হয় হয়, যদি সেই প্রেসিডেন্টের নাম হয় উগো চাভেস।
আট বছর আগের এক অভিজ্ঞতার সূত্র ধরে লিখছেন
উষসী চক্রবর্তী |
ইফ ইউ হেজিটেট ইউ লুজ’ তুমি যদি দ্বিধা করো, তা হলেই তুমি হেরে যাবে। আট বছর আগে বহু কষ্ট করে জোগাড় করা এক্সক্লুসিভ সাক্ষাৎকারের অনেকখানিই এখন ভুলে গিয়েছি। খানিকটা বেরিয়েছে ছাপার অক্ষরে। খানিকটা হয়তো কোনও ডিজিটাল টেপ রেকর্ডারের খাঁজে মমি হয়ে গিয়েছে। কিন্তু এ কথাটা কোথাও লেখা থাকুক না থাকুক, ফুল ফুটুক না ফুটুক, আমার মনে থেকে যাক অবিরাম! থেকে যাবে!
তখন আনন্দবাজারে ভরপুর চাকরি করি। উগো চাভেস কলকাতায়। সম্পাদক মহাশয়ের কেন যেন মনে হয়েছিল, এ সাক্ষাৎকার আমিই নেব, নিতে পারব! ‘কিন্তু আমার তো পা ভাঙা, ছুটিতে আছি, ক্রাচ নিয়ে হাঁটছি’ ইত্যাদি। ‘আরে পারবি, ঠিক পারবি,’ বলেছিল আনন্দবাজারের আর এক স্টার রিপোর্টার, আমার এক কালের প্রতিবেশী। ‘বিষয়কে যদি ভালবাসিস, জার্নালিজমকে যদি ভালবাসিস, ক্রাচ-টাচ কোনও ব্যাপারই না। ধুউউর।’
ব্যস, চোখে ঝিলমিল লেগে গেল। এক পা ভাঙুক আর দুই, সাক্ষাৎকার আমি নিয়েই ছাড়ব।
তার পর কত কাঠখড় পুড়িয়ে সেই সাক্ষাৎকারের টাইম বের করা গিয়েছিল, সে ইতিহাসে আর যাচ্ছি না। মোদ্দা কথা, ঠিক হল, উনি এয়ারপোর্ট-এ বেরনোর আগে বাইপাসের এক পাঁচতারাতে দেখা হবে।
সময় মতো পৌঁছে গেলাম।
কিন্তু গিয়ে শুনি এক ঘণ্টা আগে বেরিয়ে গেছেন। তার মানেটা কী? ইন্টারভিউ হবে না? খোঁড়া পায়ে জার্নালিজম-এর জন্য ‘শহিদ’ হওয়া বাতিল? ভেঙে পড়ি আর কী! |
আবার কাকুতিমিনতি। কার যেন দয়া হল। কোনও এক সরকারি অফিসারের গাড়িতে করে পাঠিয়ে দেওয়া হল এয়ারপোর্ট। আপাতত ওখানেই অপেক্ষা।
প্রায় তিন ঘণ্টা অপেক্ষার পর দোভাষীর সঙ্গে যিনি এলেন, আমেরিকানরা তাঁর নাম দিয়েছে ‘কালো বাঁদর’ (আজ্ঞে হ্যাঁ, শোনা যায়, খুব রেগে গেলে চাভেসকে আমেরিকানরা এই নামেই ডাকতেন)।
বাঁদর তো বোঝা গেল, রাগের নাম! কিন্তু কালো কেন? দিব্যি ফরসা, সুন্দর খেলোয়াড়ি চেহারা। দেখলেই মালুম হয়, এক কালে প্যারাট্রুপার ছিলেন। খুব দাপুটে, কিন্তু সব সময় একটা ছটফটে ভাব। মনে হবে, এত-শত প্রোটোকলের আড়ালে একটা ছেলেমানুষি ধরে রেখেছেন সর্বাঙ্গে।
