কোরীয় উপদ্বীপ নূতন করিয়া উত্তেজনার কেন্দ্র হইয়া উঠিতেছে। গত মাসে উত্তর কোরিয়ার পরীক্ষামূলক পরমাণু বিস্ফোরণের প্রতিক্রিয়ায় রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদ ওই দেশের বিরুদ্ধে কড়া অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা জারি করায় উত্তর কোরিয়ার সরকারও পাল্টা হুমকি ও হুঁশিয়ারি দিয়াছে। দক্ষিণ কোরিয়ার সহিত সম্পাদিত যাবতীয় অনাক্রমণ চুক্তি একতরফা খারিজ করিয়া দিয়া উত্তর কোরিয়া দক্ষিণকে ‘পরমাণু অস্ত্রে উড়াইয়া দিবার’ হুমকি দিয়াছে। দক্ষিণের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্টও উত্তর কোরিয়াকে ‘ধরাধাম হইতে মুছিয়া দিবার’ অঙ্গীকার করিয়াছেন। দুই কোরিয়ার বিরোধ কোনও নূতন ঘটনা নয়। গণতান্ত্রিক ও পুঁজিবাদী দক্ষিণ কোরিয়াকে গ্রাস করার প্রচেষ্টা উত্তরের কমিউনিস্ট নেতারা দীর্ঘ কাল ধরিয়া করিতেছেন। কিন্তু কথা আর কাজে বিপুল ব্যবধানের কারণ হইয়া দাঁড়াইতেছে এক ও অদ্বিতীয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। উত্তরকে পরমাণু অস্ত্রপ্রযুক্তি আয়ত্ত করা হইতে নিরস্ত করিতে আমেরিকা-সহ অন্যান্য পরমাণু শক্তিধররা কম চেষ্টা করে নাই। রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদ আবারও কঠোরতর বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা জারি করিয়াছে।
উত্তর কোরিয়ার কমিউনিস্ট একনায়করা বংশপরম্পরায় ক্ষমতাসীন। কিম-ইল-সুঙ ও কিম-জঙ-ইলের পর বর্তমানে তৃতীয় প্রজন্ম কিম-জঙ-আন-এর জমানা চলিতেছে। দেশবাসী ও দেশের ক্ষমতাশালী সামরিক আমলাতন্ত্রের উপর নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা তাঁহার পক্ষে জরুরি। দক্ষিণ কোরিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধবাজ নীতি অবলম্বন করা এবং ইরানের প্রেসিডেন্ট আহমদিনেজাদের ভাষা ও ভঙ্গিতে প্রতিপক্ষকে বাক্যবাণে বিদ্ধ করা এ জন্যই তাঁহার প্রাত্যহিক দায়। পরমাণু অস্ত্র প্রযুক্তির গবেষণা ও চোরাচালান যে ভাবে বিশ্বময় ছড়াইয়াছে, তাহাতে পিয়ংইয়ংয়ের হুমকিকে হাল্কা ভাবে গ্রহণ করার কারণ নাই। আর সে জন্যই নিরাপত্তা পরিষদের নিষেধাজ্ঞা প্রস্তাবে উত্তর কোরিয়ার একমাত্র মিত্র গণপ্রজাতন্ত্রী চিনও এ বার ভোট দিয়াছে। চিন একই সঙ্গে কোরিয়াকে আলোচনার টেবিলে আসিতেও অনুরোধ জানাইয়াছে।
উত্তর কোরিয়া এক হতদরিদ্র দেশ। কিন্তু বঞ্চনা, দারিদ্র, অপুষ্টি, বেরোজগারির বিরুদ্ধে ক্ষোভপ্রকাশের অধিকার উত্তরের নাই, কমিউনিস্ট স্বৈরতন্ত্র সেখানে সামরিক বুটের তলায় গণদাবি ও জনবিক্ষোভকে দমাইয়া রাখিয়াছে। দক্ষিণের সচ্ছলতার বার্তা সীমান্তের লৌহ-যবনিকা ভেদ করিয়া উত্তরে তবু পৌঁছাইয়া যায়, সেখানকার স্বজাতীয়দের অস্থির করিয়া তোলে। তাই দক্ষিণের সহিত যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলা চালু রাখা, তাহাকে একটি অধঃপতিত, ক্ষয়িষ্ণু সমাজব্যবস্থা রূপে চিত্রিত করা বিশেষ জরুরি হইয়া দাঁড়ায়। কিম-জঙ-আন ঠিক তাহাই করিতেছেন। অর্থনীতির বিকাশ ঘটাইবার পরিবর্তে পরমাণু অস্ত্র তৈয়ারিকে অধিকতর অগ্রাধিকার দিতেছেন। দেশবাসীকেও মিথ্যা প্রচারে অনবরত বিভ্রান্ত করিয়া চলিয়াছেন। চিনই এখন ভরসা। চিনের সাহায্য ও অনুদান ছাড়া উত্তর কোরিয়া এত দিনে দুর্ভিক্ষে উজাড় হইয়া যাইত। মানবতার খাতিরে মিত্ররাষ্ট্রকে চিনারা এটুকু চাপ দিতেই পারেন। |