মনমোহন সিংহ ও পালনিয়প্পন চিদম্বরমকে ধন্যবাদ দেওয়া উচিত অমিত মিত্রের। তাঁর ‘ঐতিহাসিক’ ৩০ শতাংশ রাজস্ব আদায় বৃদ্ধির পিছনে মূল অবদান ওই দু’জনেরই।
কেন্দ্র পেট্রোল-ডিজেলের দাম বাড়ানোয় প্রতিবাদে পথে নেমেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু তেলের দাম বাড়ার ফলে রাজ্যের কোষাগারে যে বাড়তি কড়ি এসেছে, তা-ই বছর শেষে অনেকটা স্বস্তিতে রাখল রাজ্যের অর্থমন্ত্রীকে। সাধারণ মানুষকে রেহাই দিতে অনেক রাজ্যই তেলের উপর বিক্রয় কর কমিয়েছে। মমতার অর্থমন্ত্রী সে পথে না-হেঁটে ঘরে তুলছেন প্রায় ৭০০ কোটি টাকা।
তেল সংস্থাগুলির সূত্রে জানা গিয়েছে, ২০১১-’১২ আর্থিক বছরে তারা বিক্রয় কর বাবদ রাজ্য সরকারকে ৪৫০০ কোটি টাকা দিয়েছিল। এ বারে এখনও পর্যন্ত ইন্ডিয়ান অয়েল, ভারত পেট্রোলিয়াম ও হিন্দুস্তান পেট্রোলিয়াম মিলিত ভাবে আগাম কর হিসেবেই ৫০০০ কোটি টাকারও বেশি রাজ্য সরকারের কাছে জমা দিয়েছে। আগামী ২০ দিনে আরও বেশ কিছু টাকা তারা দেবে বলেই আশা। |
কেন্দ্র কয়লার দাম বাড়ানোর ফলেও প্রায় হাজার কোটি টাকা বাড়তি এসেছে অমিতবাবুর হাতে। ২০১১-’১২ সালে এ বাবদ রাজ্যের আয় ছিল ১৮৭২ কোটি টাকা। ২০১২-’১৩ আর্থিক বছরে এই খাতে আয় বৃদ্ধির কথা অমিতবাবু ভাবেননি। বরং ১৮০৫ কোটি টাকায় কমিয়ে এনেছিলেন লক্ষ্যমাত্রা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আয়ের পরিমাণ বেড়ে হয়েছে ২৮১৬ কোটি টাকা।
আয় বৃদ্ধিতে এই দু’টি যদি কেন্দ্রের অবদান হয়, তা হলে অমিতবাবুর নিজস্ব ইন্ধন পণ্য প্রবেশ কর। গত বাজেটে এই কর নতুন করে চালু করেছিলেন তিনি। কিন্তু খুব বেশি আশা করেননি। আদায় ধরেছিলেন মাত্র ৬ লক্ষ টাকা। কিন্তু বছর শেষে ঘরে আসতে চলেছে ১২৫০ কোটি।
কার্যত এই তিনটি খাত থেকে আয়ই বাঁচিয়ে দিল পশ্চিমবঙ্গের অর্থমন্ত্রীকে। বাজেট সম্পর্কে তাঁর প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে মমতা তাই যথার্থই বলেছেন, “অমিতদা বাজেট করেছেন বাস্তবের উপরে দাঁড়িয়েই।” এই হঠাৎ পাওয়া অতিরিক্ত রাজস্ব নিয়ে অমিতবাবু অবশ্য বাড়তি কোনও বাক্য খরচ করেননি। বরং প্রত্যাশিত ভাবে সবটাই তাঁর নিজের কৃতিত্ব হিসেবে দেখিয়েছেন। দাবি করেছেন, তাঁর জমানায় আর্থিক পরিস্থিতি আসলে রাজ্যের সুস্বাস্থ্যেরই লক্ষণ।
