং, তেল, প্যাস্টেল, গুয়াশ, মিশ্র মাধ্যম, সব রকম কাজই করেছেন গণেশ। কিন্তু তাঁর সেরা কাজগুলো টেম্পারাতেই। ডিমের বদলে সব্জির লেই বানিয়ে আঠা হিসেবে ব্যবহার করার ভাবনাটাও ওঁর নিজের।
এত কিছু ঘটে যাচ্ছিল, প্রাগ-লন্ডন-প্যারিস প্রদর্শনীতে তুমুল সমাদর বাঙালি কিন্তু দীর্ঘ দিন গণেশ পাইনকে তেমন করে চেনেনি। ১৯৭৪ সালে একটি লেখায় মকবুল ফিদা হুসেন যখন সেরা দশ নতুন প্রতিভার তালিকায় এক নম্বরে গণেশ পাইনকে রাখলেন, বাঙালি নড়েচড়ে বসল। সংস্কৃতি আর রুচি নিয়ে বাঙালি অহঙ্কার করে ঠিকই, কিন্তু চিত্রশিল্পের রসগ্রহণে তার তেমন আগ্রহ দেখা যায় না। গণেশ পাইন নিজেও বিষয়টি লক্ষ করেছিলেন। বলেছিলেন, বাঙালির রুচি মূলত সাহিত্যঘেঁষা। বাঙালি দ্বিতীয় শ্রেণির কবিকে মনে রাখে, প্রথম সারির শিল্পীকে নয়।

ছবি: আত্মপ্রতিকৃতি, ১৯৮০।
ঋণ: শিল্পচিন্তা, গণেশ পাইন (আনন্দ)


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.