ইনিই ইকবাল! হাঁ হয়ে গেলেন পাশের যাত্রী
রাত তখন পৌনে দু’টো।
ট্রেনটা সবে গয়া স্টেশনে ঢুকেছে। ঝটিতি বি-থ্রি কামরায় উঠে ২২ নম্বর বার্থ খুঁজতে শুরু করলেন চার জন। এমনিতে দেখে তাঁদের সাধারণ যাত্রী বলেই মনে হবে। কিন্তু পরক্ষণেই চোখ চলে যেতে বাধ্য পিছনে থাকা পঞ্চম ব্যক্তিটির দিকে।
চার জনের পিছনেই সেই দীর্ঘদেহী। পরনে সাদা পাঞ্জাবি আর প্যান্ট, পায়ে স্নিকার্স। একটি সদ্য কেনা সবুজের উপরে ফুল-ফুল ছাপা বালিশের ঢাকনা দিয়ে মাথা-মুখ ঢাকা। চোখের কাছে বড় দু’টো ফুটো।
এবং হাতে হাতকড়া।
ব্যাপার কী? আশপাশের মানুষ ঘুম-চোখে নিজেদের বার্থ থেকে মাথা ঝুলিয়ে উৎসুক ভাবে তাকিয়ে আছেন।
২২ নম্বরটা আপার বার্থ। সেটা খুঁজে বের করে মুখঢাকা মানুষটিকে নীচের সিটে বসতে বললেন সঙ্গের চার জন। ওঁরা প্রত্যেকেই সিআইডি অফিসার। উল্টো দিকের সাইড লোয়ার বার্থের যাত্রী বছর পঞ্চাশের এক ব্যক্তি। মোগলসরাই থেকে ফিরছেন হাওড়ার বাড়িতে। ফিসফিস করে প্রশ্ন করলেন, “ইনি কে? কোনও বড় অপরাধী বুঝি?”
অস্ফুটে বললাম, “গার্ডেনরিচ-কাণ্ডের কথা শুনেছেন?” আর কিচ্ছু বলতে হল না। ভদ্রলোকের চোখ গোল হয়ে গেল। নিচু স্বরে বললেন, “ইকবাল, মানে মুন্না?” মাথা নেড়ে ‘হ্যাঁ’ বলতেই সেই যে হাঁ হয়ে গেল ভদ্রলোকের মুখ, তা আর বন্ধই হতে চায় না। কামরার ওই আবছা আলোতেই বারবার ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলেন মুন্নাভাইকে।
অঙ্কন: সুমন চৌধুরী
মুন্না এর মধ্যে মুখের ঢাকনা খুলে ফেলেছেন। সিআইডি অফিসাররা জিজ্ঞেস করলেন, “বাথরুম যাবেন তো?” ভাবলেশহীন চোখে কোনও দিকে না-তাকিয়ে খোঁচা খোঁচা পাকা দাড়ির লোকটি দু’দিকে মাথা নাড়লেন। সিআইডি অফিসার ঈষৎ কড়া সুরে বললেন, “যাবেন না, মানে? উপরের বার্থে আপনাকে শুতে হবে। এক বার উঠে গেলে কিন্তু হাতকড়া খুলে বারবার নামানো যাবে না! যা করার এখনই সেরে নিন।” মুন্নাভাই এ বার উঠলেন। সহযাত্রীদের বিস্ফারিত চোখের সামনে দিয়ে হেঁটে ট্রেনের শৌচাগারের দিকে এগিয়ে গেলেন। সঙ্গে হাতকড়ার অংশ ধরে আর এক পুলিশ অফিসার। মুন্নাভাই শৌচাগারে ঢুকে যাওয়ার পরে দরজা ভেজিয়ে ঠায় পাহারায় রইলেন তিনি। কিছুক্ষণ পরে মুন্নাকে নিয়ে ফিরে এলেন।
এর মধ্যে বাকি অফিসারেরা চাদর-বালিশ পেতে, কম্বল বিছিয়ে মুন্নার বিছানা রেডি করে ফেলেছেন। সিটে বসেই দেখলাম, মুন্না বার্থে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর বাঁ হাতের হাতকড়ার শিকল আপার বার্থের হ্যাঙারে আটকানো হল। হাতকড়া পরে শুয়ে সিআইডি-র ‘হাই প্রোফাইল’ কয়েদির আর পাশ ফেরার জো রইল না।
