|
|
|
|
|
|
|
সুমনামি |
কবীর সুমন |
শওকত এক তরুণ বাঙালি ব্যবসায়ী, মধ্য কলকাতায় গান-বাজনার যন্ত্রপাতির দোকান দিয়েছেন। ফিতে কাটার জন্য আমায় ধরে নিয়ে গেলেন। ছিমছাম দোকানে শওকতের আব্বা, এক ভাই, জনৈক আলোকচিত্রী এবং এক সাংবাদিক। এক পাশে একটি টুলের ওপর গুটিসুটি মেরে বসে আছেন এক বয়স্ক পুরুষ। ফিতে কাটার পর সাংবাদিকটি শওকতকে বললেন, কবীরদাকে তোমার দোকানের একটা গিটার দাও হে; আসল উদ্বোধনটা হয়ে যাক। টুলে বসা বয়স্ক মানুষটিও বলে উঠলেন, অবশ্যই, সুমন চট্টোপাধ্যায় এসে পড়েছেন, একটা গিটার দাও ওঁকে। অপরিচিত সেই ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে বললাম, দাদা, কিছু মনে করবেন না, বছর তেরো হয়ে গেল আমার নাম কিন্তু কবীর সুমন। এটাই আমার নাম।— একটু অপ্রস্তুত হয়ে ভদ্রলোক বললেন, ও হ্যাঁ হ্যাঁ, ভুল হয়ে গিয়েছে, কবীর সুমন। দাও, একটা একুস্টিক গিটার দাও কবীর সুমনকে, একটু বাজান। তার পরেই শুনলাম বিড়বিড় করে তিনি বলছেন গিটার মানে একুস্টিক। ইলেকট্রিক নয়।
চোখাচোখি হল তাঁর সঙ্গে। শওকত তত ক্ষণে নতুন একটি গিটার বাগিয়ে ধরেছেন আমার দিকে। বলছেন, স্যর, এটা একদম নতুন মডেল, বিল্ট-ইন ইকুয়ালাইজরও আছে। একটা চেয়ারে বসতে যাব, ভদ্রলোক নরম গলায় বলে উঠলেন, অধমের নাম সমীর খাসনবিশ। নতুন গিটারটা আমার হাত থেকে পড়ে যায় আর কি।
১৯৭২ সাল। আমার বয়স তখন তেইশ। কলকাতার অক্রূর দত্ত লেন-এ হিন্দুস্তান রেকর্ড সংস্থার স্টুডিয়োয় আমি আমার জীবনের প্রথম গ্রামোফোন রেকর্ডিং করতে এসেছি। রবীন্দ্রনাথের দু’টি গান: হেলাফেলা সারাবেলা, ফিরবে না তা জানি। আমার বাবা সুধীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ের অনুরোধে সুবিনয় রায় আমায় ট্রেনিং দিয়েছেন রেকর্ডিং-এর জন্য। সে যুগে তখনও ট্রেনার থাকতেন। ট্রেনার কিন্তু আমার রেকর্ডিং-এর দিন স্টুডিয়োয় অনুপস্থিত। তাঁর হয়ে হাজির সুধীন্দ্রনাথ।
হাজির বাঁশি নিয়ে চানুদা, তবলায় আর বেহালায় কারা ছিলেন মনে নেই (ক্ষমাপ্রার্থী), আর স্প্যানিশ গিটার হাতে এক যুবক। আমার চেয়ে বড়, কিন্তু দেখে মনে হচ্ছে বয়স বছর তিরিশের বেশি নয়। রেকর্ডিস্ট নীরদবাবু আলাপ করিয়ে দিচ্ছেন: এই হল সুমন, আর এই হল সমীর। সমীর খাসনবিশ, স্প্যানিশ গিটার বাজাবে। এই