২০১১-’১২ সালে রাজ্যের রাজস্ব আদায় ছিল ২৪ হাজার ৯৩৮ কোটি টাকা। চলতি বছর তা বেড়ে হয়েছে ৩২ হাজার ৪০৫ কোটি টাকা। বৃদ্ধির পরিমাণ ৭৪৬৭ কোটি টাকা। বাজেট বক্তৃতায় অমিতবাবু বলেছেন, “রাজস্ব বৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরেছিলাম ২৫ শতাংশ হারে। তাকে ছাপিয়ে গিয়ে আমরা প্রায় ৩০ শতাংশ হারে পৌঁছতে পেরেছি।” তাঁর দাবি, ইতিহাসে এটা কোনও দিন সম্ভব হয়নি। কিন্তু ওই তিন খাত থেকে পাওয়া ৩৪০০ কোটি টাকা বাদ দিলে রাজস্ব আদায় বৃদ্ধির পরিমাণ দাঁড়াত ৪০৬৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ শতাংশের হিসেবে বৃদ্ধি হত ১৭-র কাছাকাছি। স্বাভাবিক বৃদ্ধির থেকে সামান্য কমই। ২০১০-’১১ সালে বামফ্রন্টের শেষ পূর্ণাঙ্গ বাজেটে অর্থমন্ত্রী অসীম দাশগুপ্তর রাজস্ব বৃদ্ধির হার ছিল ২৫.০৮ শতাংশ।
অতিরিক্ত আয় বাদ দিয়ে রাজস্ব আদায় আশাব্যঞ্জক না-বাড়াকে রাজ্যের আর্থিক অসুস্থতার ইঙ্গিত হিসেবেই মনে করছেন অনেক অর্থনীতিবিদ। তাঁদের মতে, আর্থিক কাঠামো যে সার্বিক ভাবে নড়বড়ে, এই ঘটনা তারই প্রমাণ।
২০১৩-’১৪ আর্থিক বছরে অমিতবাবু রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরেছেন ৩৯ হাজার ৭৮৩ কোটি ৬৩ লক্ষ। বৃদ্ধির হার ধরেছেন ২২ শতাংশের উপরে। কিন্তু স্রেফ বেতন ও অবসর ভাতা বাবদই তাঁকে দিতে হবে ৪৩ হাজার কোটি টাকারও বেশি। ২৬ হাজার কোটি টাকার পরিকল্পনা বাজেটের দায় ও ৮ কোটি টাকার ঘাটতি তাঁকে বহন করতে হবে কেন্দ্রের বদান্যতা এবং বাজারের ঋণের উপরেই ভরসা রেখে। চলতি বছরে বাজার থেকে অমিতবাবু তুলেছেন ২০ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। ২০১৩-’১৪ আর্থিক বছরে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২৫ হাজার ৮৩৮ কোটি টাকা। এ বারে ১ হাজার ১৭৮ কোটি টাকা কেন্দ্রীয় ঋণ নেবেন বলে ঠিক করেছেন তিনি। যদিও ২০১২-’১৩-র ইতিহাস বলছে, তিনি ৬৯৫ কোটি টাকা কেন্দ্রীয় ঋণ নেবেন বলে ঠিক করেও বছর শেষে বাস্তবে নিয়েছেন ১ হাজার ৫৮৬ কোটি টাকায়।
পড়ে পাওয়া আয় আর ঋণের উপরে দাঁড়িয়ে থাকা বাজেটে খরচের ব্যাপারে কিন্তু কার্পণ্য করেননি অমিতবাবু। সামনেই পঞ্চায়েত ভোট। তাই খয়রাতি বিলোতে দাতাকর্ণ হয়েছেন। ইমাম-মোয়াজ্জিন-আইনজীবী-গায়ক-অভিনেতাদের জন্য ভাতা ঘোষণা হয়েছিল আগেই। রাজ্যের বিলোনোর অর্থনীতিতে নয়া সংযোজন যুব উৎসাহ প্রকল্প। যাতে মাসে দেড় হাজার টাকা করে পাবেন রাজ্যের এক লক্ষ বেকার। বছরে খরচ ১৮০ কোটি টাকা। অর্থনীতিবিদদের বড় অংশের মতে, বাড়তি আয় অর্থমন্ত্রী যদি পরিকল্পনা খাতে খরচ করতেন তা হলে রাজ্যের স্থায়ী উন্নয়ন হত। কিন্তু তা না-করে রাজনীতির দায় পূরণ করেছেন তিনি। তাতে লাভের চেয়ে ক্ষতিই বেশি। সরকারি সূত্র বলছে, চলতি অর্থবর্ষে পরিকল্পনা খাতে ২৩ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ হলেও বাস্তবে খরচ হয়েছে মাত্র ৩৫ শতাংশ। অন্য দিকে, পরিকল্পনা বহির্ভুত খাতে খরচ বেড়েছে লাফিয়ে লাফিয়ে। অর্থনীতির নিরিখে যা মোটেই সুলক্ষণ নয়।
দান-খয়রাতির টাকা জোগাতে সাধারণ মানুষের ঘাড়ে বাড়তি বোঝা চাপাতেও কসুর করেননি অমিতবাবু। শুধু সোনা-রুপো ছাড়া কার্যত সর্ব ক্ষেত্রেই মূল্যযুক্ত কর (ভ্যাট) বাড়িয়েছেন তিনি। পশ্চিমবঙ্গে ভ্যাটের চলতি হার ১, ৪, ১৩.৫ এবং ২০ শতাংশ। অমিতবাবু তাঁর বাজেটে ১ শতাংশের ধাপটিকে ছাড় দিয়ে বাকি প্রতিটি ধাপে বৃদ্ধির প্রস্তাব করেছেন। আগামী আর্থিক বছরে ভ্যাটের হার দাঁড়াবে: ১, ৫, ১৪.৫ ও ২৫ শতাংশ। যদিও এই খাতে রাজস্ব বৃদ্ধির হার কত ধরেছেন, তার ব্যাখ্যা তিনি এ দিন দেননি। ভ্যাট বৃদ্ধির ফলে জিনিসপত্রের দাম যে ঊর্ধ্বমুখী হবে তা-ও মানতে চাননি অর্থমন্ত্রী। তাঁর দাবি, “যাঁরা এ সমস্ত বলছেন তাঁরা কিছু বোঝেন না। এই বাজেটে উৎপাদন বৃদ্ধির দিকে বিশেষ উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। ফলে বাজারে জোগান বাড়বে। আর জোগান বাড়লে দামও নিয়ন্ত্রণে থাকবে।” বাজেট ঘাটতি অবশ্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেননি অমিতবাবু। চলতি আর্থিক বছরের শেষে রাজকোষ ঘাটতির পরিমাণ গিয়ে দাঁড়াচ্ছে ২০ হাজার ৯১১ কোটি টাকায়। (যা রাজ্যের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের ৩.৪৮ শতাংশ) গত বছর অর্থমন্ত্রী রাজকোষ ঘাটতি ধরেছিলেন ১৫ হাজার ৯২৩ কোটি টাকা (২.৬৫ শতাংশ)। অর্থাৎ রাজকোষ ঘাটতির পরিমাণ বছর শেষে ৫০০০ কোটি টাকা বেড়ে গিয়েছে। এর পরেও অমিতবাবু উচ্চাভিলাষী। ২০১৩-’১৪ সালে রাজকোষ ঘাটতির পরিমাণ ১৩ হাজার ৪১৪ কোটি টাকায় অর্থাৎ ১.৮৯ শতাংশে বাঁধতে চেয়েছেন তিনি। তাঁর লক্ষ্য ২০১৪-’১৫ ও ২০১৫-’১৬য় ৩ শতাংশের বেঁধে রেখে ফিসক্যাল রেসপনসিবিলিটি অ্যান্ড বাজেট ম্যানেজমেন্ট (এফআরবিএম) আইন মোতাবেক আর্থিক শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা। |