‘বেঙ্গল বিল্ডস’ হয়েছে। ‘বেঙ্গল লিডস’ হয়েছে। শিল্পপতিদের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর বৈঠকও হয়েছে কলকাতা ও দিল্লিতে। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয়নি। ক্রমেই বিবর্ণ হয়েছে পশ্চিমবঙ্গের শিল্পচিত্র। সরকারি পরিসংখ্যানই বলছে, ২০১২ সালে এ রাজ্যে রূপায়িত হয়েছে মাত্র ১২টি শিল্প প্রকল্প! লগ্নির পরিমাণ স্রেফ ৩১২.২৪ কোটি টাকা!
গত এক দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন এই বার্ষিক বিনিয়োগ রাজ্যে শিল্পায়নের কঙ্কালসার চেহারাটাই স্পষ্ট করে দিল বলে কবুল করছেন শিল্প দফতরের কর্তারা। যদিও এই পরিসংখ্যানকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে রাজি নন শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়। তিনি অমিত মিত্রের বাজেট বক্তৃতায় উল্লিখিত অন্য একটি পরিসংখ্যানের উপরেই জোর দিচ্ছেন। যেখানে অর্থমন্ত্রী বলেছেন, “রাজ্য সরকার ২০১১-র মে মাস থেকে এ পর্যন্ত ২৫৭টি ইউনিটের জন্য ১,১২,৭৬৯.৩৬ কোটি টাকার লগ্নির প্রস্তাব পেয়েছে।” কিন্তু লগ্নির প্রস্তাব আসা আর তা বাস্তবায়িত হওয়ার মধ্যে যে আকাশপাতাল তফাত, তা ২০১২-১৩-র আর্থিক সমীক্ষাই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে বলে শিল্প ও বণিক মহলের মত। তাদের বক্তব্য, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের শিল্প নীতির প্রতি লগ্নিকারীদের আস্থার অভাব স্পষ্ট হচ্ছে এই পরিসংখ্যান থেকে। |
বাজেট অধিবেশনে হাল্কা মেজাজে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও
অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র। সোমবার বিধানসভায় রাজীব বসুর তোলা ছবি।
|
আর্থিক সমীক্ষা জানাচ্ছে, ২০১০ সালে, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের মুখ্যমন্ত্রিত্বের শেষ বছরে ৩২২টি প্রকল্প রূপায়িত হয়েছিল। লগ্নির পরিমাণ ছিল ১৫০৫২.২৩ কোটি টাকা। ২০১১ সালের শেষ আট মাস ক্ষমতায় ছিল তৃণমূল। প্রকল্প রূপায়ণের সংখ্যা কমার শুরু সেই থেকে। মাত্র ২৮টি প্রকল্পে লগ্নি এসেছিল ২৪৬৫.৪৬ কোটি টাকা।
আর গত বছর রাজ্যে ১২টি শিল্প এসেছে মাত্র ৬টি জেলায়। বাকি ১২টি জেলায় এক টাকাও বিনিয়োগ হয়নি। দেখা যাচ্ছে, ৩১২.২৪ কোটি টাকার মধ্যে বধর্মানে ৩টি প্রকল্পে ১৪২.৬৭ কোটি টাকা, দার্জিলিংয়ে ২টি প্রকল্পে ৫১.২৫ কোটি, বাঁকুড়ায় ১টি প্রকল্পে ১০.৮৫ কোটি, হাওড়ায় ৩টি প্রকল্পে ৪৫.৫১ কোটি, কলকাতায় ১টি প্রকল্পে ৪১.৭২ কোটি এবং দক্ষিণ ২৪ পরগনায় ২টি প্রকল্পে ২০.২৪ কোটি টাকা বিনিয়োগ হয়েছে।
এই হাল কেন?
