রবিবাসরীয় প্রবন্ধ ৩...
একটাভয়[কষ্ট]জ্জাঘেন্না
গাড়ির কাচে থ্যাবথ্যাব করে দুটো ছোট্ট হাত, মুখে ইডেন গার্ডেনের নিয়নের মতো একটা ফোকলা মাড়ির হাসি, গায়ের জামাটা মলিন, নাকে সর্দি গড়িয়ে আসছে, পা-দুটো ঝুলছে মায়ের কোল থেকে একটা কচি রোগা বাচ্চা ট্রাফিক সিগনালে ভিক্ষের উপলক্ষ হয়ে ঘুরছে। প্রতি সিগনালে কানের কাছে একটা ঘ্যানঘ্যান শব্দ: একটা টাকা দাও না মা, বাচ্চাটা কিছু খায়নি। আমার গলার কাছে দলা পাকিয়ে আসে রোজ। রাগে গনগন করতে থাকি— এটা কী একটা উপায় পেট ভরানোর, মা’টাকে তো দেখে মনে হচ্ছে বেশ কর্মঠ, তা হলে এ ভাবে বাচ্চাটাকে নিয়ে সিগনালে ভিক্ষে করার কী মানে?
মনের সঙ্গে যুদ্ধ করি, ভিক্ষে দেওয়া উচিত কি উচিত নয়। যদি রোজ ভিক্ষে দিই, তা হলে তো এদের কাজ করার ইচ্ছেটা চলে যাবে। চেয়েচিন্তে খাবার জোগাড় করার অভ্যেসটাই থেকে যাবে। কিন্তু তার পর আবার ওই ছোট্ট ছোট্ট হাতের থাবা, নাকের সর্দি, ফোকলা হাসি মনে পড়ে। ওদের কথা মনে করে ভিক্ষে দিয়েও দিই। হয়তো উপায়টা ঠিক নয়, স্মার্ট তাত্ত্বিকরা মুচকি হাসবে, কিন্তু চাহিদাটা তো সত্যি, খিদেটা তো সত্যি, দারিদ্রটা তো সত্যি।
অনেক পরে আবার জানলাম, যে সব বাচ্চাকে আমরা সিগনালে দেখি, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ওরা ভাড়া-করা বাচ্চা। সিমপ্যাথি জাগানোর কাজে লাগে। আমার ভেতরটা টনটন করে উঠেছিল। কত কষ্টে থাকলে এক জন মা তাঁর তিন মাস কিংবা ছ’মাস কিংবা আড়াই বছরের বাচ্চাকে সারা দিনের জন্য ভাড়া দিয়ে দেন। অচেনা মহিলার কোলে, অযত্নে, খিদেয়, তেষ্টায় প্রত্যেক দিন ওরা যে দুমড়েমুচড়ে যায়, সে জ্বালার চেয়ে দারিদ্রের জ্বালা নিশ্চয়ই বেশি, তাই না? কিংবা কে বলতে পারে, হয়তো বাচ্চাটার দুধ জোগাড়ের জন্যই এই পন্থা।
ভাবি, আচ্ছা ওই বাচ্চাটা তো একদম কাদার তাল, কিচ্ছু বোঝে না! সকাল সকাল তাকে মায়ের কোল থেকে উপড়ে একটা অন্য লোককে দিয়ে দেওয়া হয়, তার পর চড়চড়ে রোদ্দুরে তাকে নিয়ে অবিরাম রাস্তা-পারাপার চলে! কী অসম্ভব কষ্ট হয় ওর! যেই সিগনালে গাড়ি দাঁড়াবে, দৌড়ে আসা হবে ওকে নিয়ে, এগিয়ে দেওয়া হবে জানলার সামনে, ও কাঁদলে তো আরও ভাল, বাবুদের মন নরম হবে। ওর নিশ্চয়ই মা’র জন্য মন-কেমন করে, খেলতে ইচ্ছে করে। কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি উঠে যায়। ভিক্ষে দেওয়া হয়ে গেলেও আমি নজর রাখি। এই রে, এই কচি মেয়েটার পা’টা কি চলন্ত গাড়ির কাচে জোরে ঘষে গেল? এই রে, ওকে কি কাঁদাবার জন্য একটা নিষ্ঠুর চিমটি কেটে লাল করে দেওয়া হচ্ছে?
শীতের রাতে, একই দৃশ্য। আমি গাড়ির ভেতর শাল চাপাচুপি দিয়েও কাঁপছি আর ওই বাচ্চাটা মহিলার কোলে নেতিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে, গায়ে ছেঁড়া সোয়েটার, গালে জলের দাগ, হয়তো খিদেয় কেঁদে কেঁদে ঘুমিয়ে গিয়েছে, হয়তো খুব শীত করছিল, হাত-পাগুলো ঝুলছে। ঘাড়টা লটপট করে এক বার এ দিকে পড়ছে এক বার ও দিকে পড়ছে। মাঝে মাঝে খুব জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করে, তোমার খিদে পেয়েছে সোনা, তোমার খুব কত্ত হচ্ছে নাকি? কিন্তু সে বোধহয় ন্যাকামি হয়ে যাবে, আদিখ্যেতা। হয়তো বাচ্চারা দুঃখকষ্ট এত তীব্র ভাবে বোঝেও না, আমি মিছিমিছি ভাবছি। কিন্তু পরের দিন সিগনালে বাচ্চাগুলোর একটাকে না দেখতে পেলে মন কু ডাকে— তা হলে কি ওই কোঁকড়াচুলো মেয়েটার কিছু হল?


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.