|
|
|
|
আনন্দplus এক্সক্লুসিভ |
মহারাজের গুগলি |
সৌরভের টিভি অভ্যুদয় ড্রেসিং রুমে বসে দেখেছেন তিনি। নতুন ‘দাদাগিরি’ শুরু
হওয়ার আগে প্রথম বছরের কাহিনি শোনালেন অনিলাভ চট্টোপাধ্যায়্য |
এ বারের সরস্বতী পুজোর দুপুর। ডোনার স্কুলের পুজোর ভোগ খেয়ে সৌরভের সঙ্গে কিছুটা আড্ডা মেরে ফিরছি, চণ্ডীদাকে দেখলাম। সেই শেষ দেখা। হেঁটে বসার ঘরে আসছেন। সৌরভ বাবাকে দেখে একটু থামল। মাকে ডেকে বলল, “ঘরের কার্পেটগুলো সরিয়ে নিতে বলো। বাবা এখন পা-টা টেনে হাঁটে। কার্পেটে জড়িয়ে পড়ে গেলে বিপদ হবে।” গোড়ালিতে একটা ব্যথার জন্য সৌরভ নিজেও সেদিন একটু খুঁড়িয়ে হাঁটছে। তাই নিজেই এল একেবারে গেট অবধি ছেড়ে দিতে। বৌদি (সৌরভের মা) একটু উদ্বিগ্ন, “হ্যাঁরে মহারাজ, বরফ লাগাবি একটু? আর ডাক্তারও দেখা।” মাকে কিছু একটা বলে নিরস্ত করে লিফ্টে দাঁড়িয়েই সৌরভ বলছিল, “এদের মতো মানুষ হবে না। পৃথিবীতে মা-বাবার তুলনা হয় না কোনও।”
কয়েক দিন পরেই ওই ভয়ঙ্কর খবরটা। তখন মাঝরাত। বেহালার বাড়ির বিশাল ড্রয়িং রুমটায় চণ্ডী গঙ্গোপাধ্যায়ের মৃতদেহ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কাচের বাক্সে রাখার তোড়জোড় চলছে। সৌরভই বলল, “মা বাপির চুলটা আঁচড়ে দিক।” আর নিরূপা গঙ্গোপাধ্যায় যখন শেষ বারের মতো পরিপাটি করে সাজিয়ে দিচ্ছেন চণ্ডী গঙ্গোপাধ্যায়কে, চোখের কোণ মুছতে দেখলাম সৌরভকে। কিছু পরে দোতলার ঘর থেকে যখন একা একা বেরিয়ে এল, তখনও দুটো চোখ রক্তজবার মতো লাল। সবার সামনে চোখের জল ফেলতে পারে না। সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের অনেক কান্নাই থাকে অলক্ষ্যে, নিজের অন্তর মহলে। |
|
‘দাদাগিরি’র মঞ্চে হাসিমুখে বাদশা আর মহারাজ |
গত কয়েক দিনের মন খারাপটা অনুমেয়। গোটা গঙ্গোপাধ্যায় বাড়িটাই শোকসাগরে ডুবে। সেটা থেকে মন ঘোরাতেই এক বন্ধু গত শনিবার সানা-ডোনাকে নৈশভোজে আমন্ত্রণ করেছিলেন। সৌরভ প্রথমে রাজি হয়েও পরে বলল, “না গো, যাব না। মা বাড়িতে অনেকটা মন খারাপ নিয়ে বসে। মাকে একা ফেলে এখন বের হব না।”
ছোটখাটো কয়েকটা ঘটনা। কিন্তু সৌরভের সাফল্যের সিঁড়িটা এগুলো দিয়েই তৈরি। জেদ, সংকল্প, লড়াই, কামব্যাক এগুলো তো বাহ্যিক অনুষঙ্গ মাত্র। আসল হল ওইগুলো। ওগুলোই বাইরের চেনা সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়কে জ্বালানি দেয়। সৌরভ ভারতের সর্বকালের সেরা অধিনায়ক। সব প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়ে কামব্যাক করেছে। আবার বাংলার টিভির সফলতম অ্যাঙ্কর। ‘কাল্ট’ হয়ে যায় তাঁর উপস্থাপনার টেলিভিশন শো।
