রক্তাক্ত যুবক তখনও রাস্তায় পড়ে কাতরাচ্ছেন। পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে সাইকেল, মোটর বাইক, গাড়ি। পথচারীরাও ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে দেখতে দ্রুত পেরিয়ে যাচ্ছেন এলাকা।
দৃশ্যটা সহ্য হয়নি সন্দীপ কুণ্ডুর। রবিবার সন্ধ্যা ৬টা নাগাদ গোঘাটের বেঙ্গাই আদিবাসী পাড়া-সংলগ্ন রাস্তা দিয়ে যেতে গিয়ে থমকে দাঁড়ান তিনি। চোখের সামনে পড়ে অজ্ঞাতপরিচয় রক্তাক্ত এক যুবক। দেহে তখনও প্রাণ আছে। ভাবতে দু’এক মুহূর্ত সময় নিয়েছিলেন বছর তিরিশের যুবক সন্দীপ। তারপরেই বুদ্ধি খোলে। প্রথম ফোনটাই করেন থানায়। পুলিশ জানায়, গাড়ি পাঠানো হচ্ছে। ঘটনাস্থল থেকে থানার দূরত্ব আন্দাজ করে সন্দীপ বুঝে যান, অন্তত আধ ঘণ্টার আগে পুলিশের আসা সম্ভব নয়।
তা হলে উপায়? এটুকু সময়ই হয় তো জখম যুবকের জীবন-মরণ নির্ধারণ করে দিতে পারে। সন্দীপ আর দেরি করেননি। হইচই করে আরও কিছু যুবককে জড়ো করে ফেলেন। কিন্তু হাসপাতাল পর্যন্ত পৌঁছবেন কেমন করে? গাড়ি চাই। একের পর এক গাড়ি বেরিয়ে যাচ্ছিল রাস্তা দিয়ে। শেষমেশ একটি গাড়ির চালক দাঁড়ান। জখম যুবককে নিয়ে সেই গাড়িতেই উঠে পড়েন সন্দীপ এবং স্থানীয় আরও কিছু ছেলে।
যদিও শেষ রক্ষা হয়নি। আরামবাগ মহকুমা হাসপাতালে রাতেই মারা যান দিবস পাঙ্গাল (২৯) নামে ওই যুবক। বাড়ি দক্ষিণ ২৪ পরগনার পাথরপ্রতিমার প্রজাপাড়া অচিন্ত্যনগরে। কাজ করতেন বেঙ্গাইয়ের একটি চালকলে। তাঁর দেহ ময়না-তদন্তে পাঠানো হয়েছে। পুলিশের অনুমান, কোনও গাড়ির ধাক্কায় জখম হয়েছিলেন তিনি।
কী ভাবে জানা গেল তাঁর পরিচয়?
সেই কৃতিত্বও পুরোটাই সন্দীপের। বেঙ্গাইয়ের গণেশবাটি গ্রামের বাসিন্দা সন্দীপ জানান, জখম যুবক কথা বলার মতো অবস্থায় ছিলেন না। গাড়িতে উঠে তাঁর মোবাইল ফোনটি বের করে সন্দীপ একের পর এক ফোন করা শুরু করেন। নিজের মোবাইল থেকেই। বেশ কয়েকটি ফোনের পরে একটি নম্বরে কথা হয় জখম যুবকের বাড়ির লোকের সঙ্গে। সন্দীপ জানান, তাঁরা প্রথমটায় দুর্ঘটনার কথা মানতেই চাননি। উল্টে সন্দীপকেই সন্দেহ করেন। ভোরের দিকে অবশ্য দিবসের এক আত্মীয় আসেন আরামবাগে। তত ক্ষণে মারা গিয়েছেন ওই যুবক। গভীর রাত পর্যন্ত হাসপাতালেই ছিলেন সন্দীপ। ভোরের দিকে ফের চলে আসেন। তাঁর আক্ষেপ, “আমার সঙ্গীসাথীরা অনেকে থানা-পুলিশের ভয়ে হাসপাতালে থাকতে আমাকে বারণই করেছিল। তারা নিজেরাও চলে যায়। কিন্তু আমার মন মানেনি।”
দিবসের পকেট থেকে পাওয়া ৮০০ টাকা, মোবাইল ফোন এবং একটি ব্যাগ সন্দীপ তুলে দিয়েছেন ওই যুবকের আত্মীয়ের হাতে। সন্দীপ কাজকর্ম কিছু করেন না। কিন্তু পরোপকারে উত্সাহ প্রবল।
তাঁর প্রতিবেশী তুহিন দে জানান, গ্রামে কোনও গণ্ডগোল হলেই থামাতে ছুটে যান সন্দীপ। এই করতে গিয়ে নিজের বিপদও ডেকে এনেছেন। কিন্তু কারও বিপদ দেখলে চুপ থাকেন না। দিবসের জন্য কিছু টাকাও খরচ করে ফেলেছেন সন্দীপ। যদিও সে সব কথা বলতে প্রবল আপত্তি বেকার যুবকটির।
সন্দীপের কথায়, “রবিবার সন্ধের দিকে জখম ওই যুবককে রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখে ভাবলাম, এমনটা তো আমারও হতে পারত। তখন যদি লোকে পাশ কাটিয়ে চলে যেত, তা হলে কী হত। সকলেরই এ ভাবে ভাবা উচিত। বিপদ কারও সঙ্গে যখন খুশি ঘটতে পারে। কিন্তু রাস্তার লোকজন যদি একটু দায়িত্ব না নেন, তা হলে কী ভাবে চলবে?”
সন্দীপের ভূমিকার প্রশংসা করেছেন আরামবাগের মহকুমাশাসক অরিন্দম রায়। তাঁর কথায়, “শেষ পর্যন্ত জখম যুবককে হয় তো বাঁচানো যায়নি। তা বলে তাঁকে সাহায্য করতে যিনি এগিয়ে গেলেন, তাঁর ভূমিকা কোনও অংশে ছোট হয়ে যায় না। এমন ঘটনা সচরাচর দেখা যায় না।”
|