এ বার সিআইডি অফিসারদের চিন্তা, কে কোথা থেকে পাহারা দেবেন। মুন্নার দিকে নজর রাখতে গেলে একদম কাছের সাইড লোয়ার বার্থটাই সবচেয়ে জুতসই। সেখানেই মোগলসরাই থেকে ওঠা যাত্রীর আসন। “আপনি একটু অন্য বার্থে যাবেন?” এক সিআইডি-অফিসারের অনুরোধে তিনি তখন সসম্ভ্রমে পারলে পাশেই আমার বার্থে সরে আসেন। কিন্তু তা হতে দিলেন না গোয়েন্দারা। ওই ভদ্রলোককে মুন্নার নীচের বার্থটায় চলে যেতে বললেন তাঁরা। সিআইডি-র দু’জন অফিসার একসঙ্গে ওই ফাঁকা হওয়া সাইড লোয়ার বার্থটায় ঘাঁটি গাড়লেন। বাকি দু’জন মুন্নার উল্টো দিকে তিনটি বার্থের দু’টিতে। একটি আপার বার্থ ফাঁকাই থাকল। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়লেন মুন্না। সারা রাত তাঁর আর কোনও সাড়াশব্দ শোনা গেল না।
সাড়াশব্দ অবশ্য ট্রেনে ওঠার আগেও বিশেষ দেননি মুন্না। গয়া প্ল্যাটফর্মে রাত এগারোটা থেকে মুন্নার অদূরে বসে তাঁর মুখ থেকে বড়জোর ৭-৮টা গোটা বাক্য শুনেছি। সিআইডি-র অফিসারদের বেশির ভাগ প্রশ্নেই ‘হ্যাঁ’, ‘না’ কিংবা ‘জানি না’ বলেছেন তিনি। রাত সাড়ে ১১টার নির্ধারিত সময়ের বদলে ট্রেন এল প্রায় আড়াই ঘণ্টা দেরিতে। পুলিশ বেষ্টিত অবস্থায় ওভারব্রিজ পেরিয়ে হেঁটে আসার পরে এই গোটা সময়টা প্ল্যাটফর্মের বেঞ্চিতেই ঠায় বসেছিলেন মুন্না। মুখের ঢাকনি তুলে বার কয়েক সিআইডি-র দেওয়া বোতল থেকে জল খেয়েছেন। পুলিশ অফিসারদের চেনা এক যুবক এসে তাঁদের একটু ঠান্ডা পানীয় নিতে অনুরোধ করেছিলেন। মুন্নার কাছেও জানতে চাওয়া হল, ‘‘কোল্ড ড্রিংক চলবে?’’ মুন্না তখনও দু’দিকে মাথা নেড়েছেন। বলেছেন, “আমার হাই-সুগার আছে।”
মশার ব্যাপারে গয়া স্টেশনের বেশ নামডাক আছে। প্ল্যাটফর্মে থিতু হয়ে বসার কিছুক্ষণের মধ্যেই মশক বাহিনী ছেঁকে ধরল মুন্নাকে। একটানা ধকলে ক্লান্ত মুন্না তখন বেঞ্চে বসেই ঢুলছেন। হাতকড়া-পরা হাতের খোলা অংশে মশার কামড়ে মাঝে মাঝে চমকে উঠছেন। আক্রান্ত সিআইডি অফিসারেরাও। বিপদ এড়াতে তাঁরা মশা তাড়ানোর মলম এনে হাতে-মুখে মেখে ফেললেন। মুন্নার দিকেও টিউবটা এগিয়ে দিলেন। কিন্তু মলম লাগাতে রাজি নন মুন্না। ভাবভঙ্গি দেখে মনে হল, সামান্য ক’টা মশার কামড়ে এখন আর কিছুই যায়-আসে না তাঁর।
