মূর্তিপূজা সর্বত্র প্রচলিত। সম্প্রতি উগো চাভেস-এর মৃত্যু ঘটিল। তাহার পরেই ঘোষণা হইল, চাভেসের মৃতদেহ অনন্ত কাল সংরক্ষিত থাকিবে এক সামরিক জাদুঘরে। চাভেসের বাণী, কর্মধারা বা আদর্শকে বাঁচাইয়া রাখিবার অঙ্গীকার যথেষ্ট হইল না, তাঁহার দেহটিকে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় জীবন্ত-ঘুমন্ত ভানে অস্তিত্ববান রাখিবার প্রয়োজন হইল। ইহার অপেক্ষা বড় মূর্তিপূজা আর কিছুই নাই। এই অভ্যাস সর্বাধিক প্রচলিত সমাজতন্ত্রীদের মধ্যে, যাঁহাদের নাকি ধর্মে বিশ্বাস নাই। কিন্তু পৌত্তলিকতায় অধিক বিশ্বাস, অন্ধ প্রণতি, তাঁহাদের আত্যন্তিক আস্তিক বানাইয়া ছাড়িয়াছে। লেনিনের মৃতদেহ সংরক্ষিত রহিয়াছে। সেই দেহ দর্শনার্থে যে বিশাল লাইনে দাঁড়াইয়া কাহারও হাসিবার রসিকতা করিবার অ-গম্ভীর থাকিবার অধিকার নাই, মূল কক্ষের ভিতর কথা বলা বা ছবি তুলিবার চেষ্টা তো দূরের কথা। গরীয়ান প্রাচীন মন্দির ও বিগ্রহের মতোই, নিষেধাজ্ঞাপূর্ণ পরিবেশে মূর্তিটির মহিমা অক্ষুণ্ণ রাখিবার চেষ্টা চলে। মাও জে দং, হো চি মিন ও আরও কয়েক জন সমাজতন্ত্রী নেতার মূর্তি এমন ভাবে সংরক্ষিত আছে, স্তালিনেরও কিছু কাল ছিল। নেতা চলিয়া যাইবার পরেও প্রাণপণ প্রয়াসে দেহটিকে ধরিয়া রাখার এই মানসিকতার মূলে অবশ্যই রহিয়াছে আনুগত্য, শ্রদ্ধা এবং জনগণের মধ্যে এই আনুগত্য ও শ্রদ্ধাকে অন্তহীন সঞ্চারিত রাখিবার পরিকল্পনা। যত ক্ষণ মৃতদেহটি থাকে, মনে হয় যেন মানুষটির অস্তিত্ব সম্পূর্ণ লোপ পায় নাই। ভগবান তন্দ্রাচ্ছন্ন রহিয়াছেন, এখনই উঠিয়া ধমক লাগাইতে পারেন। ইহাতে তাঁহার আদর্শের অবাধ্য হইবার সম্ভাবনা কমে। আমাদের দেশের ইতিহাস-মিথেও রহিয়াছে: সৈন্যেরা তাহাদের দোর্দণ্ডপ্রতাপ নৃপতির মৃতদেহটি দুর্গের উপরে দৃশ্যমান রূপে ঠেস দিয়া যুদ্ধ চালাইয়া গিয়াছিল, শত্রুরা দেহটি দেখিয়া ভয়ে কাঁপিতেছিল।
কিন্তু ইহার মূল তাৎপর্যটি হইল, অধিনায়কের সেনানীগণের নিজ আদর্শের সারবত্তার প্রতি বিশ্বাসের অভাব। যদি কোনও নায়ক বিপ্লব ঘটাইয়া থাকেন, তাঁহার জীবন সিঞ্চিত করিয়া সকল দেশকে জাগাইয়া থাকেন, প্রকৃত নেতার ন্যায় শত সার্থক অনুসারী তৈরি করিয়া থাকেন, তবে তাঁহার মৃত্যু যতেক বজ্রাঘাত লইয়া ভক্তকুলের উপর নামিয়া আসুক তাহাতে তাঁহার নির্দেশিত পথ অন্তর্হিত হইবে না। নিজ নশ্বর অস্তিত্ব অতিক্রম করিয়া, যুগে যুগে মানুষের মধ্য দিয়া তাঁহার রথ চলিবে। মৃত্যু এত দিন ধরিয়া এই গ্রহে প্রচলিত, উহা মানিয়া লইতে মানুষের অধিক সময় লাগে না। প্রিয়জনবিয়োগে সে তাৎক্ষণিক ভাবে চলচ্ছক্তিহীন হয়, কিন্তু উঠিয়া দাঁড়াইয়া কাজে ব্রতী হইতে কয়েকটি মুহূর্ত মাত্র প্রয়োজন। এইখানেই তাহার জয়। যদি কর্তার অবসানের পর সর্ব ক্ষণ কর্তার ভূতের জুজু দেখাইয়া জনতাকে কর্তব্যে প্রাণিত রাখিতে হয়, ‘এইয়ো! ফের বাচালতা! বাবা ওই ঘরে আছেন কিন্তু!’ ধমকাইয়া তাহাকে বিপ্লবের বেঞ্চিতে বসাইয়া রাখিতে হয়, তবে নেতা, আদর্শ ও সেই আদর্শ রূপায়ণের পদ্ধতির যথার্থতা সম্পর্কেই প্রশ্ন উঠে। আসলে নেতার প্রবল ব্যক্তিত্ব ও তাহার সম্মোহনী-ক্ষমতা সহসা সরিয়া যাইবার পর, মেজো-সেজোগণ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগিতে থাকেন। তাঁহাদের মনে হয়, এই বার আদর্শটির আকর্ষণ শিথিল হইয়া যাইবে। তখন তাঁহারা নেতাটির নশ্বর অবশেষের খুঁট ধরিয়া ঝুলিয়া পড়েন। যদি মহামানুষটির প্রকৃত প্রভাব ধরপাকড় গা-জোয়ারি ও রক্তচক্ষু-প্রদর্শন ব্যতিরেকেই প্রসারিত হইত, তবে ‘মড়াফেরা’-র সার্কাস করিয়া ইঞ্জিন চালু রাখিতে হইত না। |