এক সপ্তাহের মধ্যে দাম পড়েছে হু-হু করে। মার্চের শুরুতে যেখানে ৫০ কেজির বস্তা পিছু ২৮০ টাকা দর যাচ্ছিল, তা নেমে এসেছে ২১০-২১৫ টাকায়। ফলে, গত বছরের পরে এ বারও ফের সঙ্কট ঘনাচ্ছে রাজ্যের আলুচাষ ও বিপণনে।
গত ১ মার্চ থেকে হিমঘরগুলি আলু রাখতে শুরু করেছে। বেশির ভাগ চাষিই অবশ্য সরাসরি হিমঘরে নয়, ব্যবসায়ীকে আলু বিক্রি করেন। এখন যা দল যাচ্ছে, চাষিরা বড় জোর ১৭০-১৮০ টাকা পাচ্ছেন। হিমঘর ও পাইকারদের বড় অংশ আলু কেনায় আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। মাঠে এখনও যে বিপুল পরিমাণ আলু রয়েছে, তাতে এই ধারা অব্যাহত থাকলে পরিস্থিতি ভয়াবহ হওয়ার সম্ভাবনা।
সোমবার মহাকরণে রাজ্যের কৃষিমন্ত্রী এবং কৃষি বিপণন মন্ত্রীর কাছ থেকে আলুর দামের বিষয়ে খোঁজখবর নেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আপাতত চাষিদের থেকে বেশি দামে ১ লক্ষ মেট্রিক টন আলু কেনার নির্দেশ দিয়েছেন মমতা। কৃষি দফতর সূত্রের খবর, অর্থ দফতর যাতে দ্রুত টাকা অনুমোদন করে, তার জন্য অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্রকেও তিনি নির্দেশ দেন। |
কৃষিমন্ত্রী মলয় ঘটক অবশ্য দাবি করেন, “সুকৌশলে রটানোর চেষ্টা হচ্ছে যে আলুর দাম ব্যাপক কমছে। ৭৫ শতাংশ আলু এখনও খেত থেকে ওঠেনি। তবুও এক শ্রেণির ফড়ে, যারা এত দিন বাজার নিয়ন্ত্রণ করত, তারাই এ সব রটাচ্ছে। তাদের উদ্দেশ্য হল, চাষিদের ভয় পাইয়ে দিয়ে অভাবী বিক্রিতে বাধ্য করা।” কৃষি বিপণন মন্ত্রী অরূপ রায় বলেন, “চাষিদের সমস্যা নিয়ে আলোচনা চলছে।” সন্ধ্যায় হুগলির সিঙ্গুরে আলুর মোড়ে নিজের আড়তে বসে কার্যত মাছি তাড়াচ্ছিলেন আড়তদার সুকুমার সামন্ত। স্থানীয় রতনপুর মোড় ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সভাপতি সুকুমারবাবুর আক্ষেপ, “বস্তা প্রতি আলু ১৮০ টাকা দরে বিক্রি করছেন চাষিরা। অথচ সপ্তাহখানেক আগেই তার দর ছিল ৩০০-৩৩০ টাকা।” জাঙ্গিপাড়ার রাজীব শাসমলের হিসেবে, “বিঘেতে ৪-৫ হাজার টাকা লোকসান হচ্ছে।” বর্ধমানের বহরপুরের চাষি ধর্মদাস ঘোষ বলেন, “মাঠে কোনও খদ্দের নেই। আগামী দিনে দর উঠবে, এই আশায় বস্তা অনেকে হিমঘরে আলু নিয়ে যাচ্ছেন। জানি না, কী হবে।”
হিমঘর মালিক ও ব্যবসায়ীরা আলুর দর পড়ে যাওয়ার পিছনে বেশি ফলন ছাড়াও আরও অন্তত দু’টি কারণ দেখাচ্ছেন এক, গত মরসুমে আলু বিক্রির ব্যাপারে সরকারের কড়াকড়ি। দুই, এ বার যথেষ্ট ব্যাঙ্কঋণ না পাওয়া। বর্ধমান সদর আলু ব্যবসায়ী সমিতির সহ-সভাপতি বলাই মণ্ডল বলেন, “আলু রাজ্যের বাইরে পাঠানো যাবে না, নির্দিষ্ট দরের বেশিতে বিক্রি করা যাবে না এ রকম সব বিধিনিষেধ জারি করেছিল সরকার। ফলে অনেক ব্যবসায়ীই এ বার আলু কিনতে ভয় পাচ্ছেন।” প্রগতিশীল আলু ব্যবসায়ী সমিতির পক্ষে গোলাম মোস্তাফা আবার বলেন, “হিমঘরগুলি ঋণ দিতে চাইছে না। আলু কিনে টাকা দেব কোথা থেকে?” রাজ্য হিমঘর মালিক সমিতির পরামর্শদাতা পতিতপাবন দে বলেন, “ক্ষতির কারণে গত বার বহু হিমঘর ব্যাঙ্কঋণ নিয়ে শুধতে পারেনি। এ বার তারা ঋণ পায়নি। ফলে টাকা দিতে পারছে না।”
রাজ্যের বাইরেও অসম, অন্ধ্র, বিহার, ঝাড়খণ্ডে আলুর বাজার আছে। কিন্তু এ বার উত্তরপ্রদেশ, হিমাচল, পঞ্জাবেও বেশ ভাল ফলন হয়েছে। ফলে তারাও ভিন্ রাজ্যের বাজারের দখল নেবে। তাতে বিপদ আরও ঘনীভূত হবে।
হুগলির দাদপুরের ১৫ বিঘায় আলু চাষ করেছিলেন আসিকুল ইসলাম। তাঁর কথায়, “আলু বিক্রির সময়ে দাম বেড়ে গেলে সরকার হস্তক্ষেপ করে। কিন্তু দাম যখন পড়ে যাচ্ছে, সরকার ব্যবস্থা নিচ্ছে না কেন?” পুড়শুড়া কেলেপাড়ার চাষি গোলাম রাউত বলেন, “ঋণ শোধ করব কী করে আর সংসারই বা চালাব কীসে? সরকার ব্যবস্থা না নিলে হয়তো অনেককেই শেষে আত্মহত্যা করতে হবে।”
রাজ্য সরকার এই সঙ্কট কী ভাবে সামাল দেয়, সেটাই এখন দেখার। |