সোমবার। সেলিব্রিটি ক্রিকেট লিগের ফাইনাল দেখে বেঙ্গালুরু থেকে ফিরছি।
এয়ারপোর্টে ঢোকার মুখেই সৌরভের বিবিএম। “‘দাদাগিরি’ সাইন করলাম। এইমাত্র। তোমায় জানালাম।” জি বাংলার সঙ্গে আবার দু’বছরের জন্য চুক্তিবদ্ধ হচ্ছে জানতাম। কথাবার্তা এগোচ্ছিল, কয়েকটা বিষয়ে আটকে আছে তাও জানতাম। মনে প্রাণে চাইছিলাম সৌরভ যেন আবার ফিরে যায় ‘দাদাগিরি’র সেটে। অনেক রঙিন আলো, ঝলমলে সেট আর মুগ্ধতায় ভাসতে থাকা বাংলার বিভিন্ন প্রান্তের প্রতিযোগীদের সামনে দাঁড়িয়ে যেন আবার বলতে থাকে, “নমস্কার আমি সৌরভ গাঙ্গুলি।
শুরু করছি আজকের ‘দাদাগিরি’।” এই শোয়ের গর্ভসঞ্চার থেকে টানা একটা বছর ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে থাকার সূত্রে বলতে পারি, ‘দাদাগিরি’ প্রচুর মানুষকে নতুন ভাবে ভাবতে শিখিয়েছিল। টিভি শো ছাপিয়ে এই দেড় ঘণ্টা ছিল বাঙালি উত্তরণের একটা অধ্যায়। ‘দাদাগিরি’র মঞ্চে বাংলা দেখেছিল কখনও শহিদুল ইসলাম, কখনও মোসলেম মুন্সি, কখনও চৈতালি চট্টোপাধ্যায়, কখনও সুশান্ত মুখোপাধ্যায়, আবার কখনও শ্রাবণী সেনগুপ্তকে। হাওড়ার শহিদুল অভাবের তাড়নায় কিডনি বিক্রি করতে গিয়ে দেখেছিলেন যিনি কিনবেন তাঁর আর্থিক অবস্থা আরও খারাপ। ব্যস, একটা কিডনি দান করে চলে আসেন। নদিয়ার মোসলেম মুন্সি রাস্তা থেকে ভবঘুরে ধরে এনে নিজের বাড়িতে রাখেন। চিকিৎসা করেন। সুস্থ করে বাড়ি ফেরত পাঠান। বেলঘরিয়ার চৈতালি চট্টোপাধ্যায় রাজ্যে প্রথম মহিলা বাস ড্রাইভার। আসানসোলের সুশান্ত মুখোপাধ্যায় মোমের মূর্তি গড়েন। বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে যে মাদাম তুসোর বিস্ময় লুকিয়ে আছে, দাদাগিরিই তা দেখিয়েছিল। ‘দাদাগিরি’র ফাইনালে সৌরভের মোমের মূর্তি গড়ে দিয়েছিলেন সুশান্তবাবু নিজে। শ্রাবণী সেনগুপ্ত স্পেশাল বাচ্চাদের স্কুল চালান। একমাত্র মেয়ে অদ্রিজা ক্রোমোজমিক ডিসঅর্ডারের শিকার। শ্রাবণী সব ছেড়ে এই বাচ্চাদের বড় করার ব্রত নিলেন। সে ভাবেই গড়লেন স্কুল। মেয়ে অদ্রিজা এখন মাধ্যমিক পরীক্ষা দিচ্ছে। এ রকম কত কত। একেবারে ভাবনাচিন্তার স্তরে যখন ‘দাদাগিরি’, তখনই আমরা ঠিক করেছিলাম গোটা বিষয়টাতে যেন সেই মানুষরাও থাকে, যাঁদের বেঁচে থাকার মধ্যে একটা দাদাগিরি রয়েছে।
শারীরিক দিক থেকে প্রতিবন্ধকতার শিকার এ রকম কয়েক জনকে নিয়ে হয়েছিল এক বিশেষ পর্ব। মঞ্চে কাঞ্চন গাবা। চোখে দেখতে পান না। কিন্তু কপিরাইট ল’ইয়ার। পর্বতারোহণ করেন। কিংবা বিশ্বনাথ অধিকারী। চোখে দেখেন না। এক সময় ট্রেনে গান গেয়ে পেট চলত। ঊষা উত্থুপের চোখে পড়ে যান। অডিও অ্যালবাম বের হয়। ‘দাদাগিরি’র মঞ্চে সৌরভকে নিয়ে গান গেয়ে মাতিয়ে দিলেন। এই শো