উগো চাভেসের ছেলেমানুষির গল্পের কোনও অভাব নেই। যখন যে দেশে যেতেন, লোকজন অবাক হয়ে দেখত প্রেসিডেন্ট এমন হয়! বিশেষ করে যে সব জায়গায় মানুষ আচরণে একটু বেশি সংযমী, আর মন্ত্রী-সান্ত্রিরা তো বেজায় রাশভারী, সেখানেও চাভেস নিজের মতো। যে রাস্তা দিয়ে তাঁর গাড়ি যায়, তার দু’ধারে মানুষ ভিড় করে দাঁড়িয়ে থাকে, তিনি থেকে থেকেই নেমে পড়ে এগিয়ে যান, হাত মেলান দর্শকদের সঙ্গে। বেজিংয়ে যে বাড়িতে তাঁকে থাকতে দেওয়া হয়েছিল, তার ভেতরে প্রশস্ত বাগান, চমৎকার সরোবর। ফলে তাঁর দেহরক্ষীরা মহা বিপদে পড়লেন। কারণ, চাভেস কারও কোনও কথা শোনেন না, ইচ্ছে হলেই বাগানে হাঁটতে বেরিয়ে পড়েন, সরোবরের ধারে জগিং করে তিনি মহা খুশি। আর চিনের প্রাচীর দেখার সময় তো তাবৎ প্রোটোকল, সমস্ত সফরসঙ্গী, নিরাপত্তারক্ষীদেরও পিছনে ফেলে ধাঁ দৌড়। ওরে থামা, থামা! প্রেসিডেন্টকে কে থামাবে। এক বার জাপানে না কোথায় সদ্য-আলাপ-হওয়া এক মন্ত্রী কিংবা অফিসারের চোখ টিপে ধরেছিলেন পিছন থেকে, মজা করে ‘বলুন তো কে আমি’ গোছের ব্যাপার আর কী। ভেনেজুয়েলার মানুষ নাকি সচরাচর এই রকমই হয়ে থাকেন, দিলদরিয়া, খোলামেলা।
এখানেও তো, রাজারহাটের গ্রামে গিয়ে দুম করে খেতে বসে গেলেন সবার মধ্যে। “এমন প্রেসিডেন্ট সত্যি-ই আগে দেখিনি। সমস্ত প্রোটোকল ছাপিয়ে কোথায় যেন মানুষ চাভেস বেরিয়ে আসছেন সব সময়। স্বতঃস্ফূর্ত, আবেগপ্রবণ। দাপুটে কিন্তু আন্তরিক,” গাড়িতে ‘লিফ্ট’ দেওয়ার সময় জানিয়েছিলেন সরকারি অফিসার।
আমি অবশ্য ‘দাপট’ টের পেলাম শুরুতেই। জিজ্ঞাসা করেছিলাম, “আপনি বুশের সঙ্গে টক্কর দিচ্ছেন, কিন্তু আমেরিকাকে আটকাবার মতো সামরিক শক্তি, পরমাণু অস্ত্র আছে আপনাদের?” খুব এক চোট হাসলেন। যেন না বুঝে কী একটা বলে ফেলেছি। “আপনারাও তো ব্রিটিশদের হটিয়েছিলেন। সেটা কি অস্ত্রের জোরে?” তার পর বললেন, “অনেক দিন আগে লাতিন আমেরিকার মানুষ যুদ্ধ করে স্পেনীয় সাম্রাজ্যবাদকে লাতিন আমেরিকা থেকে উৎখাত করেছিল। তাদের কিন্তু স্প্যানিয়ার্ডদের মতো সামরিক শক্তি ছিল না। প্রায় দু’শো বছর আগে লাতিন আমেরিকার মুক্তিদাতা সাইমন বলিভার বলেছিলেন ‘when you hesitate you loose.’ আমি মনে করি, এটাই লাতিন আমেরিকার আত্মার মূল কথা। যে কোনও যুদ্ধে জিততে হলে অস্ত্রই শেষ কথা না। ভিয়েতনামের কথা ভাবুন। আমাদের আসল অস্ত্র আমার দেশের, আমার মহাদেশের মানুষ।
‘আপনি কি সোশালিস্ট?’
