পশ্চিমবঙ্গ নামক রাজ্যটি পরিবর্তনোত্তর সময়ে যেমন ভাবে চলিতেছে,অমিত মিত্রের বাজেটটিও ঠিক সেই ভাবেই চলিল। দুই-চারটি তথ্য, ইতি-উতি গান-কবিতা, মা-মাটি-মানুষ, ঢালাও প্রতিশ্রুতি এবং সমস্তটাই বিশৃঙ্খল। হিসাবে দেখা গিয়াছে, পশ্চিমবঙ্গের আর্থিক বৃদ্ধির হার এই অর্থবর্ষের শেষে ৭.৬ শতাংশে দাঁড়াইবে। অর্থমন্ত্রী সর্বভারতীয় হারের সহিত তুলনা করিয়া জানাইয়াছেন, ‘আপনাদের প্রিয় পশ্চিমবঙ্গ’ অনেক অগ্রবর্তী। অমিতবাবু অর্থশাস্ত্রে প্রশিক্ষিত। রাজনীতি তাঁহার আদি পেশা নহে। তিনি কেন ভুলিলেন, কোনও একটি বৎসরের বৃদ্ধির হার তাহার পূর্বের বৎসরের সহিত তুলনামাত্র, তাহা দীর্ঘমেয়াদি প্রবণতার সূচক নহে। অষ্টম যোজনার সময় হইতেই পশ্চিমবঙ্গে অভ্যন্তরীণ উৎপাদন জাতীয় গড়ের কাছাকাছি হারে বাড়িতেছে। দ্বাদশ যোজনাতেও সম্ভবত তাহার ব্যতিক্রম হইবে না। কাজেই, এক বৎসরের বৃদ্ধির হারেই তাঁহারা ধরণীতলকে উতলা করিয়া তুলিতে চাহিলে মুশকিল। অমিতবাবু স্বজ্ঞানে এমন কাঁচা কাজ করিবেন বলিয়া মনে হয় না। আসলে মেঠো বক্তৃতায় অমন অনেক কথাই বলিতে হয়। বলুন, তবে বিশ্বাস করিয়া বসিবেন না যেন। রাজস্বের পরিমাণ বাড়িবার কৃতিত্বটিকেও তিনি হাসিমুখে হজম করিয়াছেন। কোথাও বলেন নাই, আসলে পেট্রোল-ডিজেলের বিপুল মূল্যবৃদ্ধির ফলে বিক্রয় করের পরিমাণও বাড়িয়াছে। অর্থনীতির কী পরিহাস, যে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে নেত্রী ইউপিএ ছাড়িলেন, সেই জ্বালানিই অমিতবাবুর বাজেটকে জ্বালানি দিতেছে! ভবিষ্যতেও দিবে, কারণ ডিজেলের দাম বাড়াইবার কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তটি হইয়াই আছে।
পশ্চিমবঙ্গের অর্থমন্ত্রী হওয়া বড় সুখের চাকুরি নহে। কিন্তু তিনি অজ্ঞাতসারে এই বিষ পান করিয়াছেন, অমিত মিত্র এমন দাবি করিতে পারেন না। তাঁহার হাতে দুইটি কাজ ছিল। দুইটিই কঠিন কাজ: রাজ্যের আয় বৃদ্ধি করা এবং ব্যয় কমানো। মনমোহন সিংহ জ্বালানির দাম বাড়াইবার সিদ্ধান্ত করিয়া অমিতবাবুর প্রথম কাজটি আংশিক সারিয়া রাখিয়াছিলেন। অর্থমন্ত্রী অকট্রয় নামক বাজারের কুশলতা-বিনাশী একটি করের আশীর্বাদে আরও খানিক দূর গিয়াছেন। তাহাতে টাকা আসিয়াছে, কিন্তু রাজ্যের ভাবমূর্তির ক্ষতি হইয়াছে। তেলের দাম এবং অকট্রয়ের দরুন রাজস্বের পরিমাণ যত বাড়িল, তাহা সরাইয়া রাখিলে অর্থমন্ত্রীর হাতে পেনসিলের অতিরিক্ত কত পড়িয়া থাকে? যেটুকু পড়িয়া আছে, তাহাও যে মূল্যস্ফীতির কারণেই মুখ্যমন্ত্রী না বুঝুন, অর্থমন্ত্রী তো জানেন। তাহাতে এত উল্লাসের কী আছে? অর্থমন্ত্রীর দ্বিতীয় দায়িত্বটি অর্থাৎ ব্যয় সংকোচ যে এই সরকারে থাকিয়া পালনীয় নহে, তাহা মহাকরণের অলিন্দগুলিও জানে। এক লক্ষ বেকারের জন্য মাসে মাথাপিছু ১৫০০ টাকা ভাতা বরাদ্দ হইয়াছে। ক্রীড়া ও যুবকল্যাণ খাতে বাজেট লাফাইয়া বাড়িয়াছে। তবে, বাম আমলকে অর্থমন্ত্রী একেবারে বর্জন করেন নাই। কেন্দ্রীয় বঞ্চনার কাঁদুনি এক বৎসরের ব্যবধানে ফিরিয়া আসিয়াছে। তবে, বিভিন্ন উন্নয়ন খাতে বরাদ্দ হইয়া আসা কেন্দ্রীয় টাকা যে রাজ্য সরকারের অবহেলায় ফিরিয়া গিয়াছে, তাহা অর্থমন্ত্রী উল্লেখ করেন নাই। তিনি বলিতেই পারেন, বাজেট সেই কথা বলিবার জায়গা নহে। সত্য। তবে এত অবান্তর কথা যখন বলিলেনই, এইটুকু বলিলেই বা ক্ষতি কী ছিল?
এই বাজেটটি সর্বার্থেই পশ্চিমবঙ্গের প্রতিবিম্ব ইহার কোনও দিশা নাই, যুক্তির পরম্পরা নাই। যেমন, অর্থমন্ত্রী দশ লক্ষাধিক কর্মসংস্থান হইয়াছে বলিয়া জানাইয়াছেন। কোথায় হইল? কাহারা চাকুরি পাইলেন? উত্তর নাই। মুখ্যমন্ত্রীও এমন কথা মাঝেমধ্যে বলিয়া থাকেন। তবে, বাজেট ভাষণে এমন ভিত্তিহীন সংখ্যার উল্লেখ করিলে বাকি সংখ্যাগুলিও বিশ্বাসযোগ্যতা হারায়। অবশ্য, বিশ্বাস করিবার বেশি কিছু নাই। ক্রীড়া ও যুবকল্যাণ খাতে যে অর্থ বরাদ্দ হইয়াছে, তাহা কীসে খরচ হইবে? পরিকাঠামো কোথায়? কোন এক লক্ষ বেকার মাসিক ভাতা পাইবেন? এই প্রশ্নগুলির একটিই উত্তর হয় ওই টাকা নয়ছয় হইবার জন্যই বরাদ্দ হইয়াছে। এই বাজেট আসলে নয়ছয়েরই বাজেট। পশ্চিমবঙ্গে যেমন যুক্তি অচল, এই বাজেটেও তাহা ব্রাত্য। রবি ঠাকুর হইতে গালিব, যথেষ্ট সংস্কৃতি, থুড়ি শিল্প, হইয়াছে আর কী চাই? |