নিয়ম মানা হচ্ছে কতটা, তা পরখ করতে গিয়েছিলেন তিনি। তাই নিজের সরকারি তকমা লুকিয়ে সেজেছিলেন আমজনতার এক জন। আর তাতেই মালুম পেলেন, অনিয়মের বহর কোথায় পৌঁছেছে।
টেলিকম দফতরের ওই পদস্থ কর্তাটি সাধারণ গ্রাহক হিসেবে কলকাতার এক দোকানে গিয়ে বলেছিলেন, তিনি মোবাইল ফোনের সিমকার্ড কিনতে চান, তবে কোনও কাগজপত্র নেই। উত্তর শুনে তিনি হা।ঁ দোকানদার তাঁকে আশ্বস্ত করে বললেন, কোনও সমস্যা হবে না। এমন তো হরবখতই হচ্ছে।
কী করে? পরিচয়-ঠিকানার যথাথর্র্ প্রমাণ ছাড়া তো সিম পাওয়ার কথা নয়? দোকানদার মুচকি হাসেন। ‘অজ্ঞ’ খদ্দেরকে একটা সিমকার্ড ধরিয়ে দিয়ে খামের উপরে লিখে দেন জনৈক সুনীল দাসের নাম, বাবার নাম, ঠিকানা। দাম বুঝে নেওয়ার পরে জানিয়ে দেন, “সার্ভিস প্রোভাইডারের ফোন এলে বলবেন, আপনার নাম সুনীল দাস। বাবার নাম বা ঠিকানা জানতে চাইলে এগুলো আউড়ে দেবেন। আপনার সিম অ্যাক্টিভেটেড হয়ে যাবে।”
কে ওই সুনীল দাস, যার পরিচয় বহন করতে হবে নতুন খদ্দেরকে? ঘটনা হল, ক’দিন আগে ওই দোকান থেকে মোবাইলের সিম কিনেছিলেন বর্ধমানের হাটগোবিন্দপুরের বাসিন্দা সুনীল দাস। নিয়ম মেনে, প্রয়োজনীয় কাগজ জমা দিয়ে। তিনি স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি, তাঁর সেই কাগজপত্রের সুবাদেই বেনামে একাধিক সিম বিকিয়ে যাবে অন্য লোকের কাছে। অপরাধ নিয়ন্ত্রণে মোবাইলের যথেচ্ছ ব্যবহার ঠেকাতে মাস চারেক আগে নিয়ম হয়েছে, এক জন বৈধ গ্রাহক ন’টার বেশি সিমকাডর্র্ কিনতে পারবেন না। অভিযোগ, এই নিয়মের অবাঞ্ছিত সুযোগ লুটছেন এক শ্রেণির ব্যবসায়ী। এক জন পরিচয়পত্রের প্রতিলিপি জমা দিয়ে বৈধ ভাবে একটি সিম কিনলে তাঁর সেই নাম-ঠিকানা ব্যবহার করে আরও আটটি সিম আট জন ভুতুড়ে গ্রাহককে বিক্রি করা হচ্ছে।
সুনীল দাসের ঘটনাটি এর জ্বলন্ত উদাহরণ। দেশ জুড়ে সন্ত্রাসবাদী হামলার সঙ্গে খুন-ডাকাতি-ধর্ষণ দিন দিন বাড়ছে। সে সবের তদন্তে পুলিশের অন্যতম হাতিয়ার এখন মোবাইল। মোবাইল ট্র্যাক করে গ্রাহকের হদিস পাওয়া সম্ভব। কিন্তু তার সিম বেনামে কেনা হয়ে থাকলে পুলিশও অসহায়। অনেক সময়ে অপরাধীর পিছু নিতে গিয়ে তদন্তকারীরা পৌঁছে যাচ্ছেন সুনীল দাসের মতো বৈধ গ্রাহকের বাড়িতে। পরে বোঝা যাচ্ছে, তাঁর নামে সিম কেনা অন্য কেউ অপরাধী।
আগে এক জন গ্রাহক যত খুশি সিমকার্ড কিনতে পারতেন। ব্যবহার করতে পারতেন যতগুলো ইচ্ছে ফোন নম্বর। মোবাইলের অপব্যবহার রুখতে গ্রাহকপিছু সিমের সর্বোচ্চ সংখ্যা বেঁধে দেওয়ার পাশাপাশি সিদ্ধান্ত হয়, সিম কেনার পরে পরিষেবা সংস্থা ফোন করে গ্রাহকের নাম, পিতৃপরিচয় ও ঠিকানা যাচাই করবে। সন্তুষ্ট হলে তবেই সিম কার্যকর করা হবে। এই নিয়মের ফাঁস এড়ানোর রাস্তা বেরোতে দেরি হয়নি। বেনামে কেনা আনকোরা সিম দোকানদারের মোবাইল সেটে ঢুকিয়ে ফোন ‘অন’ করা হচ্ছিল। পরিষেবা সংস্থার যাচাই-ফোন এলে দোকানদারের বলে দেওয়া নাম-ঠিকানা আউড়ে কানেকশন পাচ্ছিলেন অবৈধ খদ্দেররা। এ ভাবে কলকাতায় শুধু একটা মোবাইল সেট থেকেই এক মাসে ৮০৫টি নম্বর অ্যাক্টিভেট করা হয়েছে বলে টেলিকম-সূত্রের খবর! বলা বাহুল্য, ফোনটি দোকানদারের।
এই অনিয়ম নজরে আসার পরে টেলিকম-কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নেন, একটি নির্দিষ্ট মোবাইল সেট থেকে ন’টার বেশি নম্বর অ্যাক্টিভেট করা যাবে না। তারও যে ফাঁক বার হয়ে গিয়েছে, সুনীল দাসের ঘটনায় তারও প্রমাণ হাতে-নাতে পেয়ে গিয়েছেন টেলিকম-কর্তারা। কী ব্যবস্থা নিচ্ছেন তাঁরা?
স্থির হয়েছে, দোকানে-দোকানে আচমকা হানা আরও জোরদার করা হবে। মোবাইল পরিষেবায় নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা পালন করে যারা, কেন্দ্রের সেই টেলিকম এনফোর্সমেন্ট রিসোর্স অ্যান্ড মনিটরিং (টার্ম) সেল তদন্তে নেমেছে। তাদেরই এক কর্তা কলকাতার দোকানটিতে কাগজপত্র ছাড়া সিম কিনতে গিয়েছিলেন। টার্ম সেলের ডেপুটি ডিরেক্টর জেনারেল অতনু ঘোষ বলেন, “এ ভাবে আমরা প্রতিটা পরিষেবা সংস্থার সিমকার্ড বাজার থেকে জোগাড় করেছি। অবৈধ ভাবে বিক্রি করা সেই এক-একটা সিমের জন্য সংশ্লিষ্ট পরিষেবা সংস্থাকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হচ্ছে। তাদের বলা হয়েছে ওই সব দোকানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে।” যারা ব্যবস্থা নেবে না, তাদের বিরুদ্ধে পুলিশে অভিযোগ দায়ের হবে বলে হুঁশিয়ারিও দিয়েছে টার্ম সেল। অতনুবাবুর আশা, এই সব ব্যবস্থার মাধ্যমে ভুতুড়ে গ্রাহক ঠেকানো যাবে।
ভূতেরা ভবিষ্যতে কতটা শায়েস্তা হবে, আপাতত তারই প্রতীক্ষা। |