বেশ কিছু ব্যাখ্যা মিলছে শিল্প ও বণিক মহল সূত্রে। তাদের মতে, ব্যর্থতার সবটুকু দায় তৃণমূল সরকারের উপরে চাপানো ঠিক হবে না। কারণ এই সময়ে গোটা বিশ্বেই আর্থিক মন্দা দেখা দিয়েছে। ফলে ঘোষিত প্রকল্পে, বিশেষত পরিকাঠামো ক্ষেত্রে বিনিয়োগ বন্ধ থেকেছে সর্বত্রই। পশ্চিমবঙ্গও তার ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু তার পরেও শিল্প টানার জন্য রাজ্য সরকারের যে উদ্যোগী ভূমিকা থাকা উচিত ছিল, তা দেখা যায়নি বলেই শিল্প মহলের মত। যার কেন্দ্রে রয়েছে জমি নিয়ে অনড় মনোভাব।
রাজ্যের এক শিল্পপতি এ দিন বলেন, “এমন তো নয় যে সব শিল্পের জন্যই এক লপ্তে বড় জমি দরকার বা তাদের জমি পাওয়ার সমস্যা রয়েছে। কিন্তু জমি সম্পর্কে সরকারের যা মনোভাব, তাতে লগ্নিকারীরা আস্থার অভাবে ভুগছেন।” তাঁর মতে, জমি নিয়ে সমস্যা দেশের অন্যত্রও রয়েছে। তা সে ওড়িশা হোক বা অন্ধ্রপ্রদেশ বা নয়ডা। কিন্তু এ রাজ্যে সরকারের অবস্থানই হল, তারা সেই সমস্যার সমাধান করবে না। এই অনড় মনোভাব শিল্পপতিদের মনে ভয় ধরিয়ে দিচ্ছে।
এই সূত্র ধরেই আর এক শিল্পপতি এ দিন বলেন, “এটা ঠিক যে, জমি নিয়ে তৃণমূলের একটা রাজনৈতিক অবস্থান আছে। রাতারাতি সেটা বদলে ফেলাও সম্ভব নয়। কিন্তু এক জন দক্ষ প্রশাসকের দায়িত্ব হল রাজনৈতিক অবস্থান বজায় রেখেই সমস্যা সমাধানের পথ খুঁজে বার করা। এ রাজ্যে সেই চেষ্টাটাই দেখা যাচ্ছে না।” সেই সঙ্গে রয়েছে শহরাঞ্চলে জমির ঊর্ধ্বসীমা আইন নিয়ে অযৌক্তিক অবস্থান।
শুধু জমি নিয়ে অনড় মনোভাবই নয়, অন্যান্য ক্ষেত্রে সরকারের অস্বচ্ছ অবস্থানও বিমুখ করেছে শিল্পপতিদের। তাঁদের বক্তব্য, কুড়ি মাস পার করেও শিল্পনীতি ঘোষণা করতে পারল না তৃণমূল সরকার। অন্যান্য রাজ্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে যেখানে উৎসাহ-ভাতা অত্যন্ত জরুরি, সেখানেও তারা কয়েক যোজন পিছিয়ে। শিল্প দফতর সূত্রের খবর, যে সমস্ত শিল্পপতি গত কয়েক বছরে রাজ্যে বিনিয়োগ করেছেন, তাঁদের প্রাপ্য উৎসাহ-ভাতার পরিমাণ ৬০০ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। কিন্তু আর্থিক সঙ্কটের কারণ দেখিয়ে মাসে মাত্র ২০ কোটি টাকা দিয়েছে অর্থ দফতর। ফলে স্বাভাবিক ভাবেই রাজ্যে প্রকল্প গড়ার ব্যাপারে উৎসাহ হারাচ্ছেন শিল্পপতিরা।
শিল্প স্থাপনের ক্ষেত্রে ছাড়পত্র দেওয়ার ব্যাপারে সরকার অনেক উদার হয়েছে বলে বারবার দাবি করেছেন অমিতবাবু। বলেছেন, আবেদনপত্রের পাতার সংখ্যা প্রায় দশ ভাগের এক ভাগ করে এবং এক জানালা নীতি চালু করে লাল ফিতের ফাঁস অনেকটাই আলগা করে দিয়েছেন তিনি। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে এর প্রতিফলন হয়নি বলেই অনেক শিল্পপতির দাবি। তাঁদের অভিজ্ঞতা বলছে, শিল্পের জন্য ছাড়পত্র পেতে মোটেই আগের থেকে কম সময় লাগছে না।
ছাড়পত্র যদি বা পাওয়া যায়, প্রকল্প গড়ে তোলার পথে কাঁটা আরও অনেক। সব চেয়ে বড় মাথাব্যথা শাসক দলের স্থানীয় ছোট-বড় নেতার দাদাগিরি। হলদিয়া থেকে এবিজি বিদায়, পানাগড়ে সার কারখানার কর্তাদের ঘেরাও বা ঘোজাডাঙায় সীমান্ত বাণিজ্য বন্ধ করে দেওয়ার ঘটনা শিল্পপতিদের একটা বড় অংশের মনে নিরাপত্তার অভাব তৈরি করে দিয়েছে। এক শিল্পকর্তার কথায়, “তৃণমূলের নিচুতলার কর্মীদের উপর শীর্ষ নেতৃত্বের নিয়ন্ত্রণের অভাব রয়েছে। সেটা একটা বড় চিন্তার কারণ। তা ছাড়া, একের পর এক যে ঘটনা ঘটছে, তাতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভেঙে পড়েছে না বললেও প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণের অভাব যে রয়েছে, সেটা বলাই যায়। সেটাও আমাদের স্বস্তি হারানোর অন্যতম কারণ।”
আর স্বস্তি নেই বলেই পশ্চিমবঙ্গকে এড়িয়ে চলতে শুরু করেছেন শিল্পপতিরা। যার জেরে মাত্র দু’বছরেই লগ্নির পরিমাণ ১৫ হাজার কোটি টাকা থেকে নেমে এসেছে ৩১২ কোটিতে।
|
শিল্পচিত্র |
বছর |
রূপায়িত প্রকল্প |
লগ্নি* |
২০০৮ |
২১৭ |
৪৪৩৪.৫০ |
২০০৯ |
২৬২ |
৮৪৯৩.৪৩ |
২০১০ |
৩২২ |
১৫০৫২.২৩ |
২০১১ |
২৮ |
২৪৬৫.৪৬ |
২০১২ |
১২ |
৩১২.২৪ |
*কোটি টাকায় • সূত্র: রাজ্যের আর্থিক সমীক্ষা ২০১২-’১৩ |
|