ছেলে-মেয়েরা আর ফিরেও তাকায় না। খান পাঁচেক নাতি-নাতনি, কোলে তুলে এক বার আদর করতে বড় মন চায়। তা, ‘ভেন্ন’ হয়ে যাওয়ার পর তারাও আর কাছে আসে কই! দিনভর সস্তার আইসক্রিম বেচে দিনান্তে ঘরে ফিরে বড় খাঁ খাঁ লাগে দাওয়াটা। বয়স প্রায় পঁয়ষট্টি। তবু, নিঃসঙ্গতা মুছতে ফের বিয়ে করাই মনস্থ করেছিলেন বৃদ্ধ মকবুল হুসেন।
হোক না খঞ্জ। জলপাইগুড়ির বাঙালপাড়ার সাদাসিধে, ছিমছাম মেয়েটিকে দেখে বড়ই মনে ধরে গিয়েছিল। বিয়ে সেরে গ্রামের জনা উনিশ বরযাত্রীর সঙ্গে ছোট্ট টাটা-ম্যাজিক গাড়িটায় ঠাসাঠাসি করে উঠে বসেছিলেন বর-কনেও। কিন্তু হলদিবাড়ির জ্ঞানদাস গ্রামে নতুন বউ নিয়ে আর পৌঁছন হল না মকবুলের। বৃহস্পতিবার গভীর রাতে দুর্ঘটনায় পড়ে অন্য তিন বরযাত্রীর সঙ্গে সদ্য বিয়ে করা মহসিনা খাতুন (২৫) মারা গেলেন দুর্ঘটনাস্থলেই। আশ্চর্যের ব্যাপার, গাড়ি থেকে ছিটকে পড়ায় প্রায় অক্ষত রয়ে গিয়েছেন বৃদ্ধ মকবুল। সামান্য ছড়ে যাওয়া কনুই ছাড়া তাঁর আর কিছুই হয়নি। |
হলদিবাড়িতে দুর্ঘটনাগ্রস্ত সেই গাড়ি। ছবি: রাজা বন্দ্যোপাধ্যায় |
বৃহস্পতিবার রাত একটা নাগাদ কোচবিহারের হলদিবাড়ির জোড়াপুল এলাকায় ওই দুর্ঘটনায় মহসিনা ছাড়াও মারা গিয়েছেন লায়না খাতুন (৩৫), জামিউল হক (৮) এবং শাহিনূরা (২)। গুরুতর জখম হয়েছেন আরও আট জন। তাঁদের ছ-জনকে শিলিগুড়ির একটি নার্সিংহোমে এবং দু’জনকে জলপাইগুড়ি সদর হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে। তবে ওই দিন রাতে দুর্ঘটনার পরেই পালিয়ে গিয়েছে গাড়ির চালক। কোচবিহারের পুলিশ সুপার অনুপ জয়সওয়াল বলেন, “এত বড় দুর্ঘটনা, অথচ চালক কী করে বেঁচে গেল সেটাই আশ্চর্যের। তাকে গ্রেফতার না করা পর্যন্ত দুর্ঘটনার কারণই স্পষ্ট হচ্ছে না।”
প্রায় চল্লিশ বছর হল মকবুলের প্রথম স্ত্রী মারা গিয়েছেন। মাঝে আরও এক বার বিয়ে করেছিলেন। তবে সেই স্ত্রীও মারা গিয়েছিলেন অল্প দিনেই। গ্রীষ্মভর আইসক্রিম আর বছরের অন্য সময়ে এটা-ওটা ফেরি করে দিব্যি চলে যাচ্ছিল মকবুলের। কিন্তু একলা জীবনে ক্রমেই হাঁফিয়ে উঠেছিলেন যেন। বেশ কিছু দিন খোঁজ খবরের পরে অবশেষে ‘পাত্রী’র খোঁজ মিলেছিল।
ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের কাঁটা তারের বেড়ার ঠিক ওপারে বাঙালপাড়ার ছিটমহলে বাসিন্দা মহাদিন আলির ছোট মেয়ে মহসিনা। মেয়ে ভাল তবে একটু খুঁড়িয়ে হাঁটে এই যা। অনেক চেষ্টা করেও তাই মহসিনারও এত দিন বিয়ে হয়নি। মকবুলের প্রস্তাব পেয়ে মহসিনার বাবা মহাদিন তাই রাজি হয়ে গিয়েছিলেন। তিনি বলেন, “অনেক চেষ্টা করেছি। মেয়েটার বিয়ের ব্যবস্থা করতে পারছিলাম না। তাই বয়স্ক হলেও মকবুল সাহেব প্রস্তাব দিতে আর দেরি করিনি। মেয়ে একটু নিমরাজি ছিল। তবে আমি সময় নষ্ট করিনি। এখন দেখছি মেয়েটাকে জোর করেই জলে ভাসিয়ে দিলাম!”
ঘটনার পরে ভেঙে পড়েছেন মকবুলও। তিনি বলেন, “রাস্তার ওই জায়গাটা অনেকদিন ধরেই খারাপ। কিছুদিন আগে ওখানে গাড়ি উল্টে দুর্ঘটনা ঘটেছিল। রাস্তাটা সারানো হলে মহসিনাকে এমন বেঘোরে মরতে হত না। এখন তো নিজেকেই অপরাধী মনে হচ্ছে!” |