নতুন চেহারায় গড়ে উঠলেও মাত্র জনা পঞ্চাশেক হকারের দৌরাত্ম্যে পুরোদমে চালু হতে পারছে না লেক মার্কেট। অভিযোগ, রাজ্যের মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের।
রাস্তার উপর বসে পড়া হকারদের জন্য দুর্বিসহ অবস্থা কলকাতার ঐতিহ্যশালী নিউ মার্কেট চত্বরের। অভিযোগ, পুরসভার একাধিক মেয়র পারিষদেরই। ওই হকারদের সরিয়ে কী ভাবে ঢোকা-বেরনো অবাধ করা যায়, তা নিয়ে রীতিমতো চিন্তায় পুরসভা ও প্রশাসন।
শহরের যত্রতত্র বসে পড়া হকারদের নিয়ে বিরক্ত পুলিশ ও পুর প্রশাসন। এসএসকেএম হাসপাতালের সামনে হকারদের ব্যবসা বন্ধ করতে রাস্তায় নামতে হয়েছিল মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেই। তাঁর নির্দেশে বেশ কয়েক জন হকারকে তুলেও দেয় পুলিশ।
সোমবার অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতায় সরাসরি না বলা হলেও সেই হকারদেরই বৈধতা দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে বলে জানাচ্ছেন সরকারি আধিকারিকরা। বাজেট প্রস্তাবে বলা হয়েছে, যে সব অসংগঠিত ব্যবসায়ীদের নিজস্ব দোকান বা ব্যবসার জায়গা নেই, তাদের আইনি বৈধতা দেওয়া হবে। এবং হকাররাই এই সংজ্ঞার আওতায় পড়েন বলে মনে করছেন তাঁরা।
যদিও সরকারি ভাবে বিষয়টি নিয়ে কোনও ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি। তবে রাজ্য সরকার সূত্রের খবর, বন্ধের দিনে দোকান খোলা রাখার জন্য হকারদের বাহবা জানিয়ে তাঁদের আইনি অধিকার দেওয়ার কথা ঘোষণা করছিলেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী।
সেই ঘোষণা মতোই সোমবার বাজেট প্রস্তাবে হকারদের লাইসেন্স দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছেন অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র। অর্থ দফতর সূত্রের খবর, হকারদের লাইসেন্স দেওয়ার সিদ্ধান্ত সরকারের আয় বাড়ানোর নবতম পন্থাও। হকারদের বৈধতা দিলে লাইসেন্স-ফি বাবদ
আয় বাড়বে।
মহাকরণ সূত্রের খবর, মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণার পরেই হকারদের লাইসেন্স দেওয়ার কাজ শুরু করার বিষয়ে তোড়জোড় শুরু করে দেয় রাজ্য পুর উন্নয়ন দফতর। ঠিক হয়েছে, এই লাইসেন্স দেওয়ার কাজ রাজ্য সরকারের ‘হকার নীতি’ মেনেই হবে। মহাকরণের এক কর্তার কথায়, “ইতিমধ্যেই হকার নীতির একটি খসড়া তৈরি করেছে পুর দফতর। সেটি শ্রম দফতরে পাঠানো হয়েছে। শ্রম দফতর খসড়া নীতি খতিয়ে দেখে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে অনুমোদনের জন্য পাঠাবে। ওই নীতির ভিত্তিতেই হকারদের লাইসেন্স দেবে সরকার।”
