মহানগরী? কল্লোলিনী তিলোত্তমা? লন্ডন?
কলকাতা আসলে
একটি গ্রাম।
কথার কথা নয়, পরিসংখ্যান আছে। লিখছেন তোয়া বাগচী |
পশ্চিমবঙ্গে গ্রাম ও শহরের দূরত্ব অনেক কমে গেছে। উদাহরণ? শিশুমৃত্যুর হারে শহর ও গ্রামের পার্থক্য অতি সামান্য (প্রতি হাজারে শহরে ২৫, গ্রামে ৩২), যেখানে জাতীয় হারে বিরাট ফারাক (প্রতি হাজারে শহরে ৩১, গ্রামে ৫১)। মহাভারতে নারদ যুধিষ্ঠিরকে উপদেশ দিয়েছিলেন, গ্রামগুলোতেও নগরের মতো সুযোগ-সুবিধা প্রসারিত করতে, যাতে শহর-গ্রামের বিভেদটা কম হয়। পশ্চিমবঙ্গে যে শহর-গ্রামের মধ্যে এ রকম সমতা দেখা যাচ্ছে, সেটা কি তার অগ্রগতির ফল বলব না?
রবীন্দ্রনাথ ১৯১৭ সনে তখনকার রাজধানী শহরের একটা বর্ণনা লিখেছেন: একটু বাদলা হাওয়া দিয়াছে কি, অমনি আমাদের গলি ছাপাইয়া সদর রাস্তা পর্যন্ত বন্যা বহিয়া যায়, পথিকের জুতো জোড়াটা ছাতার মতই শিরোধার্য হইয়া ওঠে। এবং অন্তত এই গলিচর জীবেরা উভচর জীবের চেয়ে জীবনযাত্রায় যোগ্যতর নয়, শিশুকাল হইতে আমাদের বারান্দা হইতে এইটে বছর বছর লক্ষ্য করিতে করিতে আমার চুল পাকিয়া গেল। (কর্তার ইচ্ছায় কর্ম)।
একশো বছর পর অবস্থাটা কী দাঁড়াল? বর্ষায় রাস্তাঘাটে ‘জুতো জোড়াটা ছাতার মতো শিরোধার্য’ অবস্থার সঙ্গে সঙ্গে জুটেছে বহু নতুন উৎপাত: ট্যাক্সিওয়ালার ‘নহী জায়েঙ্গে’, পুলিশের ‘কী আর করা যায় বলুন’-এর সঙ্গে যোগ হয়েছে মেয়েদের পিছনে লাগা থেকে শুরু করে ধর্ষণ পর্যন্ত নানান ‘খুনসুটি’। ফেব্রুয়ারি শেষ হতে না হতে বৈদ্যুতিক খরা! |
কলকাতা ’১২। ছবি: ভুবনেশ্বরানন্দ হালদার |
এগুলো আমাদের ‘অনুভূত অভিজ্ঞতা’। ব্যক্তিগত, সুতরাং সীমিত। এ থেকে সাধারণ সিদ্ধান্তে পৌঁছনো যায় না। কিন্তু, নিষ্প্রাণ, কঠিন সংখ্যা তো ব্যক্তির অন্তর্মুখীনতার দ্বারা পক্ষপাতদুষ্ট নয়। কয়েকটা সংখ্যা দেখা যাক। ২০১১ জনগণনায় কলকাতার ৩৬,৬৩৯টি বাড়িতে বিদ্যুৎ সংযোগ নেই। অগ্রগতি হয়নি তা নয়, দশ বছর আগে সংখ্যাটা ছিল ৪০,৫৪৭। অর্থাৎ, বিদ্যুৎবিহীন বাড়ির সংখ্যা হ্রাস হয়েছে ৭.৬ শতাংশ। এ ভাবে এগোলে আগামী শতখানেক বছরে শহরে কোনও বাড়িই বিদ্যুৎবিহীন থাকবে না! আজও এ শহরে ৯৬৪১৮টি বাড়িতে, মানে ১০টার মধ্যে একটা বাড়িতে শৌচালয় নেই! ৬৭৪৯টি বাড়িতে রান্নাই হয় না, কেননা খরচে পোষায় না। তাঁদের যা আয়, তাতে সস্তার হোটেলের খাবার রান্নার খরচের চেয়ে সস্তা হয়। শহর এলাকায় কর্মনিয়োজনের অবস্থা যতটা দেখা যায়, তার চেয়ে অনেক ভয়ংকর। পরিষেবা বিপ্লবের যুগেও, এ শহরে এখনও ১,৫৬,১৯৮টি বাড়ি (১৬ শতাংশ) ব্যাঙ্ক পরিষেবার আওতায় বাইরে। কলকাতায় অঢেল নরক। নালা নর্দমা বাজার তো আছেই। শপিং মল, মাল্টিপ্লেক্সে, বহুতল আবাসনগুলোর পেছন দিকেই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে অজস্র কলকাতা, যাদের জন্য, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তর ‘ছন্নছাড়া’ ভাষায়, ‘হাসপাতালে বেড নেই, মেলায় খেলায় টিকিট নেই, বাড়িতে ঘর নেই’, যারা ‘এক নেই রাজ্যের নৈরাজ্যের বাসিন্দা।’
এ কথা ঠিক যে, এ রাজ্যে শিশুমৃত্যুর হার অন্যান্য অনেক রাজ্যের তুলনায় কম। কিন্তু এটাও ঠিক যে, আরও অনেক কমানো যেত। শহরের পরিষেবাগুলোকে যদি ঊনবিংশ-বিংশ শতাব্দীতে ফেলে রাখা না হত। ইতিহাস যে এগিয়ে যাওয়ার পথনির্দেশ দেয়, তার কানাকড়িও যদি শাসকরা গ্রহণ করতেন, তা হলে হয়তো লজ্জাবশেও তাঁরা কলকাতাকে লন্ডন বানাবার আধা-ঔপনিবেশিক বাগ্বাজিতে না মেতে একটা প্রকৃত শহরের সংজ্ঞায় রূপান্তরিত করতে মন দিতেন যেখানে ধনী-গরিব ভাগটা দূর হয়ে যেত না ঠিকই, কিন্তু শহরের প্রতিটি নাগরিক মানুষের মতো বেঁচে থাকার সুযোগ-সুবিধাগুলি পেত। শৌচালয়, বিদ্যুৎ, ব্যাংক পরিষেবা, শিক্ষায় সুযোগ, স্বাস্থ্য পরিষেবা, দৈহিক নিরাপত্তা, স্বাধীন ভাবে ঘোরাফেরা করতে পারার নিশ্চয়তাগুলোকে সকলের জন্যই সুরক্ষিত করা হত। পশ্চিমবঙ্গ বাস্তবিকই এগিয়ে যেত। গ্রাম ও শহরের দূরত্ব ঘোচাতেও তার অবদান থাকত।
|
প্রতীচী ইনস্টিটিউটে কর্মরত। |