‘সুস্থ হলেই আসব’ বলেছিলেন |
অরুণ মুখোপাধ্যায় • শান্তিনিকেতন |
গত ফেব্রুয়ারিতেই এসেছিলেন। কলকাতায় ফিরেই অসুস্থ হয়ে পড়েন। কথা ছিল, সুস্থ হলেই ফিরবেন শান্তিনিকেতনের বাড়িতে। কিন্তু তুলি থেমে গেল। ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ চিত্রকর আর ফিরতে পারলেন না তাঁর প্রিয় লালমাটির দেশে।
এমনিতে শান্তিনিকেতনে এলে সবার সঙ্গে খুব একটা মিশতেন না গণেশ পাইন। সব কিছু নিবিষ্ট মনে পর্যবেক্ষণ করতেন। যার প্রতিফলন ঘটত ছবিতে। তবে একজন ব্যতিক্রম ছিলেন। শান্তিনিকেতনে এলে দীর্ঘ আড্ডা দিতেন শিল্পীবন্ধু সনৎ করের সঙ্গে। আর আড্ডা হত ছবি নিয়েই। প্রিয়বন্ধুর বিচ্ছেদ যন্ত্রণা নিয়েই বিশ্বভারতীর কলাভবনের এই প্রাক্তন অধ্যক্ষ জানালেন, “গণেশ পাইনের ছবির মধ্যে অসাধারণ আধুনিকতা ছিল। নিজস্ব ঘরানায় ছবি আঁকতেন। তাঁর ছবিতে যে রোম্যান্টিকতা ও ফ্যান্টাসি আছে, ভারতীয় চিত্রকলায় এর আগে তা দেখা যায়নি।” বন্ধুর কথা বলতে গিয়ে শান্তিনিকেতনের এক পুরনো চিত্রশিল্পীর কথা মনে পড়িয়ে দিলেন সনৎবাবু। বললেন, “আমাদের এখানে প্রশান্ত রায় নামে একজন চিত্রকর ছিলেন। তাঁর ছবিও গণেশ পাইনকে উদ্বুদ্ধ করেছিল।”
শুধু কি ছবি? |
যৌবনে নিজের ঘরে ছবি আঁকতে ব্যস্ত শিল্পী গণেশ পাইন।
|
শান্তিনিকেতনের সঙ্গে তাঁর যোগ তো সঙ্গীতেও। নিজে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের অনুরাগী ছিলেন। প্রথমে বাড়ি তৈরি করেছিলেন শ্যামবাটি সংলগ্ন গোয়ালপাড়া যাওয়ার রাস্তার ধারে। আর সেই বাড়ি উদ্বোধনের দিন ঘরোয়া আড্ডায় ডেকে এনেছিলেন শান্তিনিকেতনের বাসিন্দা বিশিষ্ট শাস্ত্রীয় সঙ্গীতশিল্পী মোহন সিংহ খাঙ্গুরাকে। সঙ্গীত পরিবেশন করেছিলেন তিনি। সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন তাঁর ছেলে প্রয়াত বিক্রম সিংহও। সেদিনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে মোহনবাবু বললেন, “আমরা অনেক রাত পর্যন্ত গেয়েছিলাম। দারুণ আড্ডাও হয়েছিল। গণেশবাবুর সঙ্গীতের প্রতি যে এত আগ্রহ, সেদিনই প্রথম আবিষ্কার করি। এখনও সেদিনের স্মৃতি টাটকা হয়ে আছে।”
সেই বাড়ি বিক্রি করে দিয়ে গণেশবাবু অদূরেই উঠে এসেছিলেন একটি অ্যাপার্টমেন্টে। শান্তিনিকেতন এলে এতদিন সেখানেই থাকতেন। সেখানে তাঁর প্রতিবেশী ছিলেন লোকসভার প্রাক্তন স্পিকার সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়। গত বছরই বিশ্বভারতী গণেশবাবুকে দেশিকোত্তম পুরস্কার দিয়েছিল। আর তখন প্রতিবেশীকে অভিনন্দন জানিয়ে একটি চিঠি দিয়েছিলেন সোমনাথবাবু। সোমনাথবাবু বলেন, “তাড়াতাড়িই সেই চিঠির উত্তর দিয়েছিলেন গণেশবাবু। মনোরম সেই চিঠিতে তিনি আমাকে ‘সোমনাথদা’ বলেও সম্বোধন করেছিলেন।” প্রতিবেশীর আকস্মিক মৃত্যুতে মর্মাহত তিনিও। |
গত এপ্রিলে বিশ্বভারতীর একটি অনুষ্ঠানে অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে। ফাইল চিত্র। |
আর গর্ভনমেন্ট আর্ট কলেজে গণেশ পাইনের থেকে মাত্র এক ক্লাস নীচে পড়তেন চিত্রকর যোগেন চৌধুরী। তখন থেকেই তাঁদের যোগাযোগ। সেই এক ক্লাস উঁচুতে পড়া অন্তর্মুখী ও ভাবুক ছেলেটি এ ভাবে চলে যাবেন, তা ভাবতে পারেননি যোগেনবাবুও। গণেশবাবুর কাজ কেমন লাগত? উত্তরে বললেন, “ওঁর ছবির মধ্যে অবক্ষয়, ব্যক্তি মানুষ প্রভৃতি প্রাধান্য পেয়েছে। আন্তর্জাতিক স্তরে তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়েছিল। বিশেষ করে পেপারের উপর টেম্পারা ও জলরং দিয়ে অসাধারণ ছবি আঁকতেন। অবনীন্দ্রনাথের ছবিও তিনি খুব ভালবাসতেন।”
দু’ দিন আগেও সনৎবাবুকে ফোনে জানিয়েছিলেন সুস্থ লাগছে। আর মঙ্গলবার সবাইকে অবাক করে দিয়ে চলে গেলেন গণেশ পাইন। |