১১ দিন সিআইডি হেফাজত মুন্নার
মুন্নাকে ফাঁসানো হয়েছে, আদালতে দাবি কৌঁসুলির
গার্ডেনরিচে পুলিশ খুনের মামলায় মহম্মদ ইকবাল ওরফে মুন্নাকে ফাঁসানো হয়েছে বলে আদালতে দাবি করলেন গার্ডেনরিচ-কাণ্ডে অন্যতম অভিযুক্ত তৃণমূল নেতার আইনজীবী।
শনিবার আলিপুর আদালতের মুখ্য বিচারবিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেটের এজলাসে মুন্নার আইনজীবী অশোক মুখোপাধ্যায় বলেন, এফআইআর-এ প্রথমে অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ নথিভুক্ত হয়েছিল। পরে নতুন করে ‘চেয়ারম্যানসাব’-এর নাম লেখা হয়। অশোকবাবুর বক্তব্য, মুন্না গার্ডেনরিচ এলাকার পরিচিত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। স্থানীয় থানার পুলিশকর্মীরা অন্তত তাঁর নাম জানেন। এফআইআর-এ তা হলে তা লেখা হল না কেন? ওই আইনজীবী বলেন, এতেই বোঝা যায়, অভিযোগে তাঁর মক্কেলের নাম জড়িয়ে দেওয়ার ছক কষা হয়েছিল।
বিশেষ সরকারি আইনজীবী নবকুমার ঘোষ অবশ্য মুন্নার আইনজীবীর ওই বক্তব্যের বিরোধিতা করেছেন। আদালতে তিনি বলেন, সরকারের কারও প্রতি ব্যক্তিগত আক্রোশ নেই। সমাজে শান্তি রক্ষা, অপরাধ দমনই সরকারের লক্ষ্য। বিচারেই কেউ দোষী বা নির্দোষ প্রমাণিত হতে পারেন।
দু’পক্ষের সওয়াল-জবাব শুনে ভারপ্রাপ্ত বিচারক বিজয়েতা দে মুন্নাকে ১১ দিনের সিআইডি হেফাজতে পাঠানোর নির্দেশ দেন।
অভিনব মুখোশ। হাওড়া স্টেশনে মুন্না। —নিজস্ব চিত্র
এ দিন দুপুর পৌনে ২টো নাগাদ আলিপুর আদালতের পুলিশ লক-আপে নিয়ে যাওয়া হয় মুন্নাকে। শুনানির সময় তাঁকে এজলাসে হাজির করা নিয়ে দু’পক্ষের আইনজীবীর মধ্যে মতবিরোধ হয়। অশোকবাবুরা জানান, তাঁদের মক্কেল অসুস্থ। তা ছাড়া আদালত চত্বরে সংবাদমাধ্যম এবং সাধারণ মানুষের ভিড় রয়েছে। সে কারণে আদালতে মুন্নাকে না-আনার নির্দেশ দেওয়া হোক। সরকারি আইনজীবী অবশ্য অভিযুক্তকে এজলাসে হাজির করানোর পক্ষেই সওয়াল করেন। শেষ পর্যন্ত বিচারকের নির্দেশে মুন্নাকে কাঠগড়ায় তোলা হয়।
এজলাসে ঢুকেই পরিচিতদের দিকে হাসিমুখে হাত নাড়েন মুন্না। তাঁর দিকে এগিয়ে যান মেয়ে সাবাতাজ। শুনানির সময় নিজের মনে বিড়বিড় করে কিছু বলতে দেখা যায় ইকবালকে। আইনজীবীদের সওয়াল-জবাব, বিচারকের মন্তব্য অবশ্য মন দিয়েই শোনেন তিনি।
শুনানির আগে বিচারক নাম জিজ্ঞাসা করলে বন্দর এলাকার এই দাপুটে তৃণমূল নেতা এবং ১৫ নম্বর বরোর চেয়ারম্যান বলেন, “মহম্মদ ইকবাল ওরফে মুন্না। লোগ মুঝে চেয়ারম্যানসাব ভি বুলাতা হ্যায়।”
নিজের বক্তব্য পেশ করতে গিয়ে পুলিশকর্মী খুন হওয়ার ঘটনাকে দুঃখজনক বলে চিহ্নিত করেন অভিযুক্তের আইনজীবী। তিনি বলেন, “মুন্নার বিরুদ্ধে পুলিশ খুনের অভিযোগ আনলেই কি তিনি দোষী হতে পারেন? সে দিন ঘটনাস্থলে শ’পাঁচেক লোক ছিল। তাদের কেউ গুলি চালিয়েছে। তার দায় মুন্নার উপর পড়বে কেন?”
