চোলাই মদের রমরমা যতই বাড়ুক, রাজ্যকে অন্ধ্রপ্রদেশ হতে দেবেন না অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র। তাই কোনও ঝুঁকির মধ্যে না গিয়ে পুরনো মদ, অতি পুরনো বোতলে ভরে ফের বাজেট প্রস্তাবে পেশ করলেন তিনি।
ফি বছর মদের উপরে দাম বৃদ্ধি এ রাজ্যে স্বাভাবিক ঘটনা। বাম আমলে তা-ই হয়েছে। গত বারেও সেই পথেই হেঁটেছিলেন অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র। আগামী বছরের বাজেট প্রস্তাবেও আবগারি খাতের আয় ২৫৭১ কোটি টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩২০২ কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে।
এখানেই উঠে আসে অন্ধ্রপ্রদেশের কথা। কারণ, জনসংখ্যা, আয়তন ইত্যাদি অনেক কিছুর নিরিখেই ওই রাজ্যটি আমাদের সঙ্গে তুলনীয়। অন্ধ্রপ্রদেশ আবগারি খাতে গত আর্থিক বছরে প্রায় ১২,০০০ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় করছে। চলতি বছরে তা বেড়ে ১৪,০০০ কোটি টাকার মতো দাঁড়াবে বলে অনুমান। অর্থাৎ, পশ্চিমবঙ্গের থেকে ১০ হাজার কোটি টাকারও বেশি রাজস্ব অন্ধ্রপ্রদেশ আদায় করে চলেছে মদ বিক্রি থেকে! ওই টাকা নানা উন্নয়ন প্রকল্পে ব্যয় করে অন্ধ্র সরকার।
উল্টো দিকে আর্থিক সঙ্কট নিয়ে নানা স্তরে নালিশ করলেও রাজ্যের মদ-নীতি আমূল বদলে টাকা তোলার ব্যাপারে সরকারের বড়ই অনীহা।
আগের সরকারের মতোই। কেন?
খুব সরল ভাষায় বলতে গেলে সরকার চায়, রাজ্যের গরিব লোক যেন বেশি মদ না খান। তাই মদের প্রসার রোধে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সরকার। আর সে জন্যই এ রাজ্যে দেশি মদের বিক্রয়কেন্দ্রের সংখ্যা ১২০০-র কাছাকাছিতেই এসে আটকে রয়েছে। হিসেব মতো, এ রাজ্যের
প্রতি লক্ষ মানুষের জন্য মদের দোকানের সংখ্যা মোটামুটি ৫টি। কিন্তু অন্য রাজ্যে? অন্ধ্রপ্রদেশে প্রতি লক্ষ মানুষের জন্য মদের দোকান সাড়ে ১০, কর্নাটকে ১৫, তামিলনাড়ুতে প্রায় ১১। এই হিসেব থেকে স্পষ্ট, পশ্চিমবঙ্গ সরকার মনে করে, কম দোকান থাকলেই মানুষের মদ খাওয়া আটকানো যাবে।
কিন্তু বাস্তবটা কী? কাছাকাছি বৈধ দেশি মদের দোকান না থাকায় গরিব মানুষ রেললাইনের পাশে, বাজারের ঝুপড়িতে গিয়ে বেআইনি চোলাই মদের পাউচ কিনে খান। নেশা বাড়ানোর জন্য তাতে থাকে বিষাক্ত নানা রাসায়নিক। ২০১১ সালে এমন বিষাক্ত মদ খেয়েই মগরাহাটে মৃতের সংখ্যা ১৭২-এ ঠেকেছিল। সেই ঘটনায় মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করেছিলেন, মৃতদের মাথাপিছু ২ লক্ষ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে। সরকার বলেছিল, ‘বন্ধ করে দেওয়া হবে বিষমদের কারবার। ওই কাজের সঙ্গে যুক্ত মানুষদের
বিকল্প রোজগারের ব্যবস্থাও করা হবে।’ কিন্তু সত্যিই কি বদল হল চোলাই মদের রমরমার?
