নারী নিগ্রহের ঘটনায় পশ্চিমবঙ্গ অনেক সময় দিল্লিকেও ছাড়িয়ে যাচ্ছে বলে মনে করছেন রাজ্য মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান, বিচারপতি অশোক গঙ্গোপাধ্যায়। কিন্তু নারী নির্যাতনের প্রতিবাদে দিল্লি যে ভাবে পথে নেমেছে, এ রাজ্যের নাগরিক সমাজ এখনও তা করেনি বলেই তাঁর মত।
আন্তর্জাতিক নারী দিবসের পরদিন, শনিবার কলকাতা হাইকোর্টের লিগ্যাল সার্ভিস আয়োজিত আলোচনাসভায় যোগ দিয়েছিলেন অশোকবাবু। সেখানেই তিনি বলেন, “নারী নিগ্রহের ঘটনায় এ রাজ্য অনেক সময় দিল্লিকেও ছাড়িয়ে যায়। দিল্লিতে নাগরিক সমাজ পথে নামেন। কিন্তু এ রাজ্যে সে ভাবে কাউকে পথে নামতে দেখি না।”
নন্দীগ্রামে পুলিশের গুলিচালনা কিংবা রিজওয়ানুরের মৃত্যুতে নাগরিক সমাজের মিছিল হয়েছে কলকাতায়। কিন্তু গত বছর পার্ক স্ট্রিট ধর্ষণ নিয়ে আলোড়ন হলেও কলকাতার নাগরিক সমাজ কিন্তু পথে নেমে তার প্রতিবাদ করেনি। তার কয়েক দিন পরে কাটোয়ার ট্রেনে এক দল দুষ্কৃতী মেয়ের মাথায় বন্দুক ধরে তার মাকে ধর্ষণ করে। বরাহনগরে কাগজকুড়ুনি মহিলাকে ধর্ষণ করে রাস্তায় ফেলে রেখে যায় দুষ্কৃতীরা। মহিলা মারা যান। এই সব ঘটনা সংবাদমাধ্যমে শিরোনাম হলেও নাগরিক সমাজের তরফে তেমন কোনও জোরালো প্রতিবাদ শোনা যায়নি। বারাসতে দিদির শ্লীলতাহানি রুখতে গিয়ে খুন হয়েছিল রাজীব দাস। তার পরেও বারাসতে পরপর নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটে চলেছে। কিন্তু নির্ভয়ার ধর্ষণ এবং খুনের ঘটনায় দিল্লির রাজপথ যে ভাবে প্রতিবাদে উদ্বেল হয়েছে, তার ধারেকাছে কলকাতার রাজপথ।
এ দিন নাগরিক সমাজের উদ্দেশে অশোকবাবু বলেন, “আপনারা নীরব কেন? জেগে উঠুন। প্রতিবাদ করুন।”
পার্ক স্ট্রিট ও কাটোয়ার ঘটনার পরে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়র প্রতিক্রিয়া ছিল, ‘সাজানো ঘটনা’। কিন্তু মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান যে নারী নির্যাতনের কোনও ঘটনাকেই লঘু করে দেখতে রাজি নন, তাঁর কথাতেই তা পরিষ্কার। এর আগে বিভিন্ন ঘটনায় রাজ্য মানবাধিকার কমিশনের ভূমিকা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। কমিশনও নারী নির্যাতন-সহ বিভিন্ন ঘটনায় স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে তদন্ত করেছে। কিছু ক্ষেত্রে রাজ্যকে কার্যত কাঠগড়ায় তুলেছে কমিশন। ফলে কিছু দিন ধরেই উভয় তরফে একটা শৈত্যের সম্পর্ক চলছে বলে মত অনেকের। এই পরিস্থিতিতে কমিশনের চেয়ারম্যানের এ দিনের মন্তব্য ফের রাজ্য সরকারের বিড়ম্বনা বাড়াবে বলে তাঁদের ধারণা।
রাজ্য মহিলা কমিশনের চেয়ারপার্সন সুনন্দা মুখোপাধ্যায় অবশ্য অশোকবাবুর সঙ্গে সহমত নন। তাঁর মতে, এ রাজ্যে আগেও মেয়েরা নিগৃহীতা হয়েছে, এখনও হচ্ছে। এটা প্রশাসন-নিরপেক্ষ একটা সমস্যা। কিন্তু তা কখনওই দিল্লি বা উত্তর এবং উত্তর-পশ্চিম ভারতের পরিসংখ্যানকে ছাড়িয়ে যায় না। সুনন্দাদেবীর ব্যাখ্যা, “এ রাজ্যে প্রকাশ্যে কেউ অন্য মানুষের সামনে কোনও মহিলাকে ধর্ষণ করতে পারবে না। কিন্তু উত্তর ভারতে অনেক জায়গায় এটা সম্ভব।” সুনন্দাদেবী মনে করেন, এ রাজ্যের নাগরিক সমাজ অন্য রাজ্যের চেয়ে অনেক বেশি সক্রিয় বলেই ধর্ষণ, শ্লীলতাহানি বা নারী নিযার্তনের ঘটনাও অনেক রাজ্যের চেয়ে এখানে বেশি নথিভুক্ত হয়। সুনন্দাদেবীর মত সম্পর্কে কোনও প্রতিক্রিয়া জানাতে চাননি অশোকবাবু। বলেছেন, “ওঁর মত উনি জানিয়েছেন। তা নিয়ে আমি কোনও মন্তব্য করতে চাই না।”
ঘটনাচক্রে এ দিনই বসিরহাটের মাটিয়া বাজারে এক জনসভায় তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায় দাবি করেন, “দিল্লিতে গত এক বছরে ৩২৭টি ধর্ষণ হয়েছে। তার পরে মুম্বই, বেঙ্গালুরু। পশ্চিমবঙ্গে মাত্র ৪৭টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। যদিও একটাও হওয়া উচিত ছিল না। তবে প্রতিটি ক্ষেত্রেই পুলিশ অপরাধীকে গ্রেফতার করেছে।”
|
শুধু নির্ভয়া নিয়ে হইচই করলেই হবে না: কবীর
নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা |
নির্ভয়ার ঘটনা নিয়ে প্রচুর হইচই হয়েছে। কিন্তু এমন আরও অজস্র ঘটনা নিয়ে কার কতটা মাথাব্যথা রয়েছে? প্রশ্ন তুললেন স্বয়ং সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি আলতামাস কবীর। নারী দিবস উপলক্ষে কলকাতা হাইকোর্ট আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে কবীর বলেন, নিভর্য়ার ঘটনা নিয়ে দেশ জুড়ে প্রতিবাদ হয়েছে। নির্ভয়ার পরিবারকে সরকার বড় অঙ্কের ক্ষতিপূরণ দিয়েছে। কিন্তু কবীরের কথায়, ওই ১৩ ডিসেম্বরই দশ বছরের একটি দলিত মেয়েকেও ধর্ষণ করে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সেই খবর পরদিনের কাগজে ভিতরের পাতায় কয়েক লাইন ছাপা হয়েছিল। কবীর প্রশ্ন রাখেন, “সেই মেয়েটির কী হল? তার পরিবার কি কোনও ক্ষতিপূরণ পেয়েছে?” তাঁর বক্তব্য, নির্ভয়ার ধর্ষণ ও খুন কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং অজস্র ঘটনার একটি। সেটা কিছুতেই ভুললে চলবে না। |