বাজনাটি তার আগে কখনও অত কাছ থেকে দেখিনি। চেনা ছিল হাওয়াইয়ান গিটার। খুবই লোকপ্রিয় ছিল সে যুগে। বেতারে নিয়মিত বাজত। আমি যখন ১৯৬৭ সালে বেতারে বড়দের অনুষ্ঠানে গান গাওয়া শুরু করলাম, তখন আমাদের সঙ্গে হাওয়াইয়ান গিটার বাজাতেন কার্তিক বসাক। তারও পরে বরুণ পাল। হাওয়াইয়ান গিটার ও মোহনবীণায় বরুণ পালের মতো সৃষ্টিশীল শিল্পী কমই এসেছেন। কিন্তু স্প্যানিশ গিটার যন্ত্রটি কেউ বাংলা গানের রেকর্ডিং-এ আকাশবাণীতে বাজাচ্ছেন, দেখিনি সে যুগে।
|
|
ছবি: সুমন চৌধুরী |
বেজায় আগ্রহ হয়েছিল আমার সে কী, আমার গানের সঙ্গে স্প্যানিশ গিটার বাজাবে? মহড়ার সময়ে প্রথম কর্ডটি সেই যুবক যখন আলতো করে, স্বর থেকে স্বরে, ছোট ছোট ঢেউয়ের মতো বাজালেন, শিহরন হয়েছিল আমার শরীরে, মনে আছে। সে দিন যে গায়কের বয়স ছিল তেইশ, আজ, ২০১৩-র গোড়ায়, সে চৌষট্টি। সে দিনের সেই নম্র ভাবে, রবীন্দ্রসংগীতের মেজাজ বজায় রেখে স্প্যানিশ গিটারে কর্ড বাজানো যুবক আজ একটি বাজনার দোকানে টুলের ওপর গুটিসুটি মেরে বসে আজকের চৌষট্টিওয়ালাকে বলছেন, ‘অধমের নাম সমীর খাসনবিশ’।
কলকাতার যে দোকানে গিটার সাজানো, তার উদ্বোধনে তাঁকেই তো আগে আমন্ত্রণ জানানোর কথা। সমীর খাসনবিশকে তরুণ শওকত চেনেন ও সম্মান করেন দেখে মনে হল বছরের গোড়ার দিকেই এটা ঘটল যখন, বছরটা বোধহয় সুরে-ছন্দে ভালই কাটবে।
আমার হাতে ধরিয়ে দেওয়া গিটারটি তাড়াতাড়ি তাঁর হাতে তুলে দিয়ে তাঁকে নমস্কার করলাম। ছি ছি, সমীরদা, কী লজ্জা, আপনাকে চিনতে পারিনি। হাতে নেওয়া যন্ত্রটিতে হাত বোলাতে বোলাতে তিনি বললেন, কত দিন দেখা হয়নি। চেহারা পালটে গেছে। তোমার দোষ নেই। তা, তুমিও একটা গিটার নাও, দু’জনেই বাজাই। এই, কেউ এক জন আমায় একটু ‘ই’-টা দাও না! ‘ই’ পর্দাটিতে স্প্যানিশ গিটারের এক নম্বর আর ছ’ নম্বর তার বাঁধা হয়। এক নম্বর তারটি সুরে বেঁধে নিতে পারলে বাকি তারগুলো সেই হিসেবে বেঁধে নেওয়া যায়। কপালজোরে আমি এর পর যে গিটারটি হাতে পেলাম, তাতে একটি বিল্ট-ইন টিউনার আছে। ছ’নম্বর তারটা আমি ‘ই’-তে মেলাতেই সমীর খাসনবিশ সেটা কানে নিয়ে চটপট বেঁধে নিতে লাগলেন তাঁর গিটার। আমি গিটারটা সুরে বেঁধে বসে থাকলাম। সমীর খাসনবিশের সামনে আমি গিটার বাজাতে শুরু করব? তার চেয়ে এই দেশে, এমনকী এই রাজ্যে, ২০১৪ সালে আর এক বার ভোটে দাঁড়ানোও ভাল।