দেখে অভিনেতা বিপ্লব চট্টোপাধ্যায় এসএমএস করেছিলেন এখনও মনে আছে। “বেস্ট এপিসোড”। টান টান হয়ে গোটা বাংলা দেখত সাধারণ মানুষের দাদাগিরির গল্প। ক্যুইজের মোড়কে, খেলার মোড়কে। আর ছিল উল্টো দিকের মানুষটাকে নিয়েই উপচে পড়া আবেগ, ভালবাসা, শ্রদ্ধার মিশেল। এক প্রতিযোগী ভদ্রমহিলা কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলেন, “বাবু তোর জন্য এলাম।” তাঁর সদ্য প্রয়াত ছেলে ছিল সৌরভের বিরাট ভক্ত। পুত্রশোক বুকে নিয়ে মায়ের আসা ছেলের জন্য। হাওড়ার এক প্রতিযোগী এসে সৌরভকে বলেছিলেন, “আপনি তখন কামব্যাক করছেন। রঞ্জি খেলছেন। আমার বাবা মৃত্যুশয্যায়। মারা যাওয়ার আধ ঘণ্টা আগেও আপনার রান জানতে চেয়েছিলেন। আর আপনি রান করছেন শুনে বলেছিলেন, ‘ওকে টিমে ফেরাতেই হবে।’” অশোকনগরের একটি মেয়ে এসে শুনিয়েছিলেন, “দাদা, মাধ্যমিকের রেজাল্ট ভাল না হওয়ায় চেনাশোনা অনেকে কথাও বন্ধ করে দেয়। আমিও খুব ভেঙে পড়ি। তার পর তোমার কথা ভাবি। তুমি পারলে আমি পারব না কেন? উচ্চমাধ্যমিকে ফার্স্ট ডিভিশন পেয়েছি দাদা।’’ দাদা তখন যেন সত্যিই নিজের দাদা। কেউ রাখি পরিয়ে দিচ্ছে। কেউ গ্রামের মন্দিরের জাগ্রত মা কালীর ফুল এনেছে। কেউ ছবি এঁকে এনেছে। সৌরভ নিজেও এ সবে প্রচণ্ড আলোড়িত হয়ে যেত। গ্রিনরুমে ফিরে কত বার প্রশ্ন করেছে, ‘‘এ সব সত্যি? এরা যা বলছে, সব সত্যি!’’ আসলে বাংলার প্রতিটা ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে ওর জন্য কতটা আবেগ লুকিয়ে আছে, নিজেই বোধ হয় জানত না। ‘দাদাগিরি’ নিশ্চয়ই বুঝিয়েছে খানিকটা।
একই সঙ্গে ওর নিজের আন্তরিকতার কথাও বলতে হবে। প্রতিটা শু্যটিং-এর অন্তত পনেরো মিনিট আগে চায়ের কাপ নিয়ে সেটে দাঁড়িয়ে থাকত। আলাপ সারত প্রতিযোগীদের সঙ্গে, যাতে শু্যটিং-এর সময় তাঁরা ঘাবড়ে না যায়। ‘দাদাগিরি’র একটা বড় ইউএসপি বোধহয় এই অন্তরঙ্গতাও। একেবারে প্রথম দিকের একটা এপিসোডে ক্যানসারে আক্রান্ত এক বয়স্ক প্রতিযোগী এসেছিলেন। সৌরভকে বলেছিলেন, “আপনাকে দেখে বাঁচার রসদ নিতে এই শো-তে এসেছি।” সৌরভ তখনও ততটা সাবলীল নয়। ওই এপিসোড টেলিকাস্টের পর অভিনেতা ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ফোন। ভাস্করদা প্রবল সৌরভভক্ত। ওই এপিসোড দেখে ভাস্করদা প্রবল উত্তেজিত। |
প্রতিযোগীরা রাখি পরিয়ে দিচ্ছেন দাদাকে |
বাচ্চাদের এপিসোড ছিল সুপারহিট |
|