আবার কিছুক্ষণ মেপে-জুপে কথা। “ছেলে অনিলের সঙ্গে যোগাযোগ আছে?” প্রশ্ন শুনে কেমন থম মেরে গেলেন। তারপরে বললেন, “আমার কাছে তো মোবাইলই নেই!” গার্ডেনরিচের সে-দিনের ঘটনার কথা উঠতে বলেন, “দলের কথাতেই গিয়েছিলাম! মোক্তারদের দিক থেকে বোমা ছোড়া হল! কী করব? পাল্টা অ্যাটাকে গেলাম।” সামান্য একটা কলেজের গোলমালকে কেন্দ্র করে আপনার এই অবস্থা! আফশোস হয় না? অস্ফুটে সম্মতিসূচক মাথা নাড়লেন। মুখ-ঢাকা চেহারাটার কাঁধ যেন আরও ঝুলে গেল। কার কথায় এত দিন গা-ঢাকা দিয়ে থাকলেন? নিমেষে আবার টান-টান মুন্না! জবাব দিলেন না। কালকা মেল তত ক্ষণে গয়ার তিন নম্বর প্ল্যাটফর্মে ঢুকছে। ভিভিআইপি আসামি বাকি রাতটা ঘুমোনোর সুযোগ পাবেন।
রাত পেরিয়ে ঘুম ভাঙল শনিবার, সকাল সাড়ে সাতটায়। মুন্না উঠে বসতে তাঁকে ফের শৌচাগারে নিয়ে গেল সিআইডি। তার পর লোয়ার বার্থে বসিয়ে রেখে হাওড়ায় ঢোকার অপেক্ষা। পুলিশ অফিসাররা নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলছেন। মুন্নার কিন্তু কোনও দিকে ভ্রূক্ষেপ নেই।
হঠাৎ এক অফিসারের প্রশ্ন, ‘‘মুন্নাভাই এমবিবিএস দেখেছেন?” মুন্না বুঝলেন তাঁকে নিয়ে ঠাট্টা-তামাশা হচ্ছে। মুখ-চোখ কঠিন হয়ে উঠল। কাটা-কাটা জবাব দিলেন, “আমি ফিল্ম দেখি না!” পুলিশ অফিসারেরা আর ঘাঁটালেন না। বিস্কুট খেতে বললেন। কিন্তু মুন্না বিস্কুট নিলেন না। সিআইডি-র এক কর্তা বললেন, “সুগারের রোগী! কিছু তো খেতে হবে! আপনাকে নিয়ে আমরা ফ্যাসাদে পড়ব না কি?” মুন্না ঝাঁঝিয়ে ওঠেন। “আপনি জানেন, খেলেই সব ঠিক থাকবে? আর না খেলে মরে যাব?”
ওই একবারই। এত ক্ষণের যাত্রায় ওই একবারই যেন চেনা মুন্না, বন্দর-বাদশা মুন্নার দেখা মিলল। সিআইডি অফিসারদের এক জন অন্যকে বললেন, “থাক্, থাক্! ভবানী-ভবনে নিয়ে গিয়েই খাওয়াস!” ভাবটা এমন, এখন আর বেশি না ঘাঁটানোই ভাল!
মুন্নাও ফের চুপ। ট্রেন হাওড়ায় ঢোকার ঠিক আগে ঝটপট মুখের ঢাকনি পরলেন। চোদ্দো নম্বর ট্রেন থামতেই সংবাদমাধ্যমের হুড়োহুড়ি। ভবানী-ভবনে নিয়ে যেতে মুন্নাকে ঠেলতে ঠেলতে গাড়িতে তোলা হল।
গা ঢাকা দিয়েছিলেন ১৪ ফেব্রুয়ারি। ২৩ দিন বাদে মুন্নাভাই শহরে ফিরলেন।

মুন্নাভাইয়ের দিনলিপি
সকাল ৯.৩০: কালকা মেলে হাওড়া স্টেশন
সকাল ৯.৫৫: ভবানী ভবনে এনে জেরা
বেলা ১.৩০: দুপুরের খাবার
বেলা ১.৪৫: আলিপুর পুলিশ লক-আপে
বেলা ২.৩৫: আদালতে তোলা হল
বিকেল ৫.৩০: ফের ভবানী ভবনে
সন্ধ্যা ৭.২০: দফায় দফায় চলল জেরা
 
 
 


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.