|
|
|
|
প্রবন্ধ ১... |
বঙ্গজ কমিউনিস্টদের উগো প্রদর্শন |
এদেশি কমিউনিস্টদের অন্তঃসারহীন ভণ্ডামো নতুন নয়। মার্কস, এঙ্গেলস, লেনিন, স্তালিন,
মাও, হো-চি-মিন, ফিদেল কাস্ত্রো, কত মূর্তির আমদানি হল। ইদানীং বিশ্ব জুড়ে কমিউনিস্ট ধর্মে
আকাল। আন্তর্জাতিক নায়ক পাওয়া যাচ্ছে না। অতএব পড়ে-পাওয়া উগো চাভেস। সোমনাথ মুখোপাধ্যায় |
ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট উগো রাফায়েল চাভেস ফ্রিয়াস দ্রুত হয়ে উঠেছিলেন দক্ষিণ আমেরিকার মহানায়ক। নিজেকে তিনি বলতেন সমাজতন্ত্রী। যে সমাজতন্ত্রকে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন পুরো মহাদেশে। যদিও তিনি মোটেই কমিউনিস্ট ছিলেন না, আমাদের বঙ্গীয় কমিউনিস্টগণ তাঁর মৃত্যুর পর শহরের রাজপথে নীরব শোকযাত্রা করে বোঝাতে চেয়েছেন যে, উগো তাঁদেরই দলে।
এদেশি কমিউনিস্টদের এই অন্তঃসারহীন ভণ্ডামো অবশ্য নতুন ব্যাপার নয়। জন্মলগ্ন থেকেই আন্তর্জাতিকতার দোহাই দিয়ে বিদেশি হরেক কিসিমের সমাজতন্ত্রীদের ছবি আর মূর্তি নিয়ে বা একটি-দুটি স্লোগান আউড়ে তাঁরা ভক্তি গদগদ চিত্তে পুজোর কাজ করে আসছেন। মার্কস, এঙ্গেলস, লেনিন, স্তালিন, মাও, হো-চি-মিন, ফিদেল কাস্ত্রো কত মূর্তির আমদানি হল, কত মন্ত্র-শোভাযাত্রা সমাবেশে রচিত হল কতই না সাম্প্রদায়িক পরম্পরা! ইদানীং অবশ্য বিশ্ব জুড়ে কমিউনিস্ট ধর্মে আকাল হওয়ায় আন্তর্জাতিক নায়ক পাওয়া যাচ্ছে না। তো কী? কমিউনিস্ট না হোক, চাভেস সোশালিস্ট তো বটে! ২০০৮-এ সশরীরে তাঁকে এনে কুমড়ো-মাথায় লাল জামা গায়ে ছবি ছেপে ওই ধারণাকে পোক্ত করা হল।
এখনকার কমিউনিস্টরা প্রশ্নহীন ভক্ত। ভারতীয় ঐতিহ্য মেনে গুরুর ছবি, পায়ের ধুলো বা জমাটবাঁধা গন্ধ নিয়ে হামলাহামলি করে। কারও ন’কাকা চল্লিশের দশকে মস্কো গিয়ে স্তালিনের ফোর্থ সেক্রেটারির রাঁধুনির সঙ্গে ছবি তুলেছিলেন, তো অন্য কেউ খোদ মাও-জে-দঙের সঙ্গে তাঁর রাঙাপিসিমা করমর্দন করেছিলেন বলে আপ্লুত। এক টুকরো আধপোড়া চুরুট দেখিয়ে কেউ বা বলেন, ‘কাস্ত্রোর পাঠানো পি ডি জি-র আধ-খাওয়া আসল হাভানা।’
নিজ অঞ্চল, রাজ্য, দেশের সমস্যা কী কী, তার সমাধানে বাইরের কোনও অভিজ্ঞতা বা কর্মকাণ্ড থেকে কী শেখার আছে, এ সব নিয়ে বঙ্গীয় লাল-দের মাথাব্যথা নেই। মাথা তো জন্মলগ্নেই বহিরাগত তত্ত্বসূত্র এবং গুরুদের কাছে বন্ধক দেওয়াই আছে, অত ভেবেটেবে অসুস্থ হওয়ার কী দরকার? প্রয়োজন মাফিক গুরুদের জন্মদিন পালন বা ফাটা রেকর্ড চালিয়ে দিলেই হল। এ হেন বাঙালি অ-সার ভদ্রলোক কমিউনিস্টদের উগো-দর্শন বা প্রদর্শনে বিচলিত না হয়ে দৃষ্টি ফেরানো যাক চাভেসের ভেনেজুয়েলার দিকে। |
|
হাঁটার প্রতিভা। উগো চাভেসের মৃত্যুসংবাদ পেয়ে মৌনী মিছিলে বামপন্থীরা।