কলকাতা পুলিশের এসআই তাপস চৌধুরী হত্যাকাণ্ডে তাঁর মক্কেল জড়িত নন বলে দাবি জানিয়ে অশোকবাবু বলেন, “গার্ডেনরিচের হরিমোহন ঘোষ কলেজে ওই দিন দু’টি দলের মধ্যে ঝামেলা হচ্ছিল। ওই পুলিশকর্মীর কোনও রাজনৈতিক রং ছিল না। মুন্নার সঙ্গে তাঁর কোনও বচসা হয়নি। তাঁকে খুন করার পিছনে কোনও উদ্দেশ্য থাকতে পারে না।”
অশোকবাবু বলেন, “পুলিশের করা মামলার ভয়েই আত্মগোপন করেছিলেন মুন্না। তাঁকে পলাতক বলা যায় না।” একই সঙ্গে তিনি জানান, পুলিশ এক দিকে সমাজের রক্ষক। কিন্তু তাদেরই একাংশ ক্ষমতার অপপ্রয়োগ করছে। এই প্রবণতা বন্ধ না-করলে অপরাধ আরও বাড়বে।
সওয়াল চলাকালীন সংবাদমাধ্যমেরও সমালোচনা করেন মুন্নার আইনজীবী। অশোকবাবু জানান, আদালতের আগে সংবাদমাধ্যমই কোনও ঘটনার ‘বিচার’ করে ফেলছে। ঘটনায় কারা জড়িত, তদন্তের গতিপ্রকৃতি, এমনকী অভিযুক্তের কী শাস্তি হওয়া উচিত, তা-ও ঠিক করে দিচ্ছে তারাই। এতে বিচারপ্রক্রিয়ার যৌক্তিকতা প্রশ্নের মুখে পড়ছে। ওই আইনজীবীর বক্তব্য, “বিচারক, আইনজীবী, অভিযুক্ত থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ, সবার উপরই সংবাদমাধ্যমের প্রভাব রয়েছে। কিন্তু বিচারের পর কারও দোষ যতক্ষণ না প্রমাণিত হচ্ছে, ততক্ষণ আইনের পরিভাষায় সেই ব্যক্তি নির্দোষই। তাঁর বক্তব্য, সংবাদমাধ্যমের এই প্রচারে তদন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। যে ভাবে এই ঘটনার প্রচার চলছে, তা একেবারেই আইনের পথে হচ্ছে না।
অশোকবাবু বলেন, গ্রেফতারের পর মুন্নাকে লক-আপেও প্রশ্ন করেন সাংবাদিকরা। আইন অনুযায়ী, হেফাজতে থাকাকালীন অভিযুক্তের কোনও মন্তব্য প্রচার করা যায় না। এ সব কারণে গার্ডেনরিচ-কাণ্ডের তদন্ত কতটা আইনি পথে হচ্ছে, তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন তিনি।
মুন্না উচ্চ রক্তচাপ, মধুমেহ, কিডনির সমস্যায় ভুগছেন বলে আদালতে জানান অশোকবাবু। সেই কারণে যে কোনও শর্তে তাঁর অন্তর্বর্তী জামিন চাওয়া হয়।
জামিনের আবেদনের বিরোধিতা করে সরকারি আইনজীবী নবকুমারবাবু বলেন, এফআইআর অনুযায়ী, ঘটনার দিন কলেজের ডান ও বাঁ দিকে জড়ো হওয়া জনতার মধ্যে প্রথম থেকেই বচসা চলছিল। দাঙ্গার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। পুলিশ সংযত ভাবে বাধা দিতে যায়। সেই কারণে তাদের উপর ক্ষোভ তৈরি হয়। এফআইআর-এ বলা হয়েছে, ‘চেয়ারম্যানসাব’ ডান দিকে জড়ো হওয়া নিজের লোকেদের উত্তেজিত করে তোলেন। তখনই উত্তর দিক থেকে বিস্ফোরণের আওয়াজ পাওয়া যায়। সরকারি আইনজীবী