“হ্যাঁ রে, ও রকম এক জন মানুষকে দেখে পিঠে হাত রাখবে না? ইনটিমেসিটাই থাকছে না কিন্তু।” ইনটিমেসি কী, সৌরভ তো তখন ও সব শুনে আরও গুটিয়ে যাচ্ছে। তেরো-চোদ্দো বছর আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলে আর লন্ডন, সিডনি, পোর্ট অব স্পেন করে বাংলার এই মানুষগুলোকেই চেনা হয়নি। সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়কে বাংলার মানুষ কী চোখে দেখে সেটাই জানা হয়নি। তবু ভাস্করদার কথাটা যেন চোখ খুলে দিল। অন্তরঙ্গতা বাড়াতে হবে। একটা টোটকা ছিল আমার তরফ থেকে। “প্রশ্নের পরই নিজের কম্পিউটার স্ক্রিনের সামনে থেকে সরে এসে প্রতিযোগীদের একেবারে পাশে চলে যাও। একেবারে সামনে থেকে কথা বল। দেখবে ওরাও অনেক বেশি ইন্ট্যারাক্ট করতে পারছে।” সৌরভও নিজেকে বদলে নিল দ্রুত। তবু আমার মনে হয় দু’টো এপিসোড অ্যাঙ্করিং করে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় অনেক বেশি পরিণত হয়েছিল। একটা হল, বাংলা ক্রিকেটারদের নিয়ে একটা এপিসোড। স্নেহাশিস, শরদিন্দু, লক্ষ্মী, রণদেব, দীপ, সম্বরণদের চেনা বৃত্তে দাঁড়িয়ে অনেকটা যেন আত্মবিশ্বাস পেয়েছিল প্রথমবার। সম্বরণদা বলেই ফেলল, “মহারাজ, আমার অধিনায়কত্বে তোর অভিষেক। তার পর তুই যত দূর গিয়েছিস, গর্ব হয় আমাদের। আর আজ এখান থেকে অনেকটা গর্ব নিয়ে ফিরব।” আর সৌরভ নিজে প্রচণ্ড চার্জড হয়ে গিয়েছিল স্বাধীনতা দিবস নিয়ে একটা স্পেশাল এপিসোড করে। সেদিন এসেছিলেন প্রাক্তন লেফটেনান্ট কর্নেল শঙ্করনাথ বসু। তাঁর ছেলে কর্নেল শেখর বসু, কার্গিল যুদ্ধে শহিদ। পিয়াল অধিকারী নামে এক ফোটোগ্রাফার এসেছিলেন যিনি কার্গিল যুদ্ধের ছবি তুলেছিলেন। এসেছিলেন এয়ার ফোর্সের কয়েক জন এবং এনএসজি কমান্ডো দীপাঞ্জন চক্রবর্তী। প্রত্যেকের অভিজ্ঞতা, গল্প, দেশপ্রেমের কাহিনি সৌরভকে বেশ অনুপ্রাণিত করেছিল, বেশ মনে আছে। কথা প্রসঙ্গে বহুবার বলেছে আমার সেরা এপিসোড।
তবে আমরা প্রবল উৎসাহ পেয়েছিলাম জি-বাংলার খুদে শিল্পীদের নিয়ে ওর সঞ্চালনা দেখে। এই শো যে বিরাট একটা মাত্রা নিতে চলেছে সেদিনই বোধহয় স্পষ্ট ছিল। রীতিমত সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের স্টারডমটা গা থেকে খুলে অনায়াসে বিট্টু, তানিয়াদের বন্ধু হয়ে গেল। বিট্টু স্টেজে পড়ে গিয়েছে। স্নেহশীল বাবার মতো হাত ধরে তুলে ধরেছে। আবার এপিসোডের শেষের দিকে বাচ্চাদের সঙ্গে ‘মসককলি মসককলি’ গানের সঙ্গে নাচ। পিসিআর-এ আমরা তখন রীতিমত চমকে গিয়েছি। আনন্দে চিৎকার করছি। কাউকে কিছু বলতে হয়নি। হঠাৎই সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় নাচছে! বাচ্চাদের সঙ্গে। শো-এর প্রয়োজনে।