পুর দফতর সূত্রের খবর, ২০০৯ সালে বামফ্রন্ট সরকার একটি হকার নীতি তৈরি করেছিল। কিন্তু তা আইনে পরিণত করা হয়নি। পুর দফতর সূত্রের খবর, মমতা-সরকারের হকার নীতিও তৈরি হয়েছে অনেকটা সেই ধাঁচেই। তবে কোন রাস্তায়, কী ভাবে হকার বসানো হবে সে ব্যাপারে অবশ্য সন্দেহ রয়েই গিয়েছে সরকারের অন্দরে। মহাকরণের ওই কর্তার কথায়, “যে কেউ রাস্তায় বসলেই তাঁকে লাইসেন্স দেওয়া হবে, এমনটা নয়। সে ক্ষেত্রে কোথায় নিয়ন্ত্রণ করা হবে, কাদের লাইসেন্স দেওয়া হবে, তা সবই নির্ধারিত করে দেওয়া হবে এই হকার নীতিতে।”
কলকাতা পুরসভা সূত্রের খবর, আধুনিকীকরণের পর হকারের বাধায় খোলা যায়নি লেক মার্কেট। মুখ্যমন্ত্রী নির্দেশে জট খুলতে মাঠে নেমেছেন পঞ্চায়েত মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়। হকারদের বৈধতা দেওয়া নিয়ে সুব্রতবাবুর বক্তব্য, “বৈধতা মানে এই নয় যে, শহরের যেখানে-সেখানে হকার বসে পড়বে। হকারকে বসতে হবে এক লাইনে। মার্কেটের সামনে ঢোকার রাস্তা ছেড়ে।” তিনি বলেন, “অনেক জায়গায় দেখা গিয়েছে হকারেরা ছাউনি করে বসে পড়েছে! এটা তো চলতে পারে না। তা হলে তো শহরের পরিবেশ নষ্ট হবে। বিপদও বাড়বে।”
বিভিন্ন রাস্তা ও বাজারের সামনে বসা হকারদের দৌরাত্ম্য নিয়ে অনেকেই ক্ষুব্ধ। নিউমার্কেট ট্রেডার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি দেবব্রত ভট্টাচার্যের অভিযোগ, “আমাদের মার্কেটে ঢোকার সব পথ বন্ধ হয়ে গিয়েছে হকারদের জন্য। মার্কেটের সামনে রাখা গাড়ির উপরেই চর্মজাত সামগ্রীর ব্যবসা করছে হকারেরা। পুর প্রশাসনকে প্রতিবাদ জানিয়েও লাভ হচ্ছে না।”
হগ মার্কেটের এক ব্যবসায়ী বলেন, “পুরো বাজারটা হকাররা ঘিরে রেখেছে! ভেতরে কোনও অঘটন ঘটলে বের হওয়ার রাস্তা পর্যন্ত নেই।” ধর্মতলায় চাঁদনি মার্কেটের সামনে যত্রতত্র হকাররা বসে পড়ায় যান চলাচলের রাস্তা প্রায়ই বন্ধ হয়ে থাকে। লেনিন সরণী, হাতিবাগান, শ্যামবাজার, গড়িয়াহাটের মতো জনবহুল এলাকার ফুটপাথ জুড়ে শুধুই হকার। মানুষ চলার জায়গা নেই। শহরের যত্রতত্র হকার বসায় পুলিশকেও যে সমস্যায় পড়তে হয়, তা জানিয়েছেন কলকাতা ট্র্যাফিক পুলিশের এক পদস্থ কর্তা। হকারদের লাইসেন্স দেওয়া শুরু হলে শহরের ফুটপাথগুলো আরও দখল হয়ে যাবে বলেই আশঙ্কা ওই পুলিশ কর্তার।
কী ভাবছে কলকাতা পুরসভা?
মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায় অবশ্য হকার নিয়ে সরকারের নয়া ঘোষণার কথা জানেনই না। মঙ্গলবার এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, “হকারদের বৈধতা দেওয়া নিয়ে কোন খবর আমার জানা নেই।” শহরের হকার উচ্ছেদের মূল দায়িত্বে পুরসভার মেয়র পারিষদ (জঞ্জাল অপসারণ) দেবব্রত মজুমদার। হকারদের বৈধ করার বিষয়ে সরকারের প্রস্তুতির খবর তাঁরও জানা নেই। মেয়র পারিষদ দেবাশিস কুমার অবশ্য বলেন, “হকারদের বৈধতা দিলে পুরসভার কিছু আয় হবে।” |