উদাস ভাবে একটু-আধটু বাজাচ্ছেন ১৯৭২ সালে অক্রূর দত্ত লেনের স্টুডিয়োয় প্রথম দেখা সেই শিল্পী, যাঁর গিটারের একটি কর্ডের ওপর চানুদার অননুকরণীয় বাঁশির আর্তির রেশ ধরে শুরু করেছিলাম ‘ফিরবে না তা জানি’।
নীরদবাবুকে মনে আছে তোমার? আছে বইকি, সমীরদা। উনিই তো আমাদের রেকর্ডিস্ট ছিলেন। দেবব্রত বিশ্বাসের কত রেকর্ডিং তাঁর হাতে করা। আর চানুদা বাঁশি বাজিয়েছিলেন, মনে পড়ে সমীরদা? চানুদা কে? অনেক ক্ষণ চুপ করে থাকা সাংবাদিকের প্রশ্ন। কুমার বীরেন্দ্র নারায়ণ, সমীর খাসনবিশ বললেন।
লম্বায় একটু কম, ফরসা, খানিকটা পাহাড়িদের মতো মুখ, বাঁশিতে তোলা সুরে পল্লিবাংলার অন্তরাত্মাকে স্বচ্ছন্দে তুলে আনতে পারতেন যে চানুদা, আমার রেকর্ডিং-এর আগে তাঁকে কখনও দেখিনি। বাবা আমায় বলেছিলেন, এই দ্যাখ, ইনি শচীনকর্তার সে যুগের খুনে গানগুলোর রেকর্ডিং-এ বাঁশি বাজিয়েছিলেন। ‘নিশীথে যাইও ফুলবনে’, ‘পদ্মার ঢেউ রে’ আমার রেকর্ডিং-এও কী-বাঁশিই না বাজিয়েছিলেন চানুদা! সেই কথাই আজ বলাবলি করছি সমীর খাসনবিশ আর আমি। বুঝলে সুমন, চানুদা আর অলোকনাথ দে-র মতো বাঁশিশিল্পী আর হল না। ইন্টারলিউড এমন ভাবে বানিয়ে নিয়ে বাজাতেন, যে কখনও তা গানের পরের অংশটার ঘাড়ে গিয়ে পড়ত না। গিটারে এ-মাইনর স্কেলে এক টুকরো তান আনমনে বাজিয়ে অতীতের দিকে ফিরে তাকাচ্ছেন সমীর খাসনবিশ আজ যাঁর বয়স একাত্তর। কোমল গান্ধারটা শুদ্ধ গান্ধার হল, তিনি স্মরণ করছেন বটুক নন্দীকে যাঁর কাছে হাওয়াইয়ান গিটার শিখেছিলেন সমীর খাসনবিশ। আর কাজী অনিরুদ্ধ ও রজত নন্দীর মতো বটুক নন্দীও ছিলেন গিটারের রাজা সুজিত নাথের ছাত্র, বললেন তিনি। আর স্প্যানিশ গিটার? ফ্রি স্কুল স্ট্রিট থেকে বই কিনে নিজে নিজে। সুধীন দাশগুপ্তর সংগীত পরিচালনায় ‘তিন ভুবনের পারে’, ‘ছদ্মবেশী’র মতো ছবির রেকর্ডিং-এ খোকন মুখার্জির সঙ্গে স্প্যানিশ গিটার বাজিয়েছিলেন যে-সমীর খাসনবিশ, তিনি হাওয়াইয়ান গিটারে গুরুর কাছে তালিম নেওয়ার পর বই পড়ে পড়ে স্প্যানিশ গিটার বাজানো শেখেন। বললেন, খোকনও তো ওই ভাবেই শিখেছিল কী বিরাট শিল্পী, ভাবো! কানে শুনে বাজিয়েছি আমরা। আমার কানে এল ডি-মাইনর কর্ড। আনমনে, প্রায় আদর করার মতো বাজাচ্ছেন সমীর খাসনবিশ। |
|
|
|
|
|