ওঁর শেষ টেস্টের সময় নাগপুরের হোটেলের ঘরে যখন গল্প করছি, তখনই কথা প্রসঙ্গে টিভি অ্যাঙ্কারিংয়ের বিষয়ে কথা হয়। সৌরভ বলেছিল, “নাচ, গানের শো পারব না। ক্যুইজ শো করতে পারি।” সেখান থেকে এতদূর। ‘দাদাগিরি’র প্রথমবার শু্যটিং-এর আগে ওর বাড়ি গিয়েছি। সঙ্গে পরিচালক শুভঙ্কর আর জি-এর এক্সিকিউটিভ প্রযোজক নবনীতা। নবনীতা প্রস্তাব দিল, “দাদা কয়েকটা প্রশ্ন রিহার্স করো না।” সৌরভ বলল, “না না, ঠিক সময়ে, ঠিক করে দেব।” সৌরভের বাড়ি থেকে বের হয়ে বেশ চিন্তায় শুভঙ্কর, “দাদা তো এখানেই লজ্জা পাচ্ছে! কী হবে বলো তো।” অথচ কাউকে কোনও চিন্তার সুযোগ দেয়নি সৌরভ। প্রতিটা মুহূর্তে কী ভাবে ইম্প্রোভাইজ করা যায় দেখিয়ে দিয়েছে ‘দাদাগিরি’তে। কোনও স্ক্রিপ্টের প্রয়োজন নেই। ওঁর জীবন, জীবনদর্শন, অভিজ্ঞতাটাই চিত্রনাট্য। ফুটবলারদের নিয়ে এপিসোডে সমরেশ চৌধুরীকে উত্তরের ক্লু দিতে গিয়ে বলেছে, “আমাকে ইমরান খান এক বার বলেছিল, ঝড়ের সময় বড় পাখিরা মেঘের উপর দিয়ে ওড়ে।” কিংবা ছোটদের এপিসোডে এক হিন্দি ফিল্মের গানের সঙ্গে নাচের পরই সেটে চেয়ে নিয়েছে ব্যাট। নিজের হাতে তাকে ব্যাটের স্ট্যান্স শিখিয়েছে। গ্রিনরুমে ফিরে বলেছে ‘‘ওইটুকু একটা ছেলে হিন্দি গানের সঙ্গে শুধু নেচে চলে যাবে সেটা ঠিক হত না। এই প্রোগ্রামটা লোকে অন্য রকম চোখে দেখে। তাই ওকে স্ট্যান্সটাও শিখিয়ে দিলাম।’’ কিংবা শিলিগুড়ির এক কলেজপড়ুয়ার আত্মবিশ্বাসের প্রবল অভাব দেখে তার সামনে দাঁড়িয়ে বলেছে, ‘‘ডিপ ব্রিদ কর। এবার বল আমিই সেরা। আমি হারব না। এ রকম রোজ বলবি। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বলবি।’’ ছেলেটাকে দিয়ে বলিয়েছে। একেবারে বড় দাদার মতো। আত্মবিশ্বাস অর্জনে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের টোটকা কী, শিখিয়ে দিয়েছে সবাইকে।
একই সঙ্গে চূড়ান্ত রসিকতাবোধ আর প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব। এক প্রতিযোগী প্রশ্ন করলেন, ‘‘দাদা লর্ডসে জামা ঘোরাতে ঘোরাতে কী বলছিলেন?’’ কী বলছিলেন সেদিন ফ্লিনটফদের তা সবার বিলক্ষণ জানা। সৌরভের তৎক্ষণাৎ জবাব, ‘‘সে কী বুঝতে পারেননি! বলছিলাম, কী সুন্দর মাঠ। কী সুন্দর ড্রেসিংরুম!’’ এক মহিলা প্রতিযোগী হঠাৎ মুগ্ধ হয়ে বলে উঠল, ‘‘দাদা আপনাকে কী সুন্দর দেখতে। টিভিতে যা দেখি তার চেয়ে ভাল দেখতে!’’ কয়েক সেকেন্ডের জন্য বিব্রত হয়েই পালটা উত্তর, ‘‘আবার বলো, একটু জোরে বলো।’’ এক প্রতিযোগী তাঁর বাড়ি থেকে পালিয়ে বিয়ের গল্প শোনাচ্ছিল দাদাকে। কী করে একটা একটা করে চুড়িদার সরিয়ে শেষে বাড়ি থেকে পালিয়ে আসা! শুনে সৌরভের সব মাকে পরামর্শ, ‘‘এ বার থেকে মেয়েদের চুড়িদার গুনে রাখবেন।’’ বাঁকুড়ার একটি মেয়ে তাঁর প্রেমের গল্প শোনাচ্ছিল। নদীর ধারে প্রেমপর্বের সময় হঠাৎ মেয়ের বাবা উপস্থিত। প্রেমিক নদীতে ঝাঁপ দিয়েছিল কোথাও লুকোতে না পেরে। দাদার প্রশ্ন, ‘‘নদীর ধারে তোমার বাবা ঠিক কী করছিলেন?’’ গোটা স্টুডিওতে হাসির রোল। |