জানান, স্থানীয় থানার অফিসার-ইন-চার্জ রাম থাপাকে সেই দিকটি সামলাতে অনুরোধ করেন মুন্না। কয়েক জন পুলিশকর্মীকে নিয়ে ওই অফিসার সে দিকে যেতেই মুন্না তাঁর শাগরেদদের ‘মারো’ বলে সামনে এগিয়ে যেতে বলেন। তখনই তাঁর তিন শাগরেদ ইবনে, সুহান এবং ইমতিয়াজ তাপস চৌধুরীর উপর হামলা চালায়। ঘটনার দিন দু-তিন বার দু’পক্ষের মারমুখী জনতাকে সরিয়ে দেওয়ার জন্যই তাঁকে ‘টার্গেট’ করা হয়েছিল।
অভিযুক্তপক্ষের আইনজীবীরা বলেন, ১৫টি বরো রয়েছে। তা হলে ‘চেয়ারম্যানসাব’ বলতে শুধু মুন্নাকেই কেন ইঙ্গিত করা হচ্ছে? সরকারি আইনজীবী বলেন, আরও অনেকের কাছ থেকে পুলিশ মুন্নার নামে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেয়েছে।
সিআইডি হেফাজতের আর্জি জানিয়ে নবকুমারবাবু বলেন, গার্ডেনরিচের কয়েকটি এলাকায় গিয়ে তদন্তকারীরা দেখেছেন, সেখানে তাঁদের কাছে কেউ কোনও কথা বলতে ভয় পাচ্ছেন। ধৃত ব্যক্তি জামিন পেলে সেই সমস্যা বাড়তে পারে। তাঁকে জেরা করে ঘটনার তদন্তের পক্ষে জরুরি তথ্য, অস্ত্রের খোঁজ মিলতে পারে। তদন্তের প্রাথমিক পর্যায়ে যা গুরুত্বপূর্ণ। তাই মুন্নার ১৪ দিনের সিআইডি হেফাজত চাওয়া হয়।
এর আগে এ দিন সকাল ১০টা নাগাদ মুন্নাকে নিয়ে ভবানী ভবনে পৌঁছন সিআইডি অফিসারেরা। বেলা পৌনে ২টোয় আলিপুর আদালতে নিয়ে যাওয়া হয় তাঁকে। আদালত চত্বর মোড়া ছিল কড়া নিরাপত্তায়। মোতায়েন ছিল প্রচুর পুলিশ ও র্যাফ।
আলিপুর আদালতের পুলিশ লক-আপে মুন্নার সঙ্গে দেখা করেন বন্দর এলাকার এক তৃণমূল নেতা। পুলিশ গালিগালাজ করেছে বলে তাঁর কাছে অভিযোগ করেন মুন্না। সে সময় কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। তখন মুন্নাকে সুগারের ওষুধ দেওয়া হলেও তা তিনি পুলিশকর্মীদের ফিরিয়ে দেন।

সওয়াল-জবাব
মুন্নার আইনজীবী সিআইডির আইনজীবী
জামিন চেয়ে হেফাজত চেয়ে
খুনের মামলায় ফাঁসানো হয়েছে মুন্নাকে সরকারের কারও উপর ব্যক্তিগত আক্রোশ নেই
এফআইআরে পরে চেয়ারম্যান সাবের নাম একাধিক ব্যক্তিকে জেরায় মুন্নার নাম মিলেছে
তাপস চৌধুরীকে খুন করার কোনও কারণ ছিল না মুন্নার যুধুধান দু’পক্ষকে সরিয়ে দেন ওই এসআই। তা-ই নিশানা
ঘটনাস্থলে পাঁচশো লোক ছিল। দায় একা মুন্নার উপর কেন? মুন্নাই তাপস চৌধুরীর উপর হামলার নির্দেশ দিয়েছিলেন
মুন্নার উচ্চ রক্তচাপ, মধুমেহ, কিডনির সমস্যা রয়েছে অভিযুক্তের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা যেতে পারে সরকারি হেফাজতেই
 
 
 


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.