শুনুন, আমি রেভলিউশনে বিশ্বাস করি। তবে এক নতুন ধরনের বিপ্লব, যার সঙ্গে গণতন্ত্রের কোনও বিরোধ থাকবে না। আমি মনে করি রেভলিউশনারি ডিমক্র্যাসি, এটাই আজকের নতুন পথ। মনে রাখতে হবে আজকের দুনিয়ায় কেউই কারও মডেল হতে পারে না। চিন, সোভিয়েত, চে গেভারা, কেউই আমার মডেল না। আর সমাজতন্ত্রের কথা যদি বলেন তা হলে আমি বলব আমি খ্রিস্টান। স্বয়ং যিশু খ্রিস্ট সোশালিস্ট ছিলেন। আমি তাই অবশ্যই সোশালিস্ট।
শুনেছিলাম প্রেসিডেন্ট চাভেসকে এক বার সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে বন্দি করে অন্য এক জনকে প্রেসিডেন্ট করা হয়েছিল। তার পর লক্ষ লক্ষ লোক রাষ্ট্রপতি ভবন অবরোধ করে। এক ঘণ্টার নোটিস দেয় নতুন রাষ্ট্রপতিকে: চাভেজকে মুক্তি দাও, নয়তো তোমাকেই শেষ করব। সত্যি, না গল্প? ওঁর মুখ থেকে শুনতে চাইছিলাম। বললেন: “আরে সে খুব মজার গল্প। ঘুম ভেঙে দেখি আমার চার পাশের গার্ডের চেহারা পাল্টে গিয়েছে। আমি তো ভাবলাম স্বপ্ন দেখছি। তার পর হঠাৎ চার পাশের বৃত্তটা ছোট হয়ে এল আর বন্দুকধারী নতুন রক্ষীরা বলল, আপনি ক্ষমতাচ্যুত, আপনাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তার পর আমায় হেলিকপ্টারে কোথায় একটা নিয়ে গিয়ে বলল, পিছন ঘুরে দাঁড়াও। বুঝলাম ফায়ারিং স্কোয়াড। মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ভাবলাম, মানুষের জন্য এত কিছু করলাম, পাশে থাকলাম, এত বিশ্বাস রাখলাম। তারা কোথায়? তার পর তো দাঁড়িয়ে আছি, গুলি আর চলে না। শুনি গার্ডদের মধ্যে কী নিয়ে যেন ধুম ঝগড়া হচ্ছে। হঠাৎ কয়েক জন গার্ড আমায় ঘিরে ধরে বাকিদের বলতে লাগল, “একে যদি তোমরা গুলি কর, তা হলে আমরা তোমাদের গুলি করব।” তার পর দেখি একটি হেলিকপ্টার এসে থামল। আমি ভাবলাম, এ বার হয়তো আমেরিকা উড়িয়ে নিয়ে যাবে। কিন্তু হেলিকপ্টার দেখি কারাকাসে আমার প্রাসাদের দিকে এগোচ্ছে। হাজার হাজার নিরস্ত্র মানুষ সেই প্রাসাদ ঘিরে রেখেছে। বললাম না? যুদ্ধ জেতার জন্য সব সময় অস্ত্রের দরকার পড়ে না। পরে শুনলাম সেদিন কারাকাসের মানুষ বলেছিল, এই প্রাসাদ আমার।”
কারাকাসের প্রাসাদ ছেড়ে অনেক দূরের দেশে যাত্রা করেছেন চাভেস। সে দেশে অভ্যুত্থান, অবরোধ, দাদাগিরি কিছুই চলে কি না, জানা নেই কারও। চলুক না চলুক, জীবনের যে কোনও ছোট বড় লড়াইয়ে চোখের মণি চাভেস। যে সময় কখনও অতীত হয় না, তার ছায়া হয়ে চাভেস বলে চলবেন, ‘ইফ ইউ হেজিটেট ইউ লুজ’। |