কলকাতা, ৬ মার্চ, ২০১৩। ছবি: সুজয় ঘোষ |
চাভেস যখন ঠিকঠাক ক্ষমতায় বসেন, সোভিয়েত মডেলের সমাজতন্ত্র তত দিনে কার্যত মৃত। মার্কসবাদী একনায়কতন্ত্র দেশে-মহাদেশে পরিত্যক্ত, লাঞ্ছিত, নিগৃহীত। নিজের খ্রিস্টান পরিচয়ে গর্বিত চাভেস স্বপ্ন দেখলেন এমন সমাজের, যেখানে গরিব-অসহায়-অক্ষমদেরও মর্যাদা থাকবে, থাকবে সমাজ পরিচালনায় অংশীদারিত্ব। ‘ভ্যানগার্ড পার্টি’ গড়ে, যাবতীয় উৎপাদনের উপকরণকে রাষ্ট্রায়ত্ত করার সোভিয়েত মডেলের পথে তিনি কখনওই হাঁটেননি। ওই মডেলটিকে তিনি খোলাখুলি অগণতান্ত্রিক, দমনমূলক এবং না-অনুসরণীয় বলে ঘোষণা করেন। তাঁর ‘অ-গণতান্ত্রিকতা’ নিয়ে অনেক সমালোচনা, সবটা হয়তো সম্পূর্ণ অহেতুকও নয়। কিন্তু ঘটনা হল, বহুদলীয় গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক কাঠামোর নির্বাচনের মাধ্যমেই চাভেস দেশের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। সৈনিক এবং গ্রাম-শহরের গরিব কৃষক-আদিবাসী-অসংগঠিত শ্রমিক-বেকার-গৃহবধূ-ভবঘুরে-ভিখিরিদের এক অদ্ভুত মিশ্রণ তাঁর সমর্থনভূমি। কখনও একদলীয় ব্যবস্থার দিকে এগোননি। বার বার নির্বাচন হয়েছে তাঁর দেশে, হয়েছে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে একাধিক গণভোট একাধিক রাজ্যে ক্ষমতায় এসেছে বিরোধী দল চাভেস তা স্বীকার করেছেন।
তাঁর বলিভারিয়ান সমাজতন্ত্র বা একুশ শতকের সমাজতন্ত্রের স্বপ্ন পূর্ব-প্রকল্পিত কোনও মডেল অনুসরণ করেনি। সমাজতন্ত্রকে তিনি দেখেছেন একটি প্রক্রিয়া হিসেবে, যার গন্তব্য পূর্বনির্ধারিত নয়। তৈলক্ষেত্র ছাড়া আর প্রায় কোনও বড় শিল্পকে ন্যাশানালাইজ করা হয়নি। বন্ধ হওয়া কারখানার শ্রমিকদের সরকারি স্তরে ভর্তুকি এবং অন্যান্য সাহায্য করা হয়েছে কারখানা চালাতে। ধনতন্ত্রকে সম্পূর্ণ উচ্ছেদ করার কথা তিনি কখনও বলেননি। পুঁজিই সব, পুঁজির হাতেই উন্নয়নের চাবিকাঠি এই ধারণাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছেন তিনি। মানুষকেই তিনি করতে চেয়েছেন উন্নয়নের চালিকাশক্তি। কারখানা বন্ধ করে মালিক পালিয়েছে, কুছ পরোয়া নেহি, শ্রমিক তুমিই সমবায় গড়ে চালাও কারখানা। পুঁজি বা সরকারি অধিগ্রহণের আশায় বসে বসে আত্মহত্যা কোরো না। এ ভাবেই আসে আত্মবিশ্বাস, আত্মমর্যাদাবোধ একুশ শতকের সমাজতন্ত্র এটাই।
জমি ফেলে রেখেছে বড় জোতের মালিক। সরকার অধিগ্রহণ করেছে, কিন্তু চাষের দায়িত্ব কৃষক-সমবায়ের। সরকার সাহায্য করছে সমবায়গুলোর মধ্যে বিনিময়কে সক্রিয় করতে, দিচ্ছে প্রাথমিক পুঁজি ও কৃৎকৌশল, শিক্ষা। সরকারি কলকারখানায় আনা হল ‘কো-ম্যানেজমেন্ট’, অর্থাৎ প্রশিক্ষিত ম্যানেজার-ব্যুরোক্রাট-টেকনোক্রাটরা যেমন থাকবেন, তেমনই শ্রমিক প্রতিনিধিরাও যাবে বোর্ড অব ডিরেক্টরস-এ। এ ভাবেই একুশ শতকের সমাজতন্ত্র ভেনেজুয়েলার প্রান্তিক মানুষদের মধ্যে জাগিয়ে তুলছে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়, আত্মশক্তি। না, রাষ্ট্র সব কিছু চালাবে না, জনগণকে ঠুঁটো করে রেখে পার্টির নির্দেশ অনুযায়ী সমাজ চলবে না। সমাজ নিজেই নিজের ব্যবস্থা করবে, ভাগ করে নেওয়ার আদর্শে অনুপ্রাণিত, আত্মশক্তিতে গরীয়ান মানুষ রচনা করবে একুশ শতকের সমাজতন্ত্র।
বড় বড় রেস্টুরেন্টে সাজানো আছে অঢেল মহার্ঘ খাবার, ফুটপাথে চোখ গোল করে তাকিয়ে ক্ষুধার্ত শিশুর দল এ তো আমরা হামেশাই দেখি, বঙ্গীয় সাম্যবাদীরাও দেখে। কেউ কিছু বলে না, করে না। চাভেস বললেন, এটা অ-ন্যায়, অনৈতিক, চলতে পারে না। চালু হল ‘মিশন মেরকাল’, ওই রেস্টুরেন্টের পাশেই গরিব মানুষের শস্তায় খাবারের দোকান।
চাভেস আটকে থাকেননি দেশের সীমানায়। এমনকী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গরিবদের জন্যও শীতকালে পৌঁছে দিয়েছেন শস্তায় জ্বালানি। পৃথিবী জুড়ে এই বার্তা ছড়িয়ে দিতে পেরেছেন যে, সমাজতন্ত্র মানে ভাগ করে বাঁচা, সবাই মিলে বাঁচা, আত্মমর্যাদা নিয়ে কাজ করা, নিজ দায়িত্ব পালন করে স্বাবলম্বী হওয়া রাষ্ট্র তথা পার্টির পায়ে আত্মবলিদান নয়। কর্তৃত্বমূলক, অদক্ষ, স্বৈরতান্ত্রিক সোভিয়েত কাঠামোকে তিনি প্রথমেই বাতিল করেছেন।
আর তথ্য? পারফরম্যান্স? দু’একটা পরিসংখ্যান ধরা যাক তবে। দারিদ্র, ১৯৯৭ সালে ছিল ৬১ শতাংশ, ২০০৭-এ হয়েছে ৩৩ শতাংশ; বৈষম্য উল্লেখযোগ্য ভাবে কমেছে; নিরক্ষরতা দেশ থেকে নির্মূল হয়েছে (চৌত্রিশ বছর পশ্চিমবঙ্গ শাসন করেও বঙ্গজ কমিউনিস্টরা যা পারেননি); খাদ্য আমদানি, ১৯৮০ সালে ছিল ৯০ শতাংশ, ২০১১-তে হল ৩০ শতাংশ; দেশের ৯৬ শতাংশ মানুষ পরিস্রুত পানীয় জল পান; শিশুমৃত্যুর হার, ১৯৯০ সালে প্রতি হাজারে ২৫ থেকে ২০১০-এ হয়েছে ১৩; ১৯৯৮-এ প্রতি দশ হাজারে ডাক্তার ছিলেন ১৮ জন, এখন ৫৮। সমাজতন্ত্রকে যদি সরকারীকরণের সঙ্গে গুলিয়ে না ফেলা হয়, প্রান্তিক মানুষের আত্মমর্যাদাবোধ-আত্মশক্তিকে যদি জাগিয়ে তোলা যায়, সবাই মিলে ভাগ করে বাঁচার চিরকালীন আন্তর্জাতিক ধর্মকে যদি প্রায়োগিক স্তরে নিয়ে যাওয়া যায়, কী হতে পারে তার রূপ সমসময়ে জ্বলন্ত নিদর্শন হয়ে আছে ভেনেজুয়েলা।
এখানে শুধুই মিছিল হেঁটে যায়। ক্লান্ত, নীরব, নিষ্প্রাণ অভ্যাস-মলিন। ভাব নেই, ভাষা নেই, চেতনা নেই, স্বপ্নও নেই আর, আছে শুধু আচার আর সংস্কার। পুঁথি খুলে সমাজকে গ্রন্থ-মাপে আঁটিয়ে নিতে গিয়ে ‘আগে তত্ত্ব, পরে কাজ’-এর তত্ত্ববাজি করে, এই শহরের কফি হাউস-লাইব্রেরি ঘেঁটে, অমুক-তমুক দিবসের ফুলমালা ঠোঁটে, ব্যর্থ সোভিয়েত আর বেপথু চিনের শবদেহ খুঁটে, মজা-পচা-দূষিত গঙ্গা বেয়ে চলে এ শহরের কমিউনিস্ট সারাৎসার। |
|
|
|
|
|