|
দাদাগিরির ড্রেসিংরুমে প্রিয় খাবার চিকেন তন্দুরি |
আড্ডাবাজ এই সৌরভকেই দরকার ছিল আমাদের। খেলার মাঠের বাইরের লোকটা একেবারে অন্য লোক। দেখা হলে বা ফোনের অন্য প্রান্ত থেকে যার কুশল বিনিময়টা ‘কীইই, কেমন আছো’র মতো শোনায়। এর সঙ্গে যোগ করুন ওর চরিত্রের সহজাত গুণগুলো। শ্রদ্ধা, বিনয়, সবটা। শিক্ষক দিবসের অনুষ্ঠান। ছোটবেলার স্কুলের শিক্ষকরা এসেছিলেন। এখনও শিক্ষকদের প্রতি সৌরভের শ্রদ্ধা, দায়বদ্ধতার গল্প শুনিয়ে যাচ্ছিলেন। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় এসেছেন। ঝুঁকে পড়ে প্রণাম, কুর্নিশ সৌরভের। প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়কে সশ্রদ্ধ ভঙ্গিতে প্রশ্ন, ‘‘এত দিন কাজ করার রহস্যটা কোন পেশাদারি মন্ত্রে?’’ উত্তম কুমার পর্বে সুপ্রিয়া দেবী এসেছিলেন। স্টেজের নীচ থেকে হাত ধরে উপরে নিয়ে যায় সৌরভ। চিন্ময় রায়ের ভিডিও ক্লিপ দেখে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ে। অকপটে বলে, ‘‘আমি রবি ঘোষের ফ্যান। টিউশন কেটে কত বার রবি ঘোষের নাটক দেখতে গিয়েছি।’’
এ সব নিয়েই দাদাগিরি। অনেক স্মৃতি অনেক ভালবাসা। এসব গল্পই প্রথমবারের। দ্বিতীয়বারেও নিশ্চয়ই আরও ভাল কিছু মুহূর্ত ছিল, আমার থাকা হয়নি। তবে যাই হোক। জনপ্রিয়তার শৃঙ্গে ‘দাদাগিরি’ প্রতিটা দিন টপকে গিয়েছে একটা করে শৃঙ্গ।
মুর্শিদাবাদের এক শিক্ষকের কথা শুনেছিলাম, যিনি ছাত্রদের শেখাবেন বলে ‘দাদাগিরি’র প্রশ্ন টুকে রাখতেন। শারীরিক প্রতিবন্ধী একটি ছেলেকে স্কুলে ভর্তি নিচ্ছিল না। ‘দাদাগিরি’ দেখে সিদ্ধান্ত বদল করেন শিক্ষকরা। আর মানুষের প্রতিক্রিয়া? চিত্রপরিচালক রাজা দাশগুপ্ত এক বার বলেছিলেন, ‘‘ভারতীয় টিভির সেরা অনুষ্ঠান।’’ সৌরভ? মাঝে মাঝে মজা করেছে। ‘‘লোকে তো আমার ১০০ টেস্ট, ৩০০ ওয়ান ডে ভুলে গেল দেখছি। শুধু দাদাগিরি দাদাগিরি করছে।’’
নিছকই রসিকতা। সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের জীবনের ওই পর্বটা কেউই ভুলবে না। তেমনই কেউ ভুলতে পারবে না ‘দাদাগিরি’ও। একটা অনুষ্ঠানের জন্য সারা বছর অপেক্ষা। একটা অনুষ্ঠান টিভি শো ছাপিয়েও বাড়তি কিছু। অনুপ্রাণিত হওয়ার সহজ পাঠ, বিনয়ী হওয়ার শিক্ষা, নিজেকে ছাপিয়ে যাওয়ার ক্লাস।
আর এ বার ‘দাদাগিরি থ্রি’। ‘দাদাগিরি’র কামব্যাক। ক্যুইজ, রিসার্চ, প্রতিযোগীদের নিয়ে নিশ্চয়ই কর্মযজ্ঞের অপেক্ষায় টিম জি-বাংলা। সুজয় আর তাঁর টিমকে প্রথম ও প্রাক্তন প্রযোজকের শুভেচ্ছা। ‘দাদাগিরি’ জিন্দাবাদ। |
|
|
|
|
|