এলাকার বাসিন্দারা জানাচ্ছেন, প্রথম দিকে প্রশাসনের তরফে একের পর এক চোলাই মদের ভাটি ভাঙা হয়েছে। কিন্তু ক’দিন যেতে না যেতেই ফের তৈরি হয়েছে ভাটি। ফের গরিব মানুষের কাছে পৌঁছে গিয়েছে পাউচে ভরা চোলাই। আবার চোলাইয়ের নেশায় বুঁদ হয়েছে গ্রামবাংলা। নীতির ফেরে পড়ে মগরাহাট কাণ্ডেও চোখ খোলেনি রাজ্য সরকারের।
চোলাইয়ের এই ক্রেতার সংখ্যা কত, তার কোনও হিসেব সরকারের কাছে নেই। তবে ‘দ্য ব্যুরো অফ অ্যাপ্লায়েড ইকনোমিক্স অ্যান্ড স্ট্যাটিসটিক্স (বিএইএস)’-এর একটি সমীক্ষা রিপোর্ট বলছে, চোলাই মদ যাঁরা খান, তাঁদের সংখ্যা বৈধ দেশি মদের ক্রেতার প্রায় দেড়গুণ! এঁদের প্রায় পুরোটাই সমাজের প্রত্যন্ত শ্রেণির মানুষ। সারা দিন রিকশা চালানো বা মালবাহকের হাড়ভাঙা খাটুনির পরে এঁরা পাঁচ-সাত কিলোমিটার দূরের সরকারি দেশি মদের দোকানে যাওয়ার চেয়ে হাতের কাছে ওই সব অবৈধ দোকানই বেশি পছন্দ করেন।
আর এই বেআইনি চোলাই থেকেই মগরাহাটের আতঙ্ক তাড়া করে বেড়ায়। পাশাপাশি বিপুল পরিমাণ রাজস্বও হারায় সরকার। সরকারি কর্তাদেরও বক্তব্য, বেআইনি চোলাইয়ের ব্যবসা নির্মূল করতে গেলে বৈধ দেশি মদের দোকানের সংখ্যা বাড়াতেই হবে। কিন্তু রাজ্য এমনটা করতে রাজি নয়।
তবে শুধু আইনি মদের দোকানের অভাবেই যে বেআইনি চোলাইয়ের রমরমা বাড়ছে, তা নয়। এর সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে দামের ফারাকটাও। যেমন, সরকারি দেশি মদের দাম বোতল পিছু ৫১ টাকা (৫০ ডিগ্রির ৬০০ মিলিলিটারের সরকারি দাম)। এর মধ্যে সরকারি করের পরিমাণ ২৮ টাকার মতো (এ বারের বাজেটে তা আরও কিছুটা বাড়ানো হয়েছে)। উল্টো দিকে, একই পরিমাণ বেআইনি চোলাই মদের দাম ২০ টাকার মতো (একটি ৩০০ মিলিলিটারের পাউচের দাম ১০ টাকা)। অর্থাৎ, শুধু দূরে যাওয়ার হ্যাপা নয়, বৈধ মদের ক্রেতাকে বাড়তি ৩১ টাকা খরচ করতে হয় নেশার জন্য। এই জন্যই একটা বড় অংশের কাছে বেআইনি চোলাই বেশি প্রিয়! সরকারি কর্তাদের একাংশের বক্তব্য, দামের এই হিসেবটাও মাথায়
রাখা দরকার। এই কারণেই দেশি, নিরাপদ মদের দোকানের সংখ্যা বাড়িয়ে তা সাধারণের নাগালের
মধ্যে আনলেই শুধু হবে না, করের পরিমাণ কমিয়ে তা গরিব মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যেও আনতে হবে। তা হলে দেশি মদের বিক্রি বাড়বে, বাড়বে রাজস্ব আয়ও। কমবে চোলাই মদের রমরমা। এ পরামর্শ সরকারকে দেওয়াও হয়েছে একাধিক বার।
কিন্তু সরকার শুনলে তো! ফি বছর বাজেটে আবগারি কর বাড়িয়ে রাজ্য সরকারই মানুষকে বিষমদের দিকে ঠেলে দিচ্ছেন বলে অভিযোগ সরকারি কর্তাদের অনেকের।
অর্থনীতিবিদদেরও একাংশের বক্তব্য এটাই। এক অর্থনীতিবিদের কথায়, “বেআইনি মদের এই রমরমা কারবার বন্ধ করে সাধারণ মানুষের প্রাণ বাঁচানোর জন্য দরকার অনেকটা সাহস আর অনেকটা ঝুঁকি নেওয়ার ক্ষমতা। জনমোহিনী রাজনীতির গণ্ডি ছেড়ে এই কাজে এগিয়ে আসতে হবে সরকারকেই। বাড়াতে হবে সরকারি দেশি মদের দোকান। যেখান থেকে ভাল মানের মদ কিনতে পারবেন গরিব মানুষও। তাতে সরকারের রাজস্ব আয়ও বাড়বে অনেকটা।” সোজা কথায়, রাজস্ব লাভ শিকেয় তো বটেই। দেশি মদের লাভের গুড় খেয়ে যাচ্ছে চোলাই মদের কারবারিরা। রাজ্যবাসীকে তৈরি থাকতে হচ্ছে আবার একটি মগরাহাট-কাণ্ডের জন্য! |