বিপদে ঠেলে সরে গেল দল, দাবি মেয়ের
বাবার বিরুদ্ধে এফআইআর হওয়ার পরেই তৃণমূলের একাংশের প্রতি ক্ষোভ জানিয়েছিলেন মহম্মদ ইকবাল ওরফে মুন্নার মেয়ে সাবাতাজ। শনিবার আলিপুর আদালতের বাইরে দাঁড়িয়ে ফের সেই ক্ষোভ উগরে দিলেন তিনি। যে ক্ষোভের নিশানা অনেকাংশেই তাঁর ‘ববি আঙ্কল’, অর্থাৎ রাজ্যের পুরমন্ত্রী ফিরহাদ (ববি) হাকিম। যিনি গার্ডেনরিচ কাণ্ডের পরে ইকবালের পাশে দাঁড়ালেও পরে ক্রমশ দূরত্ব বাড়িয়ে গিয়েছেন।
দলীয় নেতৃত্বের একাংশের বিরুদ্ধে উষ্মা জানিয়েছেন মুন্না নিজেও। সিআইডি সূত্রের খবর, শনিবার গোয়েন্দাদের সামনে মূলত বন্দর এলাকার রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত তৃণমূলের দুই শীর্ষ নেতার বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন কলকাতা পুরসভার ১৫ নম্বর বরোর চেয়ারম্যান। গার্ডেনরিচে পুলিশ অফিসার খুনের মামলায় অন্যতম অভিযুক্ত মুন্না জানিয়েছেন, পালিয়ে বেড়ানোর সময়ে তিনি ওই দুই নেতার সঙ্গে একাধিক বার যোগাযোগ করে পরামর্শ ও সাহায্য চাইলেও তাঁরা গুরুত্বই দেননি। অথচ ওই দু’জনের মধ্যে এক জনের জন্যই তাঁকে এতটা হেনস্থা হতে হল। ঘটনার পরে-পরেই তিনি এলাকায় আত্মসম্মান বজায় রাখার তাগিদে নিজে পুলিশের কাছে গিয়ে ধরা দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ওই নেতাই তাঁকে আত্মসমর্পণ না-করে কলকাতা ছেড়ে পালিয়ে দু-চার দিনের জন্য আত্মগোপন করে থাকার পরামর্শ দেন। এই নিয়ে ওই নেতার সঙ্গে মুন্নার বাদানুবাদও হয়েছিল।
মুন্না জানিয়েছেন, ওই নেতা প্রথমে তাঁকে বলেছিলেন যে, দু-চার দিনের মধ্যে তিনি সব কিছু সামলে নেবেন। তাঁর পরামর্শেই ১৩ ফেব্রুয়ারি রাতে গার্ডেনরিচের বিচালি ঘাট থেকে একটি ডিঙি নৌকায় হাওড়ার নাজিরগঞ্জে পৌঁছন মুন্না। ওই নেতার পরামর্শে শানু নামে এক যুবক মুন্নার সঙ্গীও হন। কিন্তু বাস্তবে ‘সামলে নেওয়া’র বদলে পরিস্থিতি ক্রমশ মুন্নার প্রতিকূল হয়ে উঠতে থাকে। তখন আর ওই নেতারা তাঁর পাশে দাঁড়াননি।
আলিপুর আদালতে সাবাতাজ। —নিজস্ব চিত্র
মুন্নার মেয়েরও বক্তব্য, “বাবা তো পার্টির নির্দেশেই সে দিন হরিমোহন ঘোষ কলেজের সামনে গিয়েছিলেন। বাবার ব্যক্তিগত কোনও কাজ ছিল না। অথচ পার্টি কোনও সাহায্য করেনি। সাহায্য করলে আজ আদালতে পার্টির লোকদের দেখতে পেতেন। আমাদের পরিবারটার এমন অবস্থা হত না।”
অসহযোগিতার অভিযোগে পুরমন্ত্রীকে অবশ্য আগাগোড়াই বিঁধে এসেছেন সাবাতাজ। গার্ডেনরিচ কাণ্ডের কয়েক দিন পরে বলেছিলেন, “ববি-আঙ্কল আমাদের ফোনই ধরছেন না।” আর শনিবার তিনি বলেন, “ববি আঙ্কল কোনও সাহায্য করেননি। সেটা এখন চর্চা করে আর কোনও লাভ নেই। আমার সঙ্গেও কখনও যোগাযোগ করেননি। সপ্তাহখানেক আগে রাতে ওঁর বাড়িতে গিয়েছিলাম। তখন ‘মন্ত্রী বাড়ি নেই’ বলে নিরাপত্তারক্ষীরা মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দেন।”
মুন্নার বিরুদ্ধে খুনের মামলা রুজু হওয়ার অব্যবহিত পরেই ববি বলেছিলেন, “ইকবাল এ কাজ করেছে বলে বিশ্বাস করি না।” তার এক সপ্তাহের মাথায় ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে বীরভূমের মুরারইয়ে তিনি বলেন, “আমার দলের কাউন্সিলর কোথায় কী করছেন, তার আমি কী জানি!” মুন্নাকে যখন এ দিন আদালতে তোলা হচ্ছে, সেই ববি তখন অজমের শরিফে। ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি মুন্না প্রসঙ্গে কোনও প্রশ্নেরই উত্তর দিতে চাননি।
তবে মুন্না ও তাঁর মেয়ের বক্তব্য যে তৃণমূলকে আরও অস্বস্তির মধ্যে ফেলতে চলেছে, তা দলীয় নেতাদের একাংশ মেনেও নিয়েছেন। এই অস্বস্তির সুযোগ নিতে চাইছে বিরোধীরাও। কংগ্রেস নেত্রী দীপা দাশমুন্সি রায়গঞ্জে বলেন, “তৃণমূলের নেতা-মন্ত্রীদের নির্দেশেই ইকবাল পালিয়ে গিয়েছিল। ইকবাল যদি দোষী হন, তা হলে তাঁকে মদত দেওয়া সেই নেতা-মন্ত্রীদেরও শাস্তি হওয়া উচিত।” পুরুলিয়ায় বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র বলেন, “সিআইডি-র পক্ষে কি এই রাজ্যের কোনও মন্ত্রীকে জিজ্ঞাসাবাদ করা সম্ভব? যত ক্ষণ তিনি মন্ত্রী পদে রয়েছেন, সেটা কী করে সম্ভব? এই সব কারণেই আমরা সিবিআই তদন্ত চেয়েছিলাম।”

গোয়েন্দারা জানান, মুন্না তাঁদের বলেছেন যে, ১২ ফেব্রুয়ারি হরিমোহন ঘোষ কলেজে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের জন্য মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার ব্যাপারে তিনি ও তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গরা প্রথমে জড়াতেই চাননি। ওই কলেজ ১৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের অন্তর্গত, আর মুন্না ১৩৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর। অবশ্য ১৫ নম্বর বরোর মধ্যেই ১৩৩ নম্বর ওয়ার্ড পড়ে। কিন্তু মুন্নাদের বক্তব্য ছিল, মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সময়ে প্রতিপক্ষকে কোনও বাধা দেওয়া উচিত নয়, প্রয়োজনে ভোটের দিন দেখা যাবে। কিন্তু সিআইডি জেনেছে, ১৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল কাউন্সিলর রঞ্জিত শীল কোনও ঝুঁকি নিতে চাননি। কারণ, তাঁর কাছে ওই কলেজের নির্বাচন ছিল এক রকম মর্যাদার লড়াই। তাঁর ভয় ছিল, তিনি একা মোক্তারকে সামলাতে পারবেন না। তাই মুন্নাদের সাহায্য তাঁর প্রয়োজন।
সাবাতাজও এ দিন দাবি করেন, “রঞ্জিত শীলই বাবাকে ডেকেছিলেন। কারণ, মোক্তার দলবল নিয়ে গিয়েছিল। মোক্তার যাতে হরিমোহন ঘোষ কলেজ দখল না-করতে পারে, সে জন্যই তিনি বাবাকে যেতে বলেন। রঞ্জিত শীল একা মোক্তারকে ‘কন্ট্রোল’ করতে পারছিলেন না।”
মুন্না যদিও জানিয়েছেন, রঞ্জিত শীল ডাকার পরেও তাঁরা এ ব্যাপারে দ্বিধায় ছিলেন। কিন্তু ১১ ফেব্রুয়ারি রাতে বোমা বাঁধতে গিয়ে বিস্ফোরণে গুরুতর জখম হন রঞ্জিত শীলের ছেলে অভিজিৎ ও তাঁর দুই সঙ্গী (পরে অভিজিৎ মারা যান)। ওই ঘটনার পর বন্দরের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত তৃণমূলের ওই শীর্ষ নেতাই মুন্নাকে বোঝান, এখন মুন্না সদলবল না-গেলে মোক্তার ফাঁকা মাঠে গোল দেবেন। তার পর আর মুন্নার উপায় ছিল না।
রঞ্জিত শীলের অবশ্য দাবি, তিনি মুন্নাকে ডাকেননি। বাঁশবেড়িয়া থেকে ফোনে তিনি বলেন, “মুন্না তো আর বাচ্চা ছেলে নন, যে কেউ ডাকলেই চলে আসবেন! হরিমোহন ঘোষ কলেজে ছাত্র সংসদ নির্বাচনে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার ব্যাপারে কাউন্সিলর হিসেবে আমি জড়াতে যাব কেন? আমি সমাজবিরোধী নিয়ে চলি না। তা ছাড়া, আগের রাতে বিস্ফোরণে আমার ছেলে জখম হয়। ছেলের চিকিৎসা নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম। কলেজের সামনে ১২ ফেব্রুয়ারি আমি ছিলামই না। কোথাও আমার ছবি পাওয়া যাবে না।” তা হলে মুন্না গেলেন কেন? রঞ্জিতবাবুর বক্তব্য, “উনি বরো চেয়ারম্যান। নিজের বরোর কোথায় উনি যাবেন কি যাবেন না, সেটা ওঁর ব্যাপার।”
সিআইডি সূত্রের খবর, মুন্না দাবি করেছেন, কলেজের সামনে সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে তিনি জড়ো হয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু সাব-ইন্সপেক্টর তাপস চৌধুরীর খুনের সঙ্গে তাঁর কোনও সম্পর্ক নেই। তাঁর দলের লোকজন যে সে দিন বোমাবাজি করেছিল, সেটা মুন্না স্বীকার করে নিয়েছেন। কিন্তু তাপসবাবু কী ভাবে গুলিতে মারা গেলেন, সেই ব্যাপারে তাঁর কোনও ধারণা নেই বলে মুন্নার দাবি।
গোয়েন্দা সূত্রের খবর, ইবনে ও সুহানকে নিছক পাড়ার ছেলে হিসেবে তিনি চেনেন বলে মুন্না দাবি করেছেন। গোয়েন্দারা মুন্নাকে বলেন, ইবনে তাঁর দেহরক্ষী ছিল বলে তাঁরা জেনেছেন। সরাসরি জবাব এড়িয়ে মুন্না জানান, ইবনেকে তিনি ছোট থেকেই চেনেন। গোয়েন্দারা জিজ্ঞাসা করেন, ইবনে নেহাতই তাঁর পাড়ার পরিচিত হলে ঘটনাস্থল থেকেই যখন পুলিশ তাকে ধরল, সেই সময়ে মুন্না কেন তাকে জোর খাটিয়ে ছাড়িয়ে নিলেন। উত্তরে মুন্না নীরব থাকেন। সংঘর্ষে ব্যবহৃত আগ্নেয়াস্ত্র ও বোমাগুলি কোথায় লুকিয়ে রাখা হয়েছে, সেই প্রশ্নেরও জবাবও দেননি। এ প্রসঙ্গে সাবাতাজের বক্তব্য, “বাবা বরো চেয়ারম্যান। তাঁর সঙ্গে অনেক লোক থাকে। তাঁর পাশে ইবনে-সুহানদের দেখা গিয়েছিল বলেই ওদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল, সে কথা প্রমাণিত হয় না।”
এ দিন সকালে ভবানী ভবনে পৌঁছনোর পর মুন্নাকে চিনি ছাড়া লিকার চা ও দু’টি বিস্কুট দেওয়া হয়। তাঁর ব্লাড সুগারের কথা ভেবে রান্না করা আলু ছাড়া সিম-বেগুন-ঝিঙের তরকারি দিয়ে দুপুরে দু’টো রুটি খান মুন্না। তার পর ব্লাড সুগারের ওষুধ খান। ওষুধ খাওয়ার পরই তাঁকে নিয়ে আদালতে রওনা হন গোয়েন্দারা। এ দিন সন্ধ্যায় সাবাতাজ তাঁর বাবার প্রেসক্রিপশন ও ওষুধ সিআইডি-র হাতে তুলে